মতামত

শিক্ষা ব্যবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তনে শিক্ষকের নৈতিক নিরপেক্ষতা

দেহ আর আত্মা বা মন- এ দুইয়ের সংমিশ্রণেই মানুষ। মূর্ত দেহ নির্দিষ্ট স্থান কালে অবস্থান করলেও বিমূর্ত আত্মার বিস্তৃতি এমন সীমাবদ্ধ নয়। এজন্য প্রচলিত খাবার দাবার দেহের পুষ্টি সাধনের জন্য যথেষ্ট হলেও আত্মা এতে পরিতৃপ্ত হতে পারে না। আত্মার বিকাশ আর পরিতৃপ্তির জন্য দরকার হয় নিত্যনতুন কৌতূহলের নিবৃত্তি।

Advertisement

মানুষের এসব মৌলিক কৌতূহল আর জাগতিক প্রয়োজন- এ দুই দিকের সমন্বিত সমাধানের লক্ষ্য নিয়েই জন্ম হয় "জ্ঞান"-এর। প্রাতিষ্ঠানিক পদ্ধতিতে এ জ্ঞান অর্জনই শিক্ষা। শিক্ষার মাধ্যমে আমাদের যে শুধু কৌতূহল নিবৃত্তি ঘটে তাই নয়,বরং এর সাহায্যে আমরা উপযুক্ত পরিস্থিতিতে সঠিক আচরটাও করতে পারি। তাই আধুনিক আচরণবাদী মনোবিজ্ঞানীরা যথার্থই বলেন, শিক্ষা এমন এক প্রক্রিয়া যা আমাদের আচরণের কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন ঘটায়।

এই শিক্ষা একটি দ্বিমুখী প্রক্রিয়া, যার এক প্রান্তে আছে শিক্ষা গ্রহীতা বা শিক্ষার্থী আর অন্য প্রান্তে আছে শিক্ষা দানকারী-শিক্ষক। স্বভাবতই চিরন্তন মৌলিক জিজ্ঞাসা আর মানব কৌতূহল নিবারণকারী হিসেবে শিক্ষকই শিক্ষা প্রক্রিয়ার অন্যতম কেন্দ্রীয় চরিত্র। একজন শিক্ষকের মাধ্যমেই শিক্ষার্থী প্রভাবিত হয়ে শিক্ষা গ্রহণ করে সে জন্যই আজকের শিক্ষার্থী তথা আগামী দিনের জাতির কর্ণধারকে গড়ে তোলার মহান দায়িত্ব পালন করেন একজন শিক্ষক। যেজন্য বলা হয়, শিক্ষক হলেন জাতি বিনির্মাণের কারিগর।

পৃথিবীতে আমাদের মানব জন্ম হয় মা-বাবার মাধ্যমে। কিন্তু প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে উঠার জন্য আমরা ঋণী আমাদের শিক্ষকের কাছে। আমাদের আত্মবিকাশের পথ নির্দেশনা আমরা পাই আমাদের শিক্ষকের কাছে। একজন প্রকৃত শিক্ষকই পারেন কোন শিক্ষার্থীর মাঝে লুকায়িত সত্তাকে আধার থেকে আলোর পথ দেখাতে।

Advertisement

কলুষিত হৃদয়কে হিতৈষী সত্তায় পরিণত করতে যে আলোর কোন বিকল্প নেই। এ কারণেই মহান ধর্মগ্রন্থে প্রেরিত মহাপুরুষদের সম্পর্কে বলা হয়েছে ঈশ্বর তাঁদের প্রেরণ করেছেন সমগ্র সৃষ্টিজগতের জন্য কল্যানকর শিক্ষক হিসেবে,যাঁরা পথভ্রষ্টদের পথ দেখাবেন। অতএব, বোঝাই যাচ্ছে, শিক্ষকতা বড় সহজ কাজ নয়, বরং এক জটিল আর গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। এ এমনই এক দায়িত্ব, নৈতিকতা যার অলঙ্কার ।

অনেক সময় দেখা যায় একজন শিশু শিক্ষার্থী ভুলক্রমে তাঁর শিক্ষকের কাছ থেকে কোন ভুল তথ্য পেলে তাকেই এমনভাবে গ্রহণ করে যে অন্য কেউ তথ্যটি সঠিক করে দিলেও শিশুমন তা গ্রহণ করতে চায় না। শিক্ষাদানে শিক্ষকের যথার্থতা বা নৈতিকতা যে একটা গাঢ় ছাপ রাখে শিক্ষার্থীর জীবনে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

একজন শিক্ষকের ভূমিকা একজন শিক্ষার্থীর জীবন বদলে দিতে পারে জাদুকরী উপায়ে তাই সে বদল যেন ইতিবাচক হয় সে লক্ষ্য অর্জনে নৈতিকতার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। শিক্ষার যে কোন পরিবর্তনের মূল পরিচালক শিক্ষক। তাই যে কেন শিক্ষানীতির সঠিক বাস্তবায়নের জন্য একজন শিক্ষকের মেধা, দক্ষতা, দূরদর্শিতার মতো নৈতিক নিরপেক্ষতাও আবশ্যক। এক্ষেত্রে "নৈতিক নিরপেক্ষতা " প্রত্যয়টির কিছুটা ব্যাখ্যা দেওয়ার প্রয়োজন। শিক্ষার কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনে শিক্ষকের নৈতিক নিরপেক্ষতা পাঠ্যক্রমভিত্তিক এবং শিক্ষার্থীর মনোজাগতিক -উভয়মুখী হওয়া দরকার।

অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নতুন একটি শিক্ষা নীতি প্রণয়নের পর পুরাতন পরিস্থিতিতে অভ্যস্থ আমরা সহজে তা গ্রহণ করতে চাই না বা পারি না। কিন্তু একজন শিক্ষক যদি পুরাতন শিক্ষানীতির প্রতি পক্ষপাতহীন থেকে তাঁর শিক্ষার্থীদের কাছে সহজবোধ্য করে নতুন শিক্ষা নীতির উপস্থাপন করতে পারেন তবে তা দ্রুততম সময়ে সফলতা বয়ে আনে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশের শিক্ষা নীতিতে প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত প্রচলিত পরীক্ষা পদ্ধতির বদলে ধারাবাহিক মূল্যায়নের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।

Advertisement

এটি আমাদের দেশের জন্য একটি নতুন সংযোজন হওয়ায় এ সম্পর্কে অনেক অভিভাবকের মাঝে বিরূপ মনোভাব দেখা যেতে পারে। এ বিষয়টির প্রয়োজনীয়তা এবং আধুনিক বিশ্বশিক্ষার ক্ষেত্রে এর প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে শিক্ষক যদি সঠিক তথ্য নিরপেক্ষভাবে উপস্থাপন করতে পারেন তবে এর গ্রহণযোগ্যতা বহুলাংশে দ্রুততায় সম্পন্ন হবে।

এভাবেই শিক্ষকতার ক্যারিশমাটিক ব্যঞ্জনায় একজন শিক্ষক তাঁর নৈতিক দৃঢ়তা আর দূরদর্শিতায় হতে পারেন নতুন শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিবর্তনের দূত। আগামীর শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষক আর শিক্ষার্থীদের কার্যকর মিথস্ক্রিয়ায় সঠিক পথে চালিত হলেই আমরা পাব আমাদের কাঙ্ক্ষিত সমৃদ্ধ বিশ্ব।

লেখক, সহকারী অধ্যাপক, কবি নজরুল সরকারি কলেজ, ঢাকা।

এইচআর/এএসএম