ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে বঙ্গোপসাগরে গভীর নিম্নচাপের সৃষ্টি হয়েছে। এর ফলে রোববার (২৩ অক্টোবর) দিনভর উপকূলীয় জেলা খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটের আকাশ ছিল মেঘাচ্ছন্ন। কোথাও কোথাও গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে।
Advertisement
এদিকে, উপকূলীয় এলাকার নদ-নদীতে জোয়ারের পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় বেড়িবাঁধ ভেঙে যাওয়ার আতঙ্কে আছেন ওই এলাকার কয়েক লাখ মানুষ। বিশেষ করে খুলনার কয়রা, পাইকগাছা, সাতক্ষীরার আশাশুনি ও শ্যামনগর উপজেলার বেড়িবাঁধগুলো বেশি ঝুঁকিপূর্ণ বলে জানা গেছে।
খুলনা আবহাওয়া অফিস সূত্রে জানা গেছে, ঘূর্ণিঝড়টি মোংলা সমুদ্রবন্দর থেকে ৭৩০ এবং পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে ৬৯৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থান করছে। এটি সোমবার বিকেল নাগাদ খুলনা উপকূলে আঘাত হানতে পারে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অফিস।
খুলনা জেলা প্রশাসন সূত্র জানিয়েছে, প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রাণহানি এড়াতে জেলার ২ লাখ ৭৩ হাজার ৮৫০ জনের জন্য ৪০৯টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
Advertisement
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, খুলনার কয়রা, পাইকগাছা, দাকোপ, বাগেরহাটের মোংলা, শরণখোলা, মোরেলগঞ্জ, কচুয়া, রামপাল, সাতক্ষীরার শ্যামনগর, আশাশুনি উপজেলায় গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। কোথাও কোথাও ভারী বৃষ্টির খবরও পাওয়া গেছে। উপকূলীয় উপজেলাগুলোর নদীতে পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। বাঁধ রয়েছে ঝুঁকিপূর্ণ।
কয়রা উপজেলার ভাঙনকবলিত উত্তর বেদকাশী এলাকার বাসিন্দা আব্দুল কুদ্দুস বলেন, কোনো দুর্যোগ এলে তা সবার আগে কয়রা উপকূলে আঘাত হানে। সিডর, আইলা, বুলবুলের আঘাতে এই এলাকার মানুষ চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এখন যদি সিত্রাং আঘাত করে তাহলে বেঁচে থাকা দায় হয়ে পড়বে।
উত্তর বেদকাশীর আশরাফুল ইসলাম নুর বলেন, গত দুই মাস আগে জোয়ারের পানিতে বেড়িবাঁধ ভেঙে বেশ কয়েকটি গ্রাম প্লাবিত হয়। সেই বাঁধ এখনো ঠিকভাবে মেরামত হয়নি। সিত্রাংয়ের প্রভাবে নদ-নদীর পানি বাড়লে আবারও বাঁধ ভাঙার সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে এলাকাবাসীর রাতের ঘুম উধাও হয়ে গেছে।
খুলনার কয়রা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এস এম শফিকুল ইসলাম বলেন, কয়রায় অনেক স্থান ঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে। এর মধ্যে হোগলা, দোশহালিয়া, মদিনাবাদ লঞ্চঘাট, ঘাটাখালী, গাববুনিয়ার, আংটিহারা, ৪ নম্বর কয়রা সুতির গেট ও মঠবাড়ির পবনা নিয়ে বেশি চিন্তিত। প্রত্যেক ইউনিয়নের চেয়ারম্যানদের নিজ এলাকার বাঁধের দিকে খেয়াল রাখতে বলা হয়েছে। আর আশ্রয়কেন্দ্রগুলো প্রস্তুত করা হচ্ছে।
Advertisement
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা যায়, খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলায় বেড়িবাঁধ রয়েছে মোট ১ হাজার ৯১০ কিলোমিটার। ষাটের দশকে মাটি দিয়ে তৈরি এই বেড়িবাঁধ ছিল ১৪ ফুট উঁচু ও ১৪ ফুট চওড়া। এখন এই বেড়িবাঁধের উচ্চতা ও চওড়ার অর্ধেকও অবশিষ্ট নেই।
পানি উন্নয়ন বোর্ড খুলনার নির্বাহী প্রকৌশলী আশরাফুল আলম বলেন, পাইকগাছা, বটিয়াঘাটা ও দাকোপে প্রায় সাত থেকে আট কিলোমিটার বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। এর মধ্যে আন্ধারমানিক ও সোলাদানা পয়েন্টে মেরামত কাজ শুরু হয়েছে। এছাড়া দাকোপের ৩১ নম্বর পোল্ডারে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণে ফিজিবিলিটি স্ট্যাডি চলমান।
সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড-২ এর আওতায় রয়েছে খুলনার কয়রা উপজেলা। সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড-২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শাহানেওয়াজ তালুকদার বলেন, আমরা কয়রায় অবস্থান করছি। সার্বক্ষণিক তদারকি করা হচ্ছে।
খুলনা-৬ (কয়রা-পাইকগাছা) আসনের সংসদ সদস্য মো. আক্তারুজ্জামান বাবু বলেন, ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং দ্রুত বেগে ধেয়ে আসছে। এই ঝড়কে মোকাবিলা করার জন্য কয়রা ও পাইকগাছা উপজেলার নির্বাহী অফিসার, উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান, স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাদের সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। তারা সার্বক্ষণিক যোগাযোগের মাধ্যমে ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধগুলোতে নজর রাখছেন।
তিনি বলেন, সাইক্লোন শেল্টারের পাশাপাশি যেসব বহুতল স্কুল-কলেজ রয়েছে সেগুলোও প্রস্তুত রাখার জন্য বলা হয়েছে। সেখানে শুকনা খাবারের ব্যবস্থাও করা হয়েছে। উপকূলের বাসিন্দারা যেন আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে না পড়ে সেজন্য সব চেষ্টাই করা হচ্ছে।
খুলনার জেলা প্রশাসক মো. মনিরুজ্জামান তালুকদার জানান, ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। জরুরি শুকনা খাবার প্রস্তুত রাখা, সাইক্লোন শেল্টারে যারা আসবে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, আগতদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার জন্য কাজ চলছে।
তিনি বলেন, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা হচ্ছে। যারা ঝুঁকির মধ্যে আছে, তাদের যাতে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া যায়-সেজন্য সবাইকে সতর্ক থাকার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
রোববার বিকেলে খুলনা আবহাওয়া অফিসের ইনচার্জ সিনিয়র আবহাওয়াবিদ মো. আমিরুল আজাদ বলেন, সাগরে নিম্নচাপ সৃষ্টি হয়েছে। সকাল থেকে উপকূল এলাকা মেঘলা রয়েছে। সেই সঙ্গে হালকা বৃষ্টি হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, সন্ধ্যার পর সিত্রাং ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হতে পারে। এটা এখনো ঘূর্ণিঝড়ে রূপান্তরিত হয়নি। তবে খুলনাসহ উপকূলীয় এলাকায় এর প্রভাব শুরু হয়েছে। মঙ্গলবার সকালে উপকূলীয় এলাকা অতিক্রম করতে পারে। এর প্রভাবে আজ রাতে ভারী বৃষ্টি হতে পারে।
বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট গভীর নিম্নচাপটি রোববার রাতে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ে রূপ নেবে। তাই বঙ্গোপসাগরে অবস্থান করা মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারকে শিগগির নিরাপদে সরে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
আলমগীর হান্নান/এমআরআর/জিকেএস