এডিস মশাকে মূলত বলা হয় ‘পিছলা মশা’। মানবদেহে বসে ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, ম্যালেরিয়াসহ নানা ধরনের রোগ বিস্তার করে এরা। এদের রোগ বিস্তারের ক্ষমতা অধিক। ১৯৬৪ সালে ‘অজানা’ কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০ জন শিক্ষার্থী মারা যান। পরবর্তীসময়ে তাদের মৃত্যুর কারণ খুঁজতে পরীক্ষার করে ডেঙ্গুর দ্বিতীয় ধাপ চিহ্নিত করা হয়। ডেঙ্গুর মূলত চারটি ধরন। প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের চেয়ে পরের ধাপগুলোতে মানুষ আক্রান্ত হলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
Advertisement
জাগো নিউজকে কথাগুলো বলছিলেন সাবেক জেলা কীটতত্ত্ববিদ ড. মো. মোরশীদুল হাসান।
এডিস মশা ঘরে-বাইরে বিভিন্ন কোটরে বংশবিস্তার করে বলে বায়োলজিক্যাল পদ্ধতিতে (মশা দিয়ে মশা নিয়ন্ত্রণ) নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে বলে মত দেন তিনি।
ড. মো. মোরশীদুল হাসান বলেন, বাংলাদেশে ১১৩ ধরনের মশা রয়েছে। এর মধ্যে এডিস এক ধরনের মশা। ১৯৫২ সালে একজন ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ গবেষক এডিস মশা নির্ণয় করেন। এটি দিনে মানুষকে কামড়ায়, রাতে কামড়ায় না। সূর্য ওঠার পর সকাল ৯টা পর্যন্ত আর সূর্যাস্তের পর সন্ধ্যা পর্যন্ত।
Advertisement
‘এরা মূলত দুই ধরনের কোটরে বা গর্তে বংশবিস্তার করে। বনে-জঙ্গলে পানি জমে থাকা পাত্রে ও নির্মাণাধীন ভবনের ছাদ ঢালাইয়ের ওপর জমে থাকা পানিতে। এদের কেউ কেউ গৃহপালিত মশাও বলেন। স্ত্রী এডিস সরাসরি পানিতে ডিম পাড়ে না। পানির দু-তিন ইঞ্চি ওপরে ডিম পাড়ে।’
তিনি বলেন, পানির মধ্যে ডিমগুলো পড়ার পর কালো এক ধরনের প্রলেপ তৈরি হয়। এগুলো দুই বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে। কোটরে পানি শুকিয়ে গেলেও ডিমগুলো জীবিত থাকে। সেখান থেকে এডিস মশার লার্ভা তৈরি হয়ে বংশবিস্তার করে। এদের কামড়ানোর বিভিন্ন ধরন বলে- এক স্থানে বসলে শরীরের অন্য স্থানে চুলকানি তৈরি হয়।
সাধারণ মশা
এর কারণ হিসেবে এই গবেষক বলেন, এডিস মশা মানব শরীরে ডেঙ্গু-চিকুনগুনিয়াসহ নানা ধরনের ভাইরাস বিস্তার করে। এডিস কামড়ালে শরীরে এক ধরনের বিষ মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। এর মাধ্যমে চুলকানির ভাব তৈরি হয়। এ মশা মানুষের শরীরের গলার খালি অংশে, হাতের কব্জি ও পায়ের পাতার অংশে বেশি কামড়ায়। সেজন্য এডিস মশা থেকে রক্ষা পেতে যতটা পারা যায় শরীরের এসব অংশ ঢেকে রাখা দরকার।
Advertisement
‘মেয়েরা স্বাভাবিকভাবে এসব অংশ ঢেকে থাকে বলে তারা কম আক্রান্ত হয়। এডিস মশা কোথায় বেশি বিস্তার হচ্ছে আমাদের সেই মনিটরিং কম। লার্ভাগুলো কোথায় বেশি আছে সেখানে ফগার স্প্রে করলে লার্ভাগুলোর বংশবিস্তার রোধ করা সম্ভব হয়। তবে এরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে কোটরে বা গর্তে ডিম পাড়ায় সেটি শনাক্ত করা কঠিন। এটিকে ভয়াবহ মশা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।’
এডিস মশা
এডিস নিয়ন্ত্রণে উপায় হিসেবে এই কীটতত্ত্ববিদ বলেন, ভয়াবহ এ মশাকে বায়োলজিক্যাল পদ্ধতিতে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। এটা বেশি কার্যকর। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ পদ্ধতিতে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হচ্ছে। এটি করতে হলে এক ধরনের বড় আকারের ‘উপকারী মশা’ প্রয়োজন। সেগুলো মানুষকে কামড়ায় না। এগুলো এডিসের চেয়ে ১০-১২ শতাংশ বড় হয়। উপকারী মশা চাষ করে ছেড়ে দেওয়া সম্ভব হলে এডিস মশাকে খাবার হিসেবে খাবে। আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করার সময় বড় আকারের এসব মশার বংশবিস্তার করে ছেড়ে দেওয়ায় এডিস মশা তুলনামূলক কমে যায়। এভাবে বায়োলজিক্যাল কন্ট্রোল করা সম্ভব হলে ঘরে-বাইরে আনাচে-কানাচে এডিস মশা ন্যাচারালি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে।
এ পদ্ধতি অনুসরণ করতে সময়, জনবল, উপকরণ, পরিকল্পনামূলক ডিজাইন প্রয়োজন উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের স্বাস্থ্য বিভাগ ১৯৮৮ সালে মালয়েশিয়া থেকে এই উপকারী মশাটি বংশবিস্তারের জন্য আমদানি করে। তবে সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়। এটির বংশবিস্তারের স্থান খুঁজে বের করতে হবে। বাংলাদেশে আমি একটি স্থান খুঁজে পেয়েছি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছয় মাস অনুসন্ধান করে ছয়টি লার্ভা খুঁজে পাই। প্রতিবছর বৃষ্টি শুরুর আগে উপকারী মশার বংশবিস্তার করে ছেড়ে দেওয়া হলে এডিস মশা কমে যাবে। আমার কাছে এ প্রযুক্তি রয়েছে। এজন্য একটি রুম ও প্রয়োজনীয় জিনিস দেওয়া হলে আমার নিজস্ব ল্যাবে উপকারী মশার বংশবিস্তার করা সম্ভব।
এমএইচএম/এএসএ/জেআইএম