‘দিনে একটি আপেল খান/রোগমুক্ত জীবন পান’ বা ‘প্রতিদিন আপেল খান/বাড়ি থেকে ডাক্তার তাড়ান’। বাংলায় এ প্রবাদটি এসেছে ইংরেজি প্রবাদ ‘An apple a day keeps the doctor away’ থেকে। ইংরেজিতে ১৯২২ সালে এই প্রবাদ প্রথম ব্যবহৃত হয়েছিল বলে রেকর্ড আছে।
Advertisement
তবে, এটি আসল ইংরেজি প্রবাদ নয়। আসল প্রবাদের অস্তিত্ব পাওয়া যায় ঊনবিংশ শতকের ওয়েলসে। তখন প্রবাদটির রূপ ছিল এমন: Eat an apple on going to bed, and you’ll keep the doctor from earning his bread (একটি আপেল খেয়ে ঘুমাতে যাও/ডাক্তারের রুটি-রুজির বারোটা বাজাও)। বিংশ শতকের গোড়ার দিকে বিবর্তিত হয়ে প্রবাদের রূপ দাঁড়ায়: ‘an apple a day, no doctor to pay’ (আপেল খান প্রতিদিন একটি/বাঁচিয়ে রাখুন ডাক্তারের ফি) বা ‘an apple a day sends the doctor away’ (প্রতিদিন আপেল খেলে পরে/ডাক্তার মশায় থাকবেন অনেক দূরে)।
আপেল সম্পর্কে এ প্রবাদের উৎপত্তির কারণ এর পুষ্টিগুণ। কী নেই আপেলে! মিষ্টি এই ফলটির ৮০ শতাংশই পানি, যা মানব স্বাস্থ্যের জন্য কল্যাণকর। আরও আছে: খাদ্যশক্তি, শর্করা, চিনি, খাদ্যআঁশ, চর্বি, আমিষ, ভিটামিন এ, ক্যারোটিন, লুটেইন, থায়ামিন (বি ওয়ান), রিবোফ্লাবিন (বি টু), নিয়াসিন (বি থ্রি), প্যানটোথেনিক অ্যাসিড (বি ফাইভ), ফোলেট (বি নাইন), ভিটামিন সি, ভিটামিন ই, ভিটামিন কে, ক্যালসিয়াম, আয়রন, ম্যাগনেসিয়াম, ম্যাংগানিজ, ফসফরাস, পটাশিয়াম, সোডিয়াম, জিংক ইত্যাদি।
আপেলের অনেক গুণ
Advertisement
এর মধ্যে লাল আপেলের তুলনায় সবুজ আপেলের পুষ্টিগুণ বেশি। সবুজ আপেল হাড় শক্ত করে, কোলন ক্যানসার প্রতিরোধ করে, বিপাক ক্ষমতা বাড়ায়, রক্তের ক্ষতিকর কোলেস্টেরল কমায়, লিভার সুস্থ রাখে, রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। সবুজ আপেল ক্ষেতে অবশ্য লাল আপেলের তুলনায় কম মজা। তাতে কী! স্বাস্থ্যের জন্য ভালো হলেই হলো।
আপেলের উৎপত্তি মধ্য এশিয়ায় বলে ধারণা করা হয়। কারণ, এতদঞ্চলে আজও আপেলের পূর্বতন বুনো প্রজাতির অস্তিত্ব আছে। হাজার হাজার বছর ধরে এশিয়া ও ইউরোপে আপেলের চাষ হয়ে আসছে। লাতিন আমেরিকায় আপেল গেছে ইউরোপীয় বসতি স্থাপনকারীদের হাত ধরে। বিশ্বজুড়ে আপেলের প্রায় সাড়ে ৭ হাজার প্রজাতি রয়েছে।
হিম বা ফ্রস্ট
বিশ্বে প্রতি বছর উৎপাদিত আপেলের প্রায় অর্ধেকটাই উৎপন্ন হয় চীনে। ২০১৮ সালের একটি হিসাব আমার হাতের কাছে আছে। সে বছর বিশ্বে মোট আপেল উৎপন্ন হয়েছিল ৮ কোটি ৬০ লাখ টনের বেশি। এর অর্ধেক তথা ৫০ শতাংশ উৎপন্ন হয় চীনে। আর তুরস্কসহ গোটা ইউরোপ মিলে উৎপাদন করেছে প্রায় ১৭ শতাংশ আপেল। উল্লেখযোগ্য আপেল উৎপাদক-দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের নামও আসবে।
Advertisement
বিশ্বে সবচেয়ে বেশি আপেল খায় চীনারা। তারা আপেল পছন্দও করে। এদেশে নানান রঙের, নানান ধরনের আপেল বছরজুড়েই পাওয়া যায়। এর মানে, চীনারা বছরজুড়েই আপেল খায়। তবে, একটি বিশেষ দিনে বিশেষভাবে আপেল খাওয়ার কথা বলে চীনের ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসাবিদ্যা। এই দিনটি হচ্ছে চীনের অষ্টাদশ সৌরপদের প্রথম দিন।
পার্সিমন
পাঠক জানেন, চীনের চান্দ্রপঞ্জিকা অনুসারে বছরকে ভাগ করা হয় ২৪টি সৌরপদে। প্রাচীন চীনে হলুদ নদীর অববাহিকায় এই ২৪ সৌরপদের উৎপত্তি। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এই ২৪ সৌরপদ ‘চীনের পঞ্চম মহান আবিষ্কার’ হিসেবে স্বীকৃত। ইউনেস্কোও একে মানবজাতির অবৈষয়িক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
প্রতিটি সৌরপদের আছে ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য। চীনে হাজার হাজার বছর আগে এই সৌরপদ-ব্যবস্থার উৎপত্তি। প্রাচীনকাল থেকেই চীনারা সৌরপদ অনুসারে নিজেদের দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড, বিশেষ করে কৃষিকাজ আঞ্জাম দিয়ে আসছে। বছরের কোন সৌরপদে আবহাওয়া কেমন থাকবে—তা নাম দেখলেই আন্দাজ করা যায়। সৌরপদ অনুসারে চীনারা তাদের খাওয়া-দাওয়ায়ও পরিবর্তন আনে, পরিবর্তন আনে পোশাক-আশাকে।
নাশপাতি
চীনের অষ্টাদশ সৌরপদের নাম শুয়াং চিয়াং। চীনা ভাষায় ‘শুয়াং’ মানে ‘হিম’ (frost) এবং ‘চিয়াং’ মানে ‘ঝরা’। তবে, ‘চিয়াং’ অর্থ ‘বিন্দু’ বা ‘ফোঁটা’ও হয়। বস্তুত শুয়াং চিয়াং সৌরপদে প্রকৃতিতে প্রথম ‘হিম’ বা ফ্রস্ট দেখা দেয়। স্নো (তুষার) ও ফ্রস্টের (হিম) মধ্যে একটা ছোট্ট পার্থক্য আছে। দুটোই বায়ুর জলীয় বাষ্প থেকে উত্পন্ন হয়। তুষার বায়ুমণ্ডলের উঁচু স্থানে উৎপন্ন হয় এবং তুষারকণা হিসেবে ভূমিতে নেমে আসে। অন্যদিকে, ঠান্ডা জলীয় বাষ্প যখন ভূমির কোনো তলের সংস্পর্শে আসে, তখন ফ্রস্ট সৃষ্টি হয়। অবশ্য, হিম বা ফ্রস্ট সৃষ্টির জন্য ওই তলের তাপমাত্রা শূন্য ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তারচেয়ে নিচে নেমে আসা জরুরি।
চলতি বছর শুয়াং চিয়াং সৌরপদের প্রথম দিন ২৩ অক্টোবর এবং শেষ দিন ৬ নভেম্বর। এ সৌরপদের প্রথম দিনই ফ্রস্ট দেখা যায়। তবে, সবখানে নয়। হলুদ নদীর নিম্ন অববাহিকায় অক্টোবরের শেষ দিকে বা নভেম্বরের শুরুতে ফ্রস্ট নজরে আসে। শুয়াং চিয়াং সৌরপদ হচ্ছে শরতের শেষবেলা। অনেকে তাই একে ‘হিমশীতল শরৎ’ নামেও ডাকেন।
হাঁসের মাংস
আগেই বলেছি, শুয়াং চিয়াং সৌরপদের প্রথম দিনে চীনারা বিশেষভাবে আপেল খায়। চীনের ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসাবিদ্যা অনুসারে, আপেল ফুসফুস তাজা রাখে, তৃষ্ণা মেটায় এবং হজমে সাহায্য করে। আপেল নিয়ে চীনেও অনেক প্রবাদ প্রচলিত আছে। তেমন একটি প্রবাদ হচ্ছে: ‘প্রতিবেলায় একটি করে আপেল খাও/বুড়ো কালে জোয়ান লোকের শক্তি পাও।’
শুধু আপেল নয়, চীনারা শুয়াং চিয়াং সৌরপদে পার্সিমন (persimmons) নামের একধরনের ফলও খেয়ে থাকে। এটি খেজুরবিশেষ। এ ফল ঠান্ডা-প্রতিরোধক। এটি শরীরের হাড়ও সুরক্ষিত রাখে। চীনের গ্রামাঞ্চলের মানুষ বিশ্বাস করে যে, এ সৌরপদে পার্সিমন না খেলে তাদের ঠোঁট ফেটে যাবে।
চেসনাট
চীনে আসার পর আমাদের সবার শ্রদ্ধাভাজন লিউ আপা আমাকে বলেছিলেন, ‘বেশি বেশি নাশপাতি খাবেন। এটা স্বাস্থ্যের জন্য ভালো।’ আপেলের মতো নাশপাতির অধিকাংশজুড়েই আছে পানি। সর্দি-জ্বরে নাশপাতি কার্যকর বলে শুনেছি। চীনা চিকিৎসাবিদ্যা অনুসারে, শুয়াং চিয়াং সৌরপদে বিশেষভাবে নাশপাতি খাওয়া উচিত। কারণ, নাশপাতি শরীরে বিভিন্ন ধরনের প্রয়োজনীয় তরল নিঃসরণে প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। তাছাড়া, নাশপাতি খেলে মুখে কম থুথু উৎপন্ন হয়।
চীনের দক্ষিণাঞ্চলীয় ফুচিয়ান প্রদেশ ও তাইওয়ানে অষ্টাদশ সৌরপদের প্রথম দিনে হাঁসের মাংস খাওয়ার রেওয়াজ আছে। যাদের ওজন কম, তারা এ সময় বেশি বেশি হাঁসের মাংস খেয়ে ওজন বাড়াতে পারেন। ফুচিয়ান প্রদেশে একটি প্রবাদ প্রচলিত আছে: শুয়াং চিয়াং সৌরপদের প্রথম দিনে শরীরে গৃহীত পুষ্টির মান, সারা বছরে গৃহীত পুষ্টিমানের চেয়ে উত্তম।
চীনা খেজুর
চীনে হরেক কিছিমের বাদাম পাওয়া যায়। চেসনাট (chestnuts) সেগুলোর একটি। চীনারা বিশ্বাস করে যে, শুয়াং চিয়াং সৌরপদের প্রথম দিন বিশেষভাবে চেসনাট খাওয়া উচিত। এটি স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। সুগন্ধযুক্ত চেসনাট খেলে শরীর গরম হয়। এটি প্লিহা ও পাকস্থলির জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি জোগায়, রক্ত চলাচল স্বাভাবিক রাখে, কাশি দূর করে, ও থুথু কমায়।
চীনারা যাকে খেজুর বলে, আমার কাছে সেটাকে বরই বলেই মনে হয়। বরই শুকালে যা হয়, চীনা খেজুর দেখতে অনেকটা তেমনই। যাই হোক, চীনা খেজুর ভিটামিনসমৃদ্ধ। এটি রক্ত পরিশুদ্ধ করে, রক্তচাপ কমায়, রোগ-প্রতিরোধক ক্ষমতা বাড়ায়। তবে অতিরিক্ত খেজুর খাওয়া ভালো নয়। শুয়াং চিয়াং সৌরপদে চীনারা বিশেষভাবে চীনা খেজুর খেয়ে থাকে।
শুয়াং চিয়াং সৌরপদের উৎসব
শুয়াং চিয়াং সৌরপদকে কেন্দ্র করে চীনে উৎসবের অস্তিত্বও আছে। এ উৎসব অবশ্য চীনজুড়ে পালিত হয় না। সৌরপদের প্রথম দিন কুয়াংসিচুয়াং স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের তাসিন কাউন্টিতে এ উৎসব পালিত হয়। উৎসবে তারা সংশ্লিষ্ট দেবতার উদ্দেশ্যে পূজা দেয়, নাচ করে, লোকগীতি গায়। এ উৎসব বিগত ৩৬০ বছর ধরে চলে আসছে। এতদঞ্চলের লোকেরা ছেন ইয়ুইন (Cen Yuyin) নামক একজন বীর নারীর স্মরণে এ উৎসব আয়োজন করে। বিদেশি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে এই নারী বীরত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন বলে কথিত আছে।
লেখক: বার্তা সম্পাদক, চায়না মিডিয়া গ্রুপ (সিএমজি), বেইজিং।alimuh@yahoo.com
এইচআর/ফারুক/জেআইএম