ইউরোপ ও আমেরিকার অর্থনৈতিক পরিস্থিতি যেন দিন দিন খারাপের দিকেই যাচ্ছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ বিশ্ব রাজনীতির বর্তমান প্রেক্ষাপটে উচ্চ মূল্যস্ফীতিসহ নানাবিধ অর্থনৈতিক সংকটে ধুকছে উন্নতবিশ্বের দেশগুলো।
Advertisement
দ্য ইকোনমিস্ট বলছে, মূল্যস্ফীতির সঙ্গে লড়াই করতে রেকর্ড পরিমাণ নীতি সুদহার বাড়িয়েছে ইউরোপীয় সেন্ট্রাল ব্যাংক (ইসিবি), যদিও এবারের মূল্যস্ফীতি ঠিক চাহিদাজনিত নয়। তবে শুধু ইসিবি নয়, বিশ্বের প্রায় সব দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংই নীতি সুদহার বাড়িয়েছে।
এমনিতেই ইউরোপের বড় দেশগুলোতে মন্দাভাব বিরাজ করছে। তাছাড়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই রাশিয়ার ওপর একের পর এক নিষেধাজ্ঞা দিয়ে চলেছে ইউরোপ। এর জবাবে রাশিয়া ইউরোপে গ্যাস সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে।
ইউরোপে গ্যাস সরবরাহ কমিয়ে দেওয়াসহ রাশিয়ার বিভিন্ন কৌশলগত নীতির ফলে ইউরোপ আমেরিকাসহ বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই অর্থনৈতিক অস্থিরতা দেখা দেয়।
Advertisement
আপাতত ইউরোপে গ্যাস সরবারহ পুরোপুরি বন্ধ রেখেছে রাশিয়া। ফলে ইউরোপে গ্যাসসহ সব ধরনের জ্বালানির দাম আকাশ ছুঁয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব কিছুর জেরে ইউরোপজুড়ে ভয়াবহ মন্দা আসতে চলেছে।
এদিকে, ২০২১ সালের জুলাইয়ে আমেরিকা ও ইউরোপের অর্থনৈতিক নীতি-নির্ধারকরা মূল্যস্ফীতির ঝুঁকিকে অস্বীকার করেছিলেন। কিন্তু দক্ষিণ আমেরিকার দেশ চিলির কেন্দ্রীয় ব্যাংক সে সময়েই মূল্যস্ফীতি নিয়ে আগাম পূর্বাভাস দেওয়ার পাশাপাশি পরিস্থিতি নিয়ণ্ত্রণে আনতে বেশ জোরেশোরে কাজ শুরু করেছিল।
চিলির কেন্দ্রীয় ব্যাংক সে সময় সতর্ক করে বলেছিল, মূল্যস্ফীতি বাড়বে ও তার হার উচ্চ থাকবে। এরপরই দেশটির নীতিনির্ধারকরা সর্বসম্মতভাবে সুদের হার ০.৫% থেকে ০.৭৫% এ উন্নীত করার পক্ষে ভোট দেন।
এরপর থেকেই দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার বারবার বাড়িয়েছে। বর্তমানে দেশটিতে সুদের হার ১১.২৫ শতাংশ। সম্ভবত অন্যকোনো দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক মূদ্রাস্ফীতি নিয়ণ্ত্রণের মাধ্যমে মূল্য স্থিতিশীলতা আনতে এত বেশি তৎপরতা দেখায়নি।
Advertisement
চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে চিলির মূল্যস্ফীতি ১৪ শতাংশ বেড়ে যায়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, দেশেটিতে প্রতিবছর ১১ শতাংশ হারে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক শংকা, আগামী বছর দেশটির জিডিপিও সঙ্কুচিত হবে।
চিলির এ উদাহরণ একটি বিস্তৃত সমস্যার ইঙ্গিত দেয়। অনেকের মতে, যদি শুধু ফেডারেল রিজার্ভ, ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও অন্যরা গত বছর থেকেই সুদের হার বাড়াতো, তাহলে বিশ্বকে আজ উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে ভুগতে হতো না।
তবে চিলির এমন অভিজ্ঞতা ও অন্য যেসব দেশ পূর্বাভাস পেয়েই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কঠোর নীতি গ্রহণ করেছিল, সেসব দেশের ব্যর্থতা বিশেষজ্ঞদের ওই যুক্তিতে সন্দেহ জাগিয়েছে। পরিস্থিতি এমন হয়ে উঠেছে যে, সারাবিশ্বে মূল্যস্ফীতি কমানো ব্যাপকভাবে কঠিন হয়ে উঠছে।
সম্প্রতি চিলি সহ ব্রাজিল, হাঙ্গেরি, নিউজিল্যান্ড, নরওয়ে, দক্ষিণ কোরিয়া, পেরু ও পোল্যান্ডের মূল্যস্ফীতি পর্যালোচনা করেছে দ্য ইকোনমিস্ট। সেখানে এ দেশগুলোকে একত্রে বলা হচ্ছে হাইকল্যান্ডিয়া। রাশিয়াকেও এ দলে রাখা যেত, কিন্তু যুদ্ধের কারণে দেশটিকে এ তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে।
দ্য ইকোনমিস্টের তথ্য অনুযায়ী, ওই আটটি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো কমপক্ষে এক বছর আগে থেকে সুদের হার সর্বনিম্ন করার মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কঠোর অবস্থান নেয়।
চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত এসব দেশের কর্তৃপক্ষ সুদের হার প্রায় ছয় শতাংশ বাড়িয়েছে। যদি ২ নভেম্বরের মধ্যে দেশগুলো কেন্দ্রীয় রিজার্ভ ০.৭৫% হারে বাড়ায়, তাহলে গত বছরের তুলনায় পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসবে।
তবে আশ্চর্যজনকভাবে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর সিদ্ধান্তগুলো দেশগুলোর অর্থনীতিকে ধীরগতি করে দিয়েছে। বন্ধকী হার বেড়ে যাওয়ায় আটটি দেশের আবাসন খাত লোকশানের মুখে পড়েছে।
গোল্ডম্যান স্যাকসের তথ্য থেকে জানা যায়, দেশগুলোর অর্থনীতি বিশ্ব অর্থনীতির তুলনায় দুর্বল হয়ে পড়ছে ও দিনদিন খারাপ হচ্ছে। চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে দেশগুলোর অর্থনীতিতে কেন্দ্রীয় মূল্যস্ফীতি ছিল ৯.৫%, যা মার্চের থেকে ৩.৫% বেশি।
তাছাড়া, বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি এবং ওই আটটি দেশের মূল্যস্ফীতির ব্যবধান ক্রমেই বাড়ছে। জাতীয় পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, পরিস্থিতি আরও বেশি উদ্বেগজনক। সেপ্টেম্বরে শ্রম-নিবিড় পরিষেবাখাতে দক্ষিণ কোরিয়ার মূল্যস্ফীতির হার ছিল- বছরে ৪.২ শতাংশ, যা এ শতকের সর্বোচ্চ। অন্যদিকে, গত ছয় মাসে হাঙ্গেরির পরিষেবাখাতের মূল্যস্ফীতি ৭.২% থেকে বেড়ে ১১.৫% হয়েছে।
সেপ্টেম্বরে নরওয়ের ৮৯ শতাংশ দ্রব্যের দাম ২ শতাংশ হারে বেড়েছে। সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে পোল্যান্ডের ওপর গবেষণা চালিয়ে গোল্ডম্যান স্যাকসের অর্থনীতিবিদরা প্রমাণ পেয়েছেন, দেশটিতে অন্তর্নিহিত মুদ্রাস্ফীতির গতিবেগ আবারও বেড়েছে।
এসএএইচ/এএসএম