জাতীয়

গ্যাস সংকটে দিনের রান্না রাতে, ক্লান্তির ঘুমে বাধা লোডশেডিং

রাজধানীর পুরান ঢাকার লালবাগের বাসিন্দা গৃহবধূ মিলি খন্দকার। স্বামী হাসনাইন খন্দকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা। প্রতিদিন ভোরে উঠে ফজরের নামাজ আদায় করেন। এরপর অফিসগামী স্বামী ও দুই সন্তানের জন্য নাস্তা তৈরি করেন। এই ছিল তার প্রতিদিন সকালের রুটিন কাজ। কিন্তু সম্প্রতি গ্যাস সংকট ও লোডশেডিংয়ের কারণে সেই রুটিনে ছন্দপতন ঘটেছে। দিনে ৬-৭ ঘণ্টা লোডশেডিং ও ভোর থেকে গ্যাস না থাকায় জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে মিলি খন্দকারের। শুধু মিলি খন্দকারের নয়, আরও অনেকের জীবনেই প্রভাব ফেলেছে গ্যাস সংকট ও লোডশেডিং।

Advertisement

জাগো নিউজের সঙ্গে আলাপকালে মিলি খন্দকার ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, রাতে কয়েক দফা লোডশেডিংয়ের কারণে ঘুম ভেঙে যায়। ফলে ভোরে সময়মতো কেউ ঘুম থেকে উঠতে পারে না। গ্যাস না থাকায় রান্নার চুলা জ্বলে না। এ কারণে অফিসগামী স্বামীকে কোনো কোনো দিন নাস্তা না করেই বের হতে হয়। রান্না করতে না পারার কারণে বাইরে থেকে স্বামী সন্তানদের জন্য নাস্তা কিনে আনতে হয়।

তিনি আরও, সারাদিন পরিশ্রম করতে হয়। রাতে ঘুমাতে যাওয়ার সময় রান্নাঘরে ঢুকতে হয়। কারণ গ্যাস আসে রাত ১২টার পর। আবার সকাল হওয়ার আগে চলে যায়। দিনে গ্যাস থাকে না বললেই চলে। দু-এক ঘণ্টা থাকলেও গ্যাসের যে চাপ থাকে, তাতে পানিও গরম হয় না। দিনের রান্না গভীর রাতে করে যখন ঘুমাতে যাই, ক্লান্তিতে যখন চোখ দুটো বন্ধ হয়ে আসে, ঠিক তখনই লোডশেডিং শুরু। সারারাত ও ভোর মিলিয়ে দু-তিনবারও লোডশেডিং হয়। এ যন্ত্রণা থেকে কবে মুক্তি মিলবে? প্রশ্ন মিলি খন্দকারের।

আরও পড়ুন: লোডশেডিংয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে জনভোগান্তি

Advertisement

এ প্রশ্ন শুধু গৃহবধূ মিলি খন্দকারের নয়, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার অসংখ্য মানুষেরই। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে এমনিতেই ‘নুন আনতে পান্তা ফুরানোর’ দশা। তার ওপর ঘন ঘন লোডশেডিং ও গ্যাস সংকটে রাজধানীর পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় সময়মতো রান্না হচ্ছে না। কেউ কেউ বাজেটের অতিরিক্ত খরচে গ্যাস সিলিন্ডার কিনে রান্না-বান্নার কাজ সারছেন।

পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দারা অভিযোগ করে বলেন, গ্রীষ্মকালেই যদি গ্যাসের এমন সংকট দেখা দেয় তবে শীতকাল এলে তো গ্যাসই থাকবে না। কারও কারও অভিযোগ, গ্যাস সিলিন্ডার কোম্পানিগুলোকে মোটা অঙ্কের ব্যবসা করিয়ে দিতে সুকৌশলে গ্যাসের কৃত্রিম সংকট তৈরি করা হচ্ছে।

রাজধানীর পুরান ঢাকার আগাসাদেক রোডের বাসিন্দা লোকমান হোসেন বলেন, দিন-রাতে মিলিয়ে মোট ছয়বার বিদ্যুৎ থাকে না। প্রতিবার গেলে ঠিক এক ঘণ্টা পর আসে। দিনে লোডশেডিং কোনোভাবে সহ্য করতে পারলেও গভীর রাতে লোডশেডিং ঘুমের বারোটা বাজিয়ে দেয়। ঘুম ভেঙে যাওয়ায় ছোট শিশুরা কান্নাকাটি করে। এ অবস্থা থেকে কবে পরিত্রাণ মিলবে- সে প্রশ্নও করেন লোকমান হোসেন।

আরও পড়ুন: লোডশেডিং মিউজিয়াম থেকে কীভাবে বেরিয়ে এলো, প্রশ্ন মোশাররফের

Advertisement

এদিকে নগরবাসী কবে এই ভোগান্তি থেকে মুক্তি পাবেন কেউ তার সদুত্তর দিতে পারেনি। সরকারের একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা অসহায়ত্ব প্রকাশ করে বলেছেন, শিগগির গ্যাস ও বিদ্যুতের সমস্যার সমাধান হচ্ছে না।

রোববার (২৩ অক্টোবর) এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদবিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বলেছেন, ‘আমাদের রিজার্ভের যে অবস্থা, আমরা জানি না সামনে কী হবে। এলএনজি এখন আমরা আনছি না। এ সময়ে ২৫ ডলার হিসাব ধরেও যদি এলএনজি আমদানি করতে যাই, চাহিদা মেটাতে অন্তত ছয় মাস কেনার মতো অবস্থা আছে কি না- জানি না। আমাদের এখন সাশ্রয়ী হওয়া ছাড়া উপায় নেই। প্রয়োজনে দিনেরবেলা বিদ্যুৎ ব্যবহার বন্ধই করে দিতে হবে।’

বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ডের (বিপিডিবি) তথ্য অনুযায়ী, দেশের ৫২ শতাংশ বিদ্যুৎকেন্দ্র গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল। আর জ্বালানি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, দেশে মোট গ্যাসের ব্যবহারের ৭০ শতাংশই বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজে ব্যবহৃত হয়।

আরও পড়ুন: রিজার্ভের যে অবস্থা, দিনে বিদ্যুৎ ব্যবহারই করবো না: তৌফিক-ই-ইলাহী

রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান পেট্রোবাংলা জানিয়েছে, আন্তর্জাতিক স্পট মার্কেটে এলএনজির (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) দাম বাড়ায় সরকার সেখান থেকে আমদানি বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ফলে কয়েকদিন ধরে জাতীয় গ্যাস-সাপ্লাই গ্রিডে এলএনজির সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে।

এদিকে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা বলছেন, গ্যাস-বিদ্যুতের সংকটের কারণে ৬০ শতাংশ বস্ত্রকল ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। দ্রুত সংকট সমাধান করে নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহ করা না হলে অনেক শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে যাবে। চাকরি হারাবেন শ্রমিকরা। ব্যাংকও তাদের পুঁজি হারাবে। গ্যাসের সংকট আরও বাড়বে।

এমইউ/ইএ/জিকেএস