দক্ষিণ আফ্রিকার জঙ্গলে সম্প্রতি একদল গবেষক লক্ষ্য করেন, একটি বাচ্চা হাতি হঠাৎ পা ফসকে গর্তে পড়ে যায়। কিছুক্ষণ পর দেখা যায় দলে দলে হাতি চারিদিক থেকে বাচ্চাটির কাছে ছুটে আসছে। অথচ বাচ্চা হাতিটির কোনো চেঁচামেচির আওয়াজ গবেষকদের কারো কানে আসেনি। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগতে পারে এতদূর থেকে কোনো শব্দ না শুনেই হাতির দল বুঝলো কীভাবে যে তাদের বাচ্চা গর্তে পড়ে গেছে?
Advertisement
এ বিষয়টি দিনের পর দিন ভাবিয়েছে বিজ্ঞানী গবেষক দলকে। শেষে এর ওপর বিশ্ব বন্যপ্রাণী তহবিলের জীব বিজ্ঞানীরা যৌথ উদ্যোগে গবেষণা চালান। গবেষণার কাজে নিযুক্ত প্রযুক্তি বিজ্ঞানীরা জটিল সব ইলেকট্রনিক সরঞ্জাম নিয়ে ঢুকে পড়েন জঙ্গলে। প্রথম দু’দিনের পরীক্ষাতেই দারুণ ফল পেলেন তারা। যে সময়ের মধ্যে তারা হাতির ৬০টি ডাক শুনেছেন ঠিক সে সময়েই ডিজিটাল সরঞ্জামগুলো ৪০০ ডাক রেকর্ডিং করে।
বিজ্ঞানীরা বুঝলেন, হাতির অধিকাংশ ডাকই মানুষের শ্রুতি কম্পাঙ্কের সীমানার বাইরে। আমরা জানি, মানুষের শ্রুতি কম্পাাঙ্কের পরীসীমা হচ্ছে ৩০ হার্জ থেকে ১৮ কিলোহার্জ পর্যন্ত। অর্থাৎ ৩০ হার্জের কম ১৮ কিলোহার্জের চেয়ে বেশি শুনতে পায়না মানুষ। শব্দের কম্পাঙ্ক হার্জের চেয়ে কম হলে আমরা তাকে বলি ইনফ্রাসাউন্ড। আর এই কম্পাঙ্ক ১৮ কিলোহার্জ থেকে বেশি হলে বলি আল্ট্রাসাউন্ড বা শ্রবণাতীত শব্দ। বিজ্ঞানীদের পরীক্ষায় জানা যায়, হাতি নিজেদের মনোভাব বিনিময়ের জন্য যে সব শব্দ ব্যবহার করে তার অধিকাংশ কম্পাঙ্ক ১৪ থেকে ৩০ হার্জের মধ্যে। বিজ্ঞানীরা বলছেন-মনের ভাব বিনিময়ের জন্য মানুষের যেমন ভাষা রয়েছে হাতির অবশ্য তেমন কিছু নেই। তবে হাতিরা ভাব বিনিময় করে বিশেষ ধরনের কিছু কিছু শব্দ যেমন- ঘরঘর, কসকস, গরগর, তীক্ষ্ণ চিৎকার বা ভেঁপুর আওয়াজ ইত্যাদি। গবেষণায় দেখা গেছে, পৃথিবীতে মানুষ বাদে অন্যান্য প্রাণীর মধ্যে হাতিরই মনোভাব প্রকাশের ক্ষমতা সবচেয়ে বেশি।
অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতির সাহায্যে পরীক্ষার পর বিজ্ঞানীরা বলেছেন, হাতির দল প্রায় সারাক্ষণই অনর্গল কথা বলে। তবে তাদের করা শব্দ শ্রুতি কম্পাঙ্কের কম বলে তাতে জঙ্গলের নিরবতা ক্ষুন্ন হয় না। বিজ্ঞানীরা আরও জানিয়েছেন, এক দেড় মাইল দূর থেকে হাতিরা পরস্পর কথা বলে, আলাপ আলোচনা মিটিং করে। অথচ একজন মানুষ তাদের কছে থেকেও তাদের পরস্পরের কথা শুনতে পায় না। হাতি সমাজবদ্ধ জীব। তবে ঠিক মানুষের মতো অতো কঠিন নয়। মাদী হাতিগুলো প্রাপ্ত বয়স্ক সন্তানদের নিয়ে বাস করে তাদের মায়েদের সঙ্গে। আবার মা হাতিগুলো বাস করে তাদের মায়েদের সঙ্গে। এভাবে বংশ পরম্পরায় মাদী হাতি সবগুলো একসঙ্গেই বসবাস করে। কিন্তু পুরুষ হাতিগুলো বয়ঃপ্রাপ্ত হলে অন্যান্য পুরুষ হাতির সঙ্গে বসবাস করতে শুরু করে। এরা আলাদা বাস করে।
Advertisement
গবেষকদের প্রশ্ন- মিলনেচ্ছু দু’টি স্ত্রী ও পুরুষ হাতি মিলিত হয় কীভাবে? প্রশ্নটা প্রাণী বিজ্ঞনীদের ভাবিয়েছে দীর্ঘকাল। শেষে বিজ্ঞানীদের গবেষণার পর জানা যায়, মিলনেচ্ছু মাদী হাতির বিশেষ ধরনের ডাক শুনেই প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষ হাতি তিন মাইল পর্যন্ত দূর থেকেই তার সন্ধান পায় এবং মিলনের জন্য চলে আসে। স্থলচর প্রাণীদের মধ্যে মানুষের পর সবচেয়ে বেশি বুদ্ধিমান প্রাণী এই হাতিই। মানুষের কাছে হাতির জগতটা নিরব হলেও হাতির কাছে বড়ই বাঙময়। তাদের জীবনের অনেক কিছুই নিয়ন্ত্রণ করে এই নিরব শান্ত ভাষা।
লেখক: বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক। এম.ফিল স্কলার, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
কেএসকে/এএসএম
Advertisement