# গ্যাস সরবরাহ কম থাকায় উৎপাদন কমে অর্ধেকের নিচে# দেশি কারখানা থেকে টিসিবির চিনি সংগ্রহও সংকটের কারণ# ‘র’ সুগার আমদানিতেও রয়েছে সংকট
Advertisement
দেশের বৃহৎ পাইকারি বাজার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে এখন টাকা দিয়েও মিলছে না চিনি। চাহিদার অনুপাতে জোগান কম হওয়ায় চরম সংকট তৈরি হয়েছে চিনির সরবরাহ চেইনে। এতে হু হু করে বাড়ছে অন্যতম এ ভোগ্যণ্যের দাম। ১০ দিনের ব্যবধানে প্রতি মণ চিনিতে বেড়েছে ৩০০-৩৫০ টাকা। ব্যবসায়ীরা বলছেন, সরকার গ্যাসে রেশনিং করার কারণে শিল্পে গ্যাস সরবরাহ কমায় চিনির উৎপাদনে ধস নেমেছে। আবার নিত্যপণ্যের বাজারমূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে সরকার টিসিবির জন্য চিনি সংগ্রহ করছে স্থানীয় বাজার থেকে। এতে চাহিদার সঙ্গে জোগানের দূরত্ব বাড়ছে। ডলার সংকটে আমদানি কম হওয়াকেও দায়ী করছেন উৎপাদকরা।
বাজারে চিনির সংকট যেমন সাধারণ ভোক্তা পর্যায়ে প্রভাব তৈরি করছে, তেমনি খাদ্যপণ্য তৈরিতেও তৈরি করছে নেতিবাচক প্রভাব। স্বাভাবিক হিসাবে দেশে প্রায় ২০ লাখ টন চিনির চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে রাষ্ট্রীয় ১৫ চিনি কল থেকে বছরে আসে ৩০ হাজার টনের চেয়ে কম পরিশোধিত চিনি। যে কারণে বেসরকারি পর্যায়ে সিংহভাগ চিনি আমদানি করে দেশের চাহিদা মেটাতে হয়। এজন্য প্রায় ২২ লাখ টনের বেশি ‘র’ সুগার আমদানি করে সিটি গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপ, আবদুল মোনেম কোম্পানি, দেশবন্ধু সুগার এবং এস আলম সুগার ইন্ডাস্ট্রিজ।
বেসরকারি পর্যায়ে আমদানি করে নিজেদের কারখানায় রিফাইন করে তারা বাজারে বিক্রি করছে। চিনির বাজারে প্রায় ৪০ শতাংশের কাছাকাছি অংশীদারত্ব রয়েছে সিটি গ্রুপের, ৩১ শতাংশের বেশি বাজার রয়েছে মেঘনা গ্রুপের ফ্রেশ চিনির। তাছাড়া আবদুল মোনেম কোম্পানির প্রায় ১১ শতাংশ, দেশবন্ধু সুগারের ৯ শতাংশ ও চট্টগ্রামের এস আলম গ্রুপের রয়েছে ৯ শতাংশের মতো বাজার।
Advertisement
খাতুনগঞ্জের আড়তদার ও ডিও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত ১০ দিনের ব্যবধানে প্রতি মণ চিনির দাম বেড়েছে ৩০০-৩৫০ টাকা। আবার নগদ টাকা দিয়েও চাহিদামাফিক রেডি চিনি মিলছে না। ডিও কিনে কারখানার গেটে অবস্থানের পর মিলছে চিনি। এর মধ্যে এস আলমের চিনির ডিও কিনে কারখানা থেকে সরবরাহ পেতে দু-তিন দিন সময় লাগছে। চিনির বড় বাজার যাদের দখলে সেই সিটি ও মেঘনা গ্রুপের চিনি পেতে কারখানার সামনে অবস্থান করতে হচ্ছে ১৫ দিনের মতো। বিশেষ করে গ্যাস সংকটের কারণে কারখানার উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় চিনিতে প্রভাব পড়ছে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।
খাতুনগঞ্জের ডিও ব্যবসায়ী মো. করিম জাগো নিউজকে বলেন, বর্তমানে বাজারে সামান্য কিছু রেডি চিনি রয়েছে। তা চাইলেও এক থেকে দুই টনের বেশি পাওয়া যাচ্ছে না। ঢাকায় দেশবন্ধুর রেডি চিনি থাকলেও প্রতি মণ ৩৭শ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বাজারে শনিবার দুপুরে এস আলমের ডিও বিক্রি হয়েছে প্রতি মণ ৩ হাজার ৬৭০ টাকায়। এগুলো ইছানগর কারখানা থেকে ডেলিভারি নিতে দু-তিন দিন লাগছে। আবার ঢাকার সিটি ও মেঘনার চিনি ডেলিভারি পেতে লাগছে ১৫ দিনের মতো।
আরেক ডিও ব্যবসায়ী সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘শনিবার খাতুনগঞ্জে সিটি ও ফ্রেশ চিনির ডিও বিক্রি হয়েছে ৩ হাজার ৪৭৫ টাকায়। কিন্তু ডেলিভারি অনেক দেরিতে। ১০ দিন আগেও বাজারে দাম ৩০০-৩৫০ টাকা কম ছিল। এখন বাজারে রেডি চিনি মিলছে না। চাইলেও টাকা দিয়ে এক ট্রাক রেডি চিনি ম্যানেজ করা সম্ভব হচ্ছে না।’
ঢাকার চট্টলা ট্রান্সপোর্টের মালিক মিজানুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘সিটি ও মেঘনা চিনি মিলে আজ (শনিবার) গাড়ি দিলে ডেলিভারি পাওয়া যাচ্ছে ৫ নভেম্বর। যারা এই সময় মানছেন তারা সিটি ও মেঘনা মিলে গাড়ি পাঠাচ্ছেন।’
Advertisement
তবে খাতুনগঞ্জের আড়তদার ব্যবসায়ী বলছেন, গ্যাসের কারণে বড় বড় মিলে চিনি উৎপাদন হচ্ছে না।
খাতুনগঞ্জের চিনির আড়তদার ব্যবসায়ী ইমাম শরীফ ব্রাদার্সের মালিক মো. আকবর জাগো নিউজকে বলেন, ‘বাজারে চাহিদা অনুযায়ী যোগান না থাকলেও নিয়ম অনুযায়ীই দাম বেড়ে যাবে। আগে ঢাকার প্রত্যেক মিল দিনে ২শ গাড়ি করে চিনি ডেলিভারি দিতো। এখন তারা ৫০ গাড়িও দিতে পারছে না। কিন্তু মানুষতো চিনি খাওয়া ছেড়ে দেয়নি। চিনির চাহিদা কখনো কমবে না। যোগান কমে গেলেই সংকট তৈরি হবে। এখন বাজারে চিনির যোগান সংকট রয়েছে। তাছাড়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ডলারের দাম বৃদ্ধিসহ নানান বৈশ্বিক কারণেও চিনি আমদানিতে প্রভাব তৈরি করছে। ফলে বাজারে সংকট তৈরি হচ্ছে, দামও বাড়ছে।’
খাতুনগঞ্জে তেল-চিনির বড় ব্যবসায়ী আর এম এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী আলমগীর পারভেজ জাগো নিউজকে বলেন, ‘কারখানাগুলোতে গ্যাসের সরবরাহ কমে যাওয়ায় তারা চিনির উৎপাদন স্বাভাবিক রাখতে পারছে না। আগে দিনে ৫শ ট্রাক চিনি বাজারে আসতো। এখন দুইশ ট্রাকও আসছে না। যে কারণে চিনির সংকট তৈরি হচ্ছে, বাজারে দাম বাড়ছে।’
এই ব্যবসায়ী আরও বলেন, ‘শুধু গ্যাস সংকট নয়। সরকার টিসিবির মাধ্যমে ভর্তুকিমূল্যে বাজারে চিনি বিক্রি করছে। কিন্তু টিসিবি এসব চিনি সংগ্রহ করছে দেশি কারখানাগুলো থেকে। এতে চিনির যোগান সংকট কাটছে না। তারা বিদেশ থেকে চিনি আমদানি করে বাজারে ছাড়লে এ সংকট অনেকটা সামাল দেওয়া যেত।’
কথা হলে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিবিসি) তথ্য প্রদানকারী কর্মকর্তা মো. হুমায়ুন কবির জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা উন্মুক্ত টেন্ডারের মাধ্যমে চিনি সংগ্রহ করি। ট্রেন্ডারে সর্বনিম্ন দরদাতার কাছ থেকে এসব চিনি সংগ্রহ করা হয়। বর্তমানে এস আলম, সিটি ও মেঘনা গ্রুপ থেকে চিনি সংগ্রহ করা হচ্ছে। একেকটি কার্যাদেশ তিন-পাঁচ হাজার টনের হয়।’
গ্যাসের সংকট বাদেও ডলার সংকটসহ আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেশি এবং আমদানিতে শুল্ক বেশি হওয়া চিনির দাম বাড়ার প্রভাবক হিসেবে কাজ করছে বলে মনে করছেন উৎপাদন সংশ্লিষ্টরা।
বেসরকারি চিনি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান আবদুল মোনেম কোম্পানির বাণিজ্যিক বিভাগের প্রধান আজিজুর রহমান চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, বর্তমানে কয়েকটি কারণে বাজারে দাম বাড়ছে। গ্যাসের কারণে কারখানার উৎপাদন স্বাভাবিক রাখা যাচ্ছে না। বর্তমানে যে গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে তাতে ৫০ শতাংশ উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে না। এতে যোগানে সমস্যা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে চিনির বুকিং রেটও এখন বেশি। গত মাসে মাত্র একটি জাহাজ এসেছে।
তিনি আরও বলেন, ‘এখন ডলার সংকটও আরেকটি কারণ। আমরা বিগত কয়েক মাসে কোটি কোটি টাকা লোকসান দিয়েছি।’
এএসএ/এমএস