স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে অবকাঠামোগত উন্নয়নে পিছিয়ে পড়া কক্সবাজার দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে। গত দু’বছরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ দৃষ্টিতে কক্সবাজারকে ঘিরে নেয়া ২৫ মেগা উন্নয়ন প্রকল্প কক্সবাজারকে দেশের অর্থনৈতিক অঞ্চল হিসেবে নতুন করে স্বপ্ন দেখাচ্ছে। একই সঙ্গে জাতীয় অর্থনীতির একটি বড় অংশ কক্সবাজারের আয় থেকে যোগান হবে। আর চলমান প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হলে পাল্টে যাবে কক্সবাজারের চেহারা। তখন কক্সবাজার হবে একটি উন্নত ও পরিপূর্ণ পর্যটন নগরী। সম্প্রতি বর্তমান সরকারের দুই বছরে কক্সবাজারে ‘সরকারের সাফল্য অর্জন ও উন্নয়ন ভাবনা বিষয়ে’ এক প্রেস ব্রিফিংয়ে জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন এসব তথ্য জানান।ওই প্রেস ব্রিফিংয়ে জানানো হয়, উন্নয়নের ক্ষেত্রে বর্তমান সরকার এখন কক্সবাজারকেই বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে। বলতে গেলে কক্সবাজারকে উন্নয়ন ক্ষেত্র হিসেবে বেছে নেয়া হয়েছে। ২০০৮ সালের শেষের দিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর থেকেই কক্সবাজারে ধারাবাহিক উন্নয়নের ছোঁয়া লাগে। তবে দ্বিতীয় মেয়াদে আওয়ামী লীগ পুণরায় ক্ষমতায় আসার পর থেকেই কক্সবাজারে উন্নয়নের জোয়ার উঠে। শুধু কক্সবাজারেই ২৫টি মেগা উন্নয়ন প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছে সরকার। যেগুলো বর্তমানে আলোর পথে রয়েছে। কক্সবাজারে সরকারের বাস্তবায়িতব্য মেগা উন্নয়ন প্রকল্পের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড এর ‘মাতারবাড়ি তাপভিত্তিক কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র` প্রকল্প। মহেশখালী উপজেলার মাতারবাড়ী ও ধলঘাটা মৌজায় বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক এই তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের জন্য ১ হাজার ৪১৪ দশমিক ৬৫ একর জমি অধিগ্রহণ করে প্রত্যাশী সংস্থাকে এরই মধ্যে হস্তান্তর করা হয়েছে। এই প্রকল্পটি জাইকা ও বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নে প্রায় ৩৬ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়িত হচ্ছে। বর্তমানে এই প্রকল্পের উন্নয়ন কার্যক্রম চলছে। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড এর ‘এল.এন.জি ও কয়লা ভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র’ নামে অপর একটি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে মহেশখালীতে। এল.এন.জি ও কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের জন্য মহেশখালী উপজেলার ৬টি মৌজা হোয়ানক, হেতালিয়া, কালারমারছড়া, হরিয়ারছড়া, পানিরছড়া, অমাবশ্যাখালীর ৫ হাজার ৬৪৬ দশমিক ৯৫ একর জমি অধিগ্রহণের জন্য ইতোমধ্যে চূড়ান্ত অনুমোদন পাওয়া গেছে। খুব শিগগিরই জমি অধিগ্রহণ কার্যক্রম শুরু হবে।মাতারবাড়িতে ৭০০ মেগাওয়াট আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল কোল ফায়ার্ড নামে আরও একটি নতুন বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। এই প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য মহেশখালী উপজেলার মাতারবাড়ী মৌজায় ১ হাজার ২০০ একর জমি অগ্রিহণের জন্য অনুমোদন হয়ে গেছে। বর্তমানে অধিগ্রহণ কার্যক্রম চলমান রয়েছে।ইলেক্ট্রনিক জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড এর ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট সম্পন্ন আরও একটি কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে। এই প্রকল্পটি নির্মাণের জন্য পেকুয়ার উজানটিয়ার করিয়ারদিয়া মৌজায় ১ হাজার ৫৬৯ একর জমি অধিগ্রহণের প্রশাসনিক অনুমোদন হয়ে গেছে। মহেশখালীতে স্থাপিত হচ্ছে ইন্টলেশন অব সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম) প্রকল্প। ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড চট্টগ্রামের নিয়ন্ত্রণাধীন এই প্রকল্পটি নির্মাণের জন্য মহেশখালীর ধলঘাটা, কালারমারছড়া ও কালিগঞ্জ মৌজায় ৩৪ একর জমি এরই মধ্যে অধিগ্রহণ করা হয়েছে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এই প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। জিটিসিএল কর্তৃপক্ষের ‘মহেশখালী-আনোয়ারা গ্যাস সঞ্চালন পাইপ লাইন প্রকল্প’ বাস্তবায়নের জন্য ৮৩ দশমিক ৪৫১০ একর জমি অধিগ্রহণের জন্য ইতোমধ্যে প্রশাসনিক অনুমোদন হয়ে গেছে। এছাড়াও মহেশখালীতে স্থাপিত হচ্ছে বেজা কর্তৃপক্ষের ৫টি অর্থনৈতিক জোন। এগুলো হলো ১ হাজার ৭৮৪ একর জমির উপর ‘কক্সবাজার ফ্রি ট্রেড জোন’, ১ হাজার ৪৩৮ একর জমির উপর ‘মহেশখালী অর্থনৈতিক জোন-১’, ৮২৬ একর জমির উপর ‘মহেশখালী অর্থনৈতিক জোন-২’, ৬৭০ একর জমির উপর ‘মহেশখালী অর্থনৈতিক জোন-৩’। এছাড়াও ধলঘাটা মৌজায় আরও একটি অর্থনৈতিক জোন স্থাপনের জন্য মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। টেকনাফে আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারি উদ্বোধন হচ্ছে ‘সাবরাং অর্থনৈতিক জোন’। এই প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য এরই মধ্যে সকল জটিলতা সম্পন্ন করে ৮৮২ দশমিক ২৬ একর জমি বেজাকে হস্তান্তর করা হয়েছে। এছাড়াও টেকনাফ ও হ্নীলা মৌজার জালিয়ারদ্বীপে ২৭১ একর জমিতে স্থাপিত হচ্ছে ‘জালিয়ারদ্বীপ অর্থনৈতিক জোন’।সেনাবাহিনীর বাস্তবায়নে মেরিন ড্রাইভ সড়ক প্রকল্প কক্সবাজারের মানুষের একটি অন্যতম স্বপ্নের প্রকল্প। এই প্রকল্পটি সকল পর্যায় শেষ করে ২০১৭ সালে পরিপূর্ণতা পাবে। কক্সবাজার টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়ক নির্মাণ প্রকল্প-২ এর অনুকূলে ২য় পর্যায়ে অধিগ্রহণকৃত ইনানী-শিলখালী পর্যন্ত ২৪ কিলোমিটার সড়কের ১৬৯ দশমিক ৭৩ একর জমির ২৬৪ কোটি টাকা ক্ষতিগ্রস্তদের পরিশোধ করে উক্ত জমি ১৭ ইসিবিকে হস্তান্তর করা হয়েছে। ৩য় পর্যায়ে শিলখালী-টেকনাফ পর্যন্ত আরও ৩৫ কিলোমিটার ২১৫ একর জমি অধিগ্রহণের অনুমোদন পাওয়া গেছে। এছাড়া চকরিয়ার বদরখালী সড়কের বাটাখালী ব্রিজের ২ কিলোমিটার এপ্রোচ সড়ক নির্মাণের জন্য শূন্য দশমিক ১৬২২ একর জমি অধিগ্রহণ সম্পন্ন করা হয়েছে। যেটি বর্তমানে নির্মাণাধীন। খুরুশকুল-চৌফলদন্ডী-ঈদগাঁও সড়কের চৌফলদন্ডী ব্রিজ এপ্রোচে ৯ কিলোমিটার সড়কের নির্মাণ কাজ এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে। মাতারবাড়ি তাপভিত্তিক কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য নির্মিত হচ্ছে ৮৪ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য একটি সংযোগ সড়ক। এই সড়কটির নির্মাণ কাজ খুব শিগগিরই উদ্বোধন হবে।এছাড়া প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করার পর থেকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এগিয়ে চলছে কক্সবাজার বিমানবন্দরকে আর্ন্তজাতিক বিমানবন্দরে উন্নীতকরণের কাজ। বিমানবন্দরের বর্তমান রানওয়ে ৬৭৭৫ ফুট থেকে বাড়িয়ে ৯০০০ ফুটে উন্নীত করা হচ্ছে। এ প্রকল্পে ব্যয় হচ্ছে ১ হাজার ১২৩ কোটি ৩২ লাখ টাকা। তার মধ্যে ৪ হাজার ৪০৯টি ভূমিহীন পরিবারকে বাঁকখালী নদীর পূর্বপাশের খুরুশকুল ইউনিয়নে পুর্নবাসন প্রকল্পে যাতায়াতের জন্য বাঁকখালী নদীর উপর সংযোগ সড়ক নির্মাণের জন্য ২০০ কোটি টাকা ও পুর্নবাসন প্রকল্পের উন্নয়নের জন্য ২১০ কোটি টাকা বরাদ্ধ দেয়া হয়েছে যা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাস্তবায়ন হচ্ছে। এছাড়াও কুতুবদিয়া উপজেলায় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের কার্যালয় নির্মাণের জন্য শূন্য দমমিক ৩৩ একর জমি অধিগ্রহণের জন্য ইতোমধ্যে অনুমোদন হয়ে গেছে। যা বর্তমানে চলমান রয়েছে।এছাড়াও কক্সবাজারে বাস্তবায়নধীন রয়েছে শেখ কামাল আর্ন্তজাতিক স্টেডিয়াম, সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউট, মেডিকেল কলেজ, দোহাজারী-ঘুমধুম রেললাইন প্রকল্প, রামুতে দ্বিতীয় বিকেএসপি, ভেটেনারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস নির্মাণ, কোস্টগার্ডের স্টেশন নির্মাণসহ আরও বেশ কয়েকটি প্রকল্প। প্রক্রিয়াধীন রয়েছে সোনাদিয়া গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ ও মহেশখালী ট্যুরিজম পার্ক প্রকল্প। সম্প্রতি সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের কক্সবাজারে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, কক্সবাজার হচ্ছে সারা দেশের উন্নয়নের ছবি। সরকার কক্সবাজারকে দিয়ে সমগ্র বাংলাদেশকে উন্নত করতে চায়।এছাড়া গত ৩ ফেব্রুয়ারি কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের নব-নির্বাচিত সভাপতি-সম্পাদক প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে গেলে তিনি বলেন, কক্সবাজারের উন্নয়ন হলে সারা দেশের উন্নয়ন হবে। তাই সরকার কক্সবাজারের দিকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বড় বড় প্রকল্পগুলোর কাজ শুরু করেছে। যেগুলো বাস্তবায়িত হলে কক্সবাজারের সঙ্গে সঙ্গে পুরো দেশের চেহারা পাল্টে যাবে। এসএস/এমএস
Advertisement