আন্তর্জাতিক

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের পথ জানালেন ফ্রান্সের অর্থমন্ত্রী

২০২১ সালের শেষের দিক থেকে ব্যাপক মূল্যস্ফীতির সংকটে ভুগছে ইউরোপীয় দেশগুলো। এর পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি। ইউরোপের নাগরিক, অর্থনীতিবিদ ও অর্থমন্ত্রীরা বহুদিন এ ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হননি। এটি আমাদের জন্য নতুন ও খুবই উদ্বেগের বিষয়।

Advertisement

মূল্যস্ফীতি একটি গোপন বিষ। এটি অর্থনৈতিক মন্দা বা সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে, এমনকি রাজনৈতিক সংকটেরও জন্ম দিতে পারে। এ কারণে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সরকারের জন্য অগ্রাধিকারের বিষয়। ইউরো জোনে যত দ্রুত সম্ভব দুই শতাংশ লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছানো উচিত। তার জন্য আর্থিক ও জ্বালানি উভয় সমস্যা মোকাবিলায় সমন্বিত কৌশল গ্রহণ গুরুত্বপূর্ণ।

প্রথমত, অর্থ ও আর্থিক নীতিগুলো সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়া উচিত। জনগণের খরচ বাড়তে থাকলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণমূলক নীতিগুলো অকার্যকর হয়ে পড়ে। সেজন্য জ্বালানির বাড়তি দামের বোঝা পরিবার, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও সরকারের মধ্যে ভাগ করে নিতে হবে।

ফ্রান্স পরিবারগুলোর জন্য একটি ‘এনার্জি শিল্ড’ চালু করেছে, যা ২০২৩ সালের শুরুর দিকে মূল্যবৃদ্ধির হার ১৫ শতাংশে সীমাবদ্ধ করবে। এতে অর্থায়নের জন্য বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীদের অতিরিক্ত মুনাফা আটকানোর একটি প্রক্রিয়া চালু করেছে ফরাসি সরকার। আশা করা হচ্ছে, এ থেকে আগামী বছর ২ হাজার ৬০০ কোটি ইউরো (২ হাজার ৫৯ কোটি মার্কিন ডলার) আসবে এবং এনার্জি শিল্ডের আংশিক তহবিল জোগাবে।

Advertisement

কোম্পানিগুলোকে অবশ্যই ভালো মজুরির বিষয়ে শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি পূরণ করতে হবে। তবে ১৯৭০’র দশকে ফ্রান্সে আমরা যে দুষ্টচক্রের মুখোমুখি হয়েছিলাম, তা এড়াতে এ ধরনের মজুরিবৃদ্ধি অবশ্যই উৎপাদনশীলতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে।

এটাই ফরাসি সরকারের নীতির লক্ষ্য, যার মধ্যে বেকারত্ব ও পেনশনের কাঠামোগত সংস্কার অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। আমরা যোগ্যতার মাত্রা ও অংশগ্রহণের হার বাড়াতে শ্রমবাজার সংস্কারের একটি উচ্চাভিলাষী কর্মসূচি অব্যাহত রাখবো।

নতুন অর্থনৈতিক পরিকল্পনায় অর্থ আর সুদমুক্ত নয়। ১০ বছর মেয়াদী ফরাসি সরকারি বন্ডের হার ১৮ মাস আগেও নেতিবাচক ছিল। তা বেড়ে এখন ২ দশমিক ৫ শতাংশের বেশি হয়েছে, যার ফলে কোটি কোটি ইউরো অতিরিক্ত ব্যয় হচ্ছে।

ইউরোপীয় সরকারগুলো যদি উচ্চতর ঋণ-পরিষেবা খরচ অনুমান করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে মূল্যস্ফীতি সংকট হঠাৎ করে আর্থিক সংকটে পরিণত হতে পারে। ব্রিটিশ বন্ড মার্কেটের সাম্প্রতিক অস্থিরতা দ্রুত সুদের হার বাড়ানোর প্রভাবের উদাহরণ।

Advertisement

ইউরোপীয় পর্যায়ে সামঞ্জস্যপূর্ণ ও সমন্বিত ব্যবস্থা আমাদের যার যার জাতীয় এজেন্ডায় অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। ইউরো জোনে একটি একক কেন্দ্রীয় ব্যাংক থাকলেও বেশ কয়েকটি সরকার রয়েছে। ভিন্ন ভিন্ন রাজস্ব নীতির সঙ্গে একটি একক মুদ্রানীতি চলতে পারে না। অন্যথায়, আমরা একক মুদ্রাকে খণ্ডিত ও দুর্বল করার ঝুঁকিতে রয়েছি।

আমাদের কৌশলের দ্বিতীয় ভিত্তি হলো জ্বালানির স্বাধীনতা। কারণ, এটি দাম কমাতে সাহায্য করবে। বর্তমান সংকটের ফলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে হাইড্রোকার্বন উৎপাদনকারী দেশগুলোতে সম্পদের ব্যাপক স্থানান্তর হচ্ছে। জ্বালানির উচ্চমূল্য একটি শক্তিশালী শিল্পবাজার গড়ে তোলার প্রচেষ্টাকেও দুর্বল করে দেয়।

সেজন্য ফ্রান্সের উচিত আরও বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য অবিলম্বে তার সব পারমাণবিক চুল্লি ফের চালু করা; ইউরোপীয় অংশীদারদের সঙ্গে যৌথভাবে দর কষাকষির মাধ্যমে জ্বালানি সরবরাহের উৎসগুলোকে বৈচিত্র্যময় করা; আর গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম কমানোর লক্ষ্যে ইউরোপীয় জ্বালানি বাজার সংস্কারের পক্ষে থাকা। এগুলোর পাশাপাশি, ইইউর সব সদস্য দেশ তাদের জ্বালানি ব্যয় কমাতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

দীর্ঘমেয়াদে আমরা নতুন পারমাণবিক চুল্লি ও নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎস বাড়িয়ে জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমাতে চাই। এমান্যুয়েল ম্যাক্রোঁর নেতৃত্বে ফ্রান্স এই পদ্ধতি গ্রহণ করেছে। যুক্তরাজ্যও ফ্রান্সের সঙ্গে অংশীদারত্বে পারমাণবিক বিদ্যুৎ সক্ষমতা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ইইউ এবং যুক্তরাজ্য নিয়ে গঠিত হবে পৃথিবীর প্রথম কার্বন-নিরপেক্ষ মহাদেশ।

সবশেষে, বিশ্বকে অবশ্যই বাণিজ্য ও লেনদেনে বাধা সৃষ্টির লোভ প্রতিহত করতে হবে। অর্থনৈতিক সংকটের সময় এটি আরও বেশি সম্ভাবনাময় বলে মনে হয়। শুল্ক সবসময় ভালো উদ্দেশ্যে নিয়ে প্রবর্তিত হলেও তা প্রায়ই বাণিজ্য যুদ্ধের পর্যায়ে চয়ে যায়।

গত আগস্ট মাসে যুক্তরাষ্ট্রের গৃহীত মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ আইন গভীর উদ্বেগের বিষয়। এই আইনে মার্কিন শিল্পগুলোতে ব্যাপক ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে। এটি বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নিয়মের লঙ্ঘন হতে পারে। এই উচ্চঝুঁকির পরিস্থিতি তিনটি বৃহত্তম বাণিজ্যিক অঞ্চল- ইউরোপ, আমেরিকা ও চীনের মধ্যে সম্পর্কে টানাপোড়েন সৃষ্টি করতে পারে। কিন্তু এটি অনিবার্য নয়।

মূল্যস্ফীতি সংক্রান্ত সংকট সর্বদা বৈশ্বিক ভূ-রাজনীতির মানচিত্র বদলে দিয়েছে। তাই নিশ্চিত করতে হবে, এবারের ঘটনা যেন আমাদের অভিন্ন স্বার্থের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হয়।

(দ্য ইকোনমিস্টে প্রকাশিত ফ্রান্সের অর্থনীতি, অর্থ ও শিল্প ও ডিজিটাল সার্বভৌমত্ব বিষয়ক মন্ত্রী ব্রুনো লে মায়ারের লেখা অবলম্বনে)কেএএ/