একটা অদৃশ্য ঝাড়ু ও বেলচা নিয়ে ডাউনিং স্ট্রিটে প্রবেশ করলেন ঋষি সুনাক। ২৫ অক্টোবর ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়েই তিনি ঘোষণা দিয়েছেন, ‘ভুল করা হয়েছে।’ বলেছেন, ‘আমাকে দলের নেতা নির্বাচিত করা হয়েছে… সেগুলো সংশোধন করতে।’ কথাগুলো ভাববাচ্যে বলা হলেও এর পেছনে দায়ী ব্যক্তিটির পরিচয় স্পষ্ট- লিজ ট্রাস, মাত্র ৪৯ দিনের মাথায় ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হওয়া পূর্বসূরি।
Advertisement
তবে এই বক্তব্যের ভেতর একটা সমস্যা রয়েছে। যুক্তরাজ্যের বর্তমান সমস্যাগুলোর সমাধান যেমন ঋষি, তেমনি এগুলো সৃষ্টির কারণও তিনি। নতুন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এখন নিজের পাঁকানো ঝামেলা দূর করতেই জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কনজারভেটিভ পার্টি যখনই ভুল করেছে, ঋষি সুনাক প্রায় প্রতিবারই তা সংশোধনের পরিবর্তে ভুলের পক্ষ নিয়েছেন। যুক্তরাজ্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে বেরিয়ে যাওয়া বা ব্রেক্সিট সমর্থন করার পেছনে অনেক কারণ ছিল। কিন্তু ঋষি সবচেয়ে খারাপটিই বেছে নিয়েছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন, এটি একটি দুর্দান্ত আইডিয়া। ২০১৬ সালে তিনি লিখেছিলেন, যুক্তরাজ্য ইইউ’র বাইরে ‘আরও মুক্ত, সুন্দর ও সমৃদ্ধশালী হবে।’
ঋষি সুনাকের সরকারে মূল সমস্যা হবে এমন একটি নীতি, যার জন্য তিনি দীর্ঘদিন প্রচারণা চালিয়েছেন। যুক্তরাজ্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার বিষয়ে ‘নো ডিল ব্রেক্সিট’র পক্ষে ছিলেন এ কনজারভেটিভ নেতা। যদিও তিনি এখন ইইউ জোটের সঙ্গে আরও গঠনমূলক সম্পর্ক গড়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন, তবে সেটি একেবারে ভেঙে না পড়লেই হয়।
Advertisement
বরিস জনসন ও ঋষি সুনাক। ছবি সংগৃহীত
ব্রেক্সিট গণভোটের পর দীর্ঘ তিন বছর রাজনৈতিক অচলাবস্থা ছিল যুক্তরাজ্যে। সেই জগাখিচুড়ি পরিস্থিতিতে বরিস জনসনকে সমর্থন করেন ঋষি। সেসময় স্থানীয় সরকার বিভাগের একজন জুনিয়র মন্ত্রী ছিলেন তিনি। অবশ্য তার সমর্থন না পেলেও জনসনের জয়ী হওয়া আটকাতো বলে মনে হয় না।
কিন্তু জনপ্রিয়তার গাড়িতে ওঠার জন্য বুদ্ধিবৃত্তিক বিপর্যয়ের প্রয়োজন ছিল। ঋষি সুনাকের যুক্তি ছিল, থেরেসা মে যোগ্য ও পরিশ্রমী হলেও ব্যর্থ। তাই জনসন যোগ্য বা পরিশ্রমী কি না এটা কোনো ব্যাপারই নয়।
তবে গত জুলাই মাসে জনসন সরকারের অর্থমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়ান ঋষি। এর ধারাবাহিকতায় পদত্যাগ করেন আরও একঝাঁক মন্ত্রী। ফলে শেষপর্যন্ত জনসনের ক্ষমতার অবসান ঘটে। তাহলে প্রশ্ন হলো, তাকে ডাউনিং স্ট্রিটে বসানো হলোই বা কেন?
Advertisement
মহামারি চলাকালে বিপুল আর্থিক ব্যয়ের কর্মসূচি ঋষি সুনাককে সাময়িকভাবে দেশটির সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনীতিবিদ করে তুলেছিল।
তবে এই সিদ্ধান্তগুলোই তাকে সবচেয়ে বেশি জ্বালাতন করতো। এ কারণে নির্ধারিত সময় শেষ হওয়ার আগেই অর্থের মজুত বাঁচাতে খরুচে কর্মসূচিগুলো বন্ধের চেষ্টা করেন তিনি। কিন্তু গত বসন্তে ক্রমবর্ধমান জ্বালানি বিলের চাপ কমাতে জনগণকে সহায়তার প্রস্তাব উত্থাপন করেন ঋষি।
অর্থাৎ, মনের দিক থেকে তিনি কনজারভেটিভ ঠিকই। তবে জরুরি প্রয়োজন দেখা দিলে নিজের স্বাভাবিক প্রবৃত্তিকে অতিক্রম করার প্রশংসনীয় ক্ষমতা দেখাতে পারেন ঋষি।
লিজ ট্রাস ও ঋষি সুনাক। ছবি সংগৃহীত
রাজনীতিতে কখনো কখনো ভাগ্যও ভবিষ্যৎ নির্ধারক হয়ে ওঠে। লিজ ট্রাসের সঙ্গে নেতৃত্বের প্রতিযোগিতায় হেরে যাওয়া ঋষি সুনাকের জন্য সাপে বর হয়েছে। পুরো প্রচারণায় ঋষি বারবার বলেছেন, ট্রাসের শাসন বিপর্যয়কর হবে। ঠিক সেটাই হয়েছে। ট্রাসের ভুলের কারণে এই সত্যটি অনেকটাই চাপা পড়ে গেছে যে, প্রথম নির্বাচনে যদি ঋষি সুনাক জয়ী হতেন, তাহলে সুদের হার বাড়ানোর বিষয়ে জবাব দিতে তাকেও বিপাকে পড়তো হতো। কিন্তু এখন সব দোষ তিনি ট্রাসের ওপর চাপিয়ে দিতে পারছেন।
কনজারভেটিভরা দীর্ঘদিন ধরে দেশশাসনের ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থের বদলে নিজেদের রাজনৈতিক ফায়দাকে গুরুত্ব দিয়ে এসেছে। গত গ্রীষ্মের প্রচারণায় একই পথ বেছে নিয়েছিলেন ঋষি সুনাকও। তিনি উপকূলীয় বায়ু ও সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্পে রাশ টেনে ধরার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এতে কিছু লোক সন্তুষ্ট হলেও যুক্তরাজ্যের জলবায়ু লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছানো কঠিন হয়ে উঠবে।
তাছাড়া ঋষি অর্থমন্ত্রী থাকাকালে জ্বালানি শুল্ক কমানোর সিদ্ধান্ত কিছুদিন পত্রিকার পাতায় ইতিবাচক শিরোনাম দিতে পারলেও জনগণের পকেট বাঁচাতে ব্যর্থ হয়েছে এবং পরিবেশেরও খুব একটা উপকার করেনি।
২০১৫ সালে প্রথমবার পার্লামেন্টের সদস্য নির্বাচিত হন ঋষি সুনাক। অর্থাৎ তিনি রাজনীতি করছেন খুব বেশিদিন হয়নি। প্রচুর বুদ্ধিমত্তা থাকলেও তার অনভিজ্ঞতা প্রায়ই সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে কনজারভেটিভ পার্টির সামনে হয়তো আর কোনো রাস্তা ছিল না।
আপাতত এটা ভেবে স্বস্তি পাওয়া যেতে পারে যে, ঋষি খুবই চালাক নেতা, যিনি ব্রেক্সিট ও বরিস জনসনকে নিয়ে বাজি ধরেছিলেন এবং দুই শতাব্দীর মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। আরও উদ্বেগজনক বিশ্লেষণ হলো, তিনি খারাপ আইডিয়া থাকা একজন উজ্জ্বল ও ভদ্র মানুষ।
সূত্র: দ্য ইকোনমিস্টকেএএ/