ফিচার

দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক ৫ ঝড়

ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে উত্তাল বঙ্গোপসাগর। সারাদেশে ভারি বৃষ্টির সঙ্গে হালকা দমকা হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। শুধু আমাদের দেশেই নয়, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও দেখা দিয়েছে সিত্রাংয়ের প্রভাব। ক্রমশই এগিয়ে আসছে দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গোপসাগর অভিমুখে। ভয়াবহ গতি সঞ্চয় করে আছড়ে পড়তে পারে এই সাইক্লোনটি। পায়রা সমুদ্রবন্দরে ৭ নম্বর বিপদ সংকেত দেখিয়ে যেতে বলছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।

Advertisement

এবারই প্রথম নয়, বাংলাদেশ এর আগে এমন অনেক বিধ্বংসী প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখে পড়েছে। ব্যাপক আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি সহ লাখ লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। দুর্যোগপ্রবণ বাংলাদেশে প্রতিবছর বন্যা, খরা দেখা দেয়। সেই সঙ্গে আছে জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড়, সাইক্লোনসহ আরও নানা দুর্যোগ। এসবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন দেশের উপকূলীয় এলাকার মানুষ।

চলুন জেনে নেওয়া যাক দেশের ইতিহাসে বিধ্বংসী ৫ ঝড় সম্পর্কে-

ঘূর্ণিঝড় সিডর২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর খুলনা-বরিশাল উপকূলীয় এলাকায় আঘাত হানে সিডর। শ্রীলংকান শব্দ সিডরের অর্থ চোখ। এসময়ে এর বাতাসের বেগ ছিল ঘণ্টায় ২৬০ কি.মি. এবং ঘণ্টায় ৩০৫ কি.মি.বেগে দমকা হাওয়া বইছিল। একারণে সাফির-সিম্পসন স্কেল অনুযায়ী একে ক্যাটেগরি-৫ মাত্রার ঘূর্ণিঝড় আখ্যা দেওয়া হয়। রেডক্রসের হিসাবে সিডরে ১০ হাজার মানুষ মারা গেছে বলা হলেও সরকারিভাবে এই হিসাব ৬ হাজার। তবে কিছু ধারণা অনুযায়ী এই সংখ্যা ১৫ হাজারে পৌঁছেছিল। বাংলাদেশ সরকার এ ঘটনাকে জাতীয় দূর্যোগ বলে ঘোষণা করে।

Advertisement

ঘূর্ণিঝড় আইলা ২০০৯ সালের ২৫ মে পশ্চিমবঙ্গ-খুলনা উপকূলীয় এলাকায় আঘাত হানা প্রবল ঘূর্ণিঝড় আইলা, যার বাতাসের গতিবেগ ছিল ৭০-৯০ কিলোমিটার পর্যন্ত। এর ব্যাস ছিলো প্রায় ৩০০ কিলোমিটার, যা ঘূর্ণিঝড় সিডরের থেকে ৫০ কিলোমিটার বেশি। সিডরের মতোই আইলা প্রায় ১০ ঘণ্টা সময় নিয়ে উপকূল অতিক্রম করে। পটুয়াখালী, বরগুনা, ভোলা, বরিশাল, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালীর হাতিয়া, নিঝুম দ্বীপ, খুলনা ও সাতক্ষীরা জেলায় জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করে।আইলার প্রভাবে নিঝুম দ্বীপ এলাকার সকল পুকুরের পানিও লবণাক্ত হয়ে পড়ে। জলোচ্ছ্বাস ও লোনা পানির প্রভাবে, গবাদি পশুর মধ্যে কমপক্ষে ৫০০ গরু ও ১,৫০০ ছাগল মারা যায়। কমপক্ষে ৩ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত এবং খুলনা ও সাতক্ষীরায় প্রাণ হারান ১৯৩ জন মানুষ।

দ্য গ্রেট বাকেরগঞ্জ সাইক্লোন১৮৭৬ সালে একটি প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় সংঘটিত হয় বাকেরগঞ্জে। বরিশাল জেলার একটি উপজেলা হিসেবে পরিচিত হলেও বাকেরগঞ্জ ছিল ব্রিটিশ আমলের একটি জেলা। অক্টোবরের শেষ দিন অথবা নভেম্বরের ১ তারিখ এই প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে এই এলাকায়। ঐ ঝড়ে প্রাণ হারান ২ লাখ মানুষ। গবাদিপশুর মৃত্যুর হার, ফসল এবং অন্যান্য সম্পদহানির ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বিবেচনা করে এই ঝড়কে বলা হয় ‘দ্য গ্রেট বাকেরগঞ্জ সাইক্লোন’।

ভোলা সাইক্লোন৫০ বছর আগে দেশের ইতিহাসে স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ এক সাইক্লোন আছড়ে পড়েছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ভোলায়। ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর প্রলয়ংকরী সেই ঝড়ের আঘাতে ভোলা তছনছ হয়ে যায়। একের পর এক লোকালয় মাটির সাথে মিশে যায়। তীব্র জলোচ্ছ্বাসের তোড়ে ভেসে যায় হাজার-হাজার মানুষ, যাদের অনেকেরই আর কোন খোঁজ মেলেনি। এই অঞ্চলের ইতিহাসে ভোলা ঘূর্ণিঝড় ছিল অন্যতম মারাত্মক প্রাকৃতিক দুর্যোগ।

এই ঝড় ‘ভোলা সাইক্লোন’ নামে পরিচিত। এটির গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১৮৫ কিলোমিটার বা ১১৫ মাইল। জলোচ্ছ্বাসের সর্বোচ্চ উচ্চতা ছিল প্রায় ১০-৩৩ ফুট। এই গতিতেই এটি উপকূলে আঘাত করে। দক্ষিণ উপকূলীয় অঞ্চল ও দ্বীপগুলো প্লাবিত হয়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় চট্টগ্রাম, বরগুনা, খেপুপাড়া, পটুয়াখালী, চর বোরহানউদ্দিন, চর তজুমদ্দিন, মাইজদী ও হরিণঘাটায়।

Advertisement

সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা ছিল ভোলার তজুমদ্দিন উপজেলা। তজুমদ্দিনের তখনকার জনসংখ্যা ১ লাখ ৬৭ হাজারের মধ্যে ৭৭ হাজার জন প্রাণ হারায় সে ঝড়ে। মনপুরা এলাকার ২২ হাজার মানুষের মধ্যে ১৬ হাজার মানুষই মারা গিয়েছিলেন। সরকারি হিসাবমতে, এই সাইক্লোনে মারা যায় প্রায় ৩ লাখ মানুষ। আর বেসরকারি মতে এ সংখ্যা আনুমানিক ৫ লাখ। ১০ লাখের বেশি গবাদিপশুর মৃত্যু, প্রায় ৪ লাখ ঘরবাড়ি এবং ৩ হাজার ৫০০ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

১৯৯১ সালের প্রলয়ংকরী ঝড়বাংলাদেশের ইতিহাসে আরেকটি ধ্বংসাত্মক ঝড় আঘাত হানে ১৯৯১ সালের ২২ এপ্রিল। এদিন মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে বঙ্গোপসাগরে একটি গভীর নিম্নচাপের সৃষ্টি হয়। ২৪ এপ্রিল নিম্নচাপটি ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেয় এবং উত্তর-পূর্ব দিকে অগ্রসর হতে থাকে। অগ্রসর হওয়ার সময় এটি আরও শক্তিশালী হয়। ২৮ ও ২৯ এপ্রিল এটির তীব্রতা বৃদ্ধি পায় এবং এর গতিবেগ পৌঁছায় ঘণ্টায় ১৬০ মাইলে। ২৯ এপ্রিল রাতে এটি চট্টগ্রামের উপকূলবর্তী অঞ্চলে ঘণ্টায় ১৫৫ মাইল বেগে আঘাত করে। এই ঝড়ে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সন্দ্বীপ, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, কুতুবদিয়া, খেপুপাড়া, ভোলা, টেকনাফসহ ১৯ জেলার ১০২টি উপজেলা। এই ঝড়ে মারা যান ১ লাখ ৩৮ হাজার ৮৮২ জন মানুষ। আহত হয় আরও কয়েক লাখ। প্রায় ১ কোটি মানুষ তাদের সর্বস্ব হারায় এই ঘূর্ণিঝড়ে।

কেএসকে/এমএস