ইংরেজদের পর্বতসম জুলুম ও নির্যাতনের শিকার হয়ে জন্মভূমিতে মরতে পারেননি ভারতের শেষ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর। সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের আত্মত্যাগ পৃথিবীর সব বড় বড় শোক, নির্যাতনের ইতিহাসকে হার মানায়। এ ইতিহাস ভারতবাসীকে এখনো কাঁদায়। এখনো প্রতিদিন হাজারো ভারতবাসী মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের ইয়াঙ্গুনের সমাধি বা মাজারে গিয়ে বর্বর পাষণ্ড ইংরেজদের ধিক্কার দেন এবং বাহাদুরের ত্যাগের কথা স্মরণ করে দোয়া করেন।সম্প্রতি ইয়াংগুন শহরের জিওয়াকা সড়কের শোয়েডাগন প্যাগোডার পাশে ছায়া সুনিবিড় স্থানে এই সমাধিতে গিয়ে দেখা যায় ভক্তদের সরব উপস্থিতি। ভারতবর্ষ ছাড়াও সুদূর ইউরোপ, আমেরিকা, নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া এমন কি বাংলাদেশ থেকেও অনুসন্ধানী মনের মানুষেরা ভিড় জমান দিল্লির শেষ সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের সমাধিতে।বাহাদুর শাহের মতো একজন দেশপ্রেমিক মোগল সম্রাটকে জন্মের অধিকার বঞ্চিত হয়ে নির্বাসিত অবস্থায় অর্ধাহারে-অনাহারে মরতে হয়েছে। ছয় ছেলের মাথা কেটে প্লেটে করে তার সামনে এনে বলা হয়েছে, এরপরও কি দিল্লীর মসনদ চাও? তারপরও নত হননি সম্রাট। বাহাদুর শাহের পুর্বসূরী সম্রাট জাহাঙ্গীরের দয়ায় যারা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি গঠনের কৃপা লাভ করেন, সেই অকৃতজ্ঞ ইংরেজদের মিথ্যা ও সাজানো বিচারে ফাঁসির রায় দেয়া হয় বাহাদুর শাহকে। বয়স বিবেচনায় পরে বেঁচে থাকা দুই ছেলে ও স্ত্রী জিনাত মহলসহ ৩২ জনকে কঠোর গোপনীয়তায় তৎকালীন রেঙ্গুনের নির্জন অরণ্যে নির্বাসনে পাঠানো হয়। এরপর বৃদ্ধ এই সম্রাটের উপর চালানো হয় আরো কঠিন জুলুম ও অত্যাচারের স্টিম রোলার। বিভীষিকাময় সেই অধ্যায়ের পর মাত্র চার বছর তিনি বেঁচে ছিলেন। বাহাদুর শাহের ইতিহাসের অনেকটা লুকিয়ে ফেলেছে ইংরেজরা। সুফি সাধক, ফার্সি কবি ও গজল রচয়িতা বাহাদুর শাহের রাজনৈতিক কোনো উচ্চাভিলাষ না থাকলেও ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে ১৮৫৭ সালে যে বিপ্লব গড়ে ওঠে, তাতে সমর্থন দেয়ার অযুহাতে ১৮৫৭ সালের ২০ সেপ্টেম্বর তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে আত্মসমর্পনে বাধ্য করা হয়।বাহাদুর শাহকে নিয়ে ইংরেজ বেনিয়া আর শাসকদের ২০ বছরের গোপন ষড়যন্ত্রের কাহিনী ও এর পেছনের তথ্যের খোঁজে ছুটেছেন বাংলাভিশনের ইতিহাস অনুসন্ধানী প্রতিবেদক আহমেদ সারোয়ার। সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের আত্মত্যাগ ও নির্যাতিত হওয়ার ইতিহাস আর তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করতে তিনি গিয়েছিলেন মিয়ানমারের ইয়াঙ্গুনে অবস্থিত বাহাদুর শাহের সমাধিতে। সমাধিস্থলে কথা হয় তার সাথে।আহমেদ সারোওয়ার জাগো নিউজকে জানান, এখানে বাহাদুর শাহ ছাড়াও তার দুই ছেলে এবং তৃতীয় স্ত্রী জিনাত মহলেরও সমাধি রয়েছে। সম্রাট দ্বিতীয় আকবর ও রাজপুত্র লাল বাইয়ের ছেলে বাহাদুর শাহ ১৭৭৫ সালের ২৪ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন দিল্লীতে। ১৮৩৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর তিনি দিল্লীর সিংহাসনে আরোহন করেন ১৭তম এবং শেষ মোগল সম্রাট হিসেবে। ১৮৫৮ সালে এক স্ত্রী, দুই ছেলে ও কিছু কর্মচারীসহ তাকে নির্বাসনে পাঠানো হয়। একই সময়ে রেঙ্গুনের তৎকালীন শাসককে ভারতে নির্বাসন দেয় ইংরেজ রাজ। নির্বাসনে থাকাবস্থায় পক্ষাঘাত রোগে আক্রান্ত বাহাদুর শাহ ১৮৬২ সালের ৭ নভেম্বর ভোর ৫টায় মারা যান। ওইদিনই বিকেল ৪টার দিকে তাকে বর্তমান সমাধিস্থলে সমাহিত করা হয়। দীর্ঘদিন অবহেলায় থাকার পর ১৯৯১ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি তার সমাধিস্থলকে অবকাঠামোগত রূপ দেয়ার কাজ শুরু করা হয়। কাজ শেষে ১৯৯৪ সালের ১৫ ডিসেম্বর এটি সর্বসাধারণের দেখার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। বাহাদুর শাহ ছিলেন আট ছেলে ও তিন মেয়ের জনক। নির্বাসনে পাঠানোর আগে ইংরেজরা বাহাদুর শাহের ছয় সন্তানকে হত্যা করে। বাহাদুর শাহের চারজন স্ত্রী ছিলেন। এরা ছিলেন- বেগম আশরাফ মহল, বেগম আখতার মহল, বেগম জিনাত মহল এবং বেগম তাজমহল। নির্বাসনে যাওয়ার সময় তাঁর সাথে তৃতীয় স্ত্রী জিনাত মহল ছিলেন। বাহাদুর শাহ বহু ফার্সি কবিতা ও গজল রচনা করেছিলেন। তাকে আটকের সময় ইংরেজরা সেসবের অনেকগুলোই ধ্বংস করে ফেলেন। অবশিষ্ট কিছু এখনো বিভিন্ন যাদুঘরে রয়েছে বলে জানা যায়। এর ভেতর লন্ডন জাদুঘরে তার বেশ কিছু রচনা সংরক্ষিত রয়েছে। বাহাদুর শাহ ক্ষমতাসীন হন এটা তার বাবা দ্বিতীয় আকবরের ইচ্ছা ছিল না। কারণ, রাজ পরিবারের সদস্য হিসেবে বাহাদুর শাহ অশ্ব, অস্ত্র চালনায় পারদর্শী হলেও তিনি সুফিবাদ, দর্শন, কবিতা, গজল নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকতেন। তাকে পীর হিসেবেও মানতেন অনেকে। অগণিত মুরিদও ছিল তার। বাহাদুর শাহের মাজারটি নয়নাভিরামভাবে সাজানো হয়েছে। পরিপাটি করে সাজানো মাজারটির সামনে গেলে স্বাভাবিকভাবেই মনে হবে এটা কোনো রাজা বা বাদশাহর মাজার। মাজার কমপ্লেক্সে তার নামে একটি সভাকক্ষও রয়েছে। মাজারে প্রবেশ করতেই হাতের ডান পাশে তার নামে করা সভাকক্ষটির সামনেই দেখা যায় বাহাদুর শাহ জাফরের বিশাল পোট্রেট। মাজারের ভেতরের দেয়ালগুলোতেও রয়েছে নানা আকৃতির তার একাধিক পোট্রেট। এ ছবিগুলোর একটি মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা আগে তোলা। বৃদ্ধ বাহাদুর শাহকে ওই ছবিতে দেখা যায় খুবই ক্লান্ত, বিবর্ণ এবং বিমর্ষ। এই কমপ্লেক্সে বাহাদুর শাহের দুই ছেলের ছবিও রয়েছে। রয়েছে তৃতীয় স্ত্রী বেগম জিনাত মহলের ছবিও। মাজার প্রাঙ্গণে গেলে মনটা কেমন যেন শান্ত হয়ে যায়। কী এক অজানা রহস্য এসে আকর্ষণ করে। ফিরিয়ে নিয়ে যায় কল্পনার রাজা-রাণীদের জগতে। দুই তলা বিশিষ্ট ওই সমাধিসৌধের নিচতলায় ঝাড়বাতির নিচে বাহাদুর শাহের সমাধি। আর দ্বিতীয় তলায় তার এক স্ত্রী ও দুই ছেলের সমাধি। দূর-দূরান্ত থেকে পর্যটকরা এই সমাধিস্থলে এসে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাবের কবর দর্শন করেন এবং দেয়ালে টানানো তার বিভিন্ন ছবি ও পোট্রেট অবলোকন করে মোগলামলের স্মৃতি হাতড়ান। কেউ কেউ বুকে হাত দিয়ে সুর করে বলেন, ‘ইয়া জালাল, ইয়া জাফর, সালাম আলাইকা।’বাহাদুর শাহ নিজের এপিটাফ লিখেছিলেন, ‘নিজের জমিতে দু’গজ জায়গাও মিললো না।’ ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী আশির দশকে মিয়ানমার সফরে গিয়ে তার সমাধি ফলকে লিখে এসেছিলেন, ‘হিন্দুস্তানে তুমি দু গজ মাটি পাওনি সত্য। তবে তোমার আত্মত্যাগ থেকেই আমাদের স্বাধীনতার আওয়াজ উঠেছিল। দুর্ভাগ্য তোমার নয় জাফর, স্বাধীনতার বার্তার মধ্যে দিয়ে ভারতবর্ষের সুনাম ও গৌরবের সঙ্গে তোমার নাম চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছে।’অভাব, অনটন, উপেক্ষা আর অবহেলায় জর্জরিত সম্রাট পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হন। এমন বিড়ম্বনাপূর্ণ জীবনের অবসান হয় ১৮৬২ সালের ৭ নভেম্বর। কঠোর গোপনীয়তার সাথে রেঙ্গুন শহরের এক নির্জন এলাকায় অতি দীনহীনভাবে, খুবই তাচ্ছিল্যের সাথে ইংরেজ সরকার সমাহিত করে বাহাদুর শাহকে। প্রথমে কবরটি বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘিরে দেয়া হয়েছিল। উদ্দেশ্য, যা একসময় নষ্ট হয়ে যাবে, ঘাসগুলো গোটা জায়গা আচ্ছাদিত করে ফেলবে। কোথায় সর্বশেষ মুগল সম্রাট শায়িত আছেন, তার চিহ্নও কেউ খুঁজে পাবে না। পরে তার আসল কবর আবিষ্কৃত ও সমাধিসৌধ নির্মিত হয়। সম্রাটের প্রিয়তমা স্ত্রী জিনাত মহল মারা যান ১৮৮৬ সালের জুলাই মাসে। সম্রাটের পাশেই রয়েছে তার সমাধি।সম্রাট বাহাদুর শাহ্ জাফর ইতিহাসের এক ট্র্যাজিক নায়ক; যার জীবন বিষাদ, বঞ্চনা, অবহেলা আর উপেক্ষার পদাবলীতে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। তবু তিনিই ভারতবর্ষের স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা, স্বাধীনতার চেতনার ভিত্তি তাঁর হাত ধরেই নির্মিত হয়েছে। তাই ইতিহাসের কাছে ফিরতে হবে- বিপ্লবের ব্যর্থতা কেবল শোকগাথা নয়, নতুন প্রজন্মের কাছে উপনিবেশবাদ আর সাম্রাজ্যবাদকে শনাক্ত করারও দিকনির্দেশনা। বর্তমান প্রজন্মও চায় হতভাগ্য সম্রাট বাহাদুর শাহকে জানতে, তাঁর সময়কাল সম্পর্কে জানতে। আরএম/এনএফ/এমএস
Advertisement