ভ্রমণ

থাইল্যান্ড ভ্রমণ: ফুকেট ও পাতং সৈকতের রূপ

কামরুল হাসান

Advertisement

ভ্রমণ এমন একটি বিষয়, যা আমাকে মুগ্ধতায় নির্বাক করে তোলে। তারপর আমাকে গল্পকারে পরিণত করে। যেহেতু জীবন সংক্ষিপ্ত এবং পৃথিবী প্রশস্ত; সেহেতু যে কোনো কিছুরই প্রথম দেখা প্রত্যেক মানুষের জীবনে একটি তাৎপর্য বহন করে। হোক সেটা প্রিয়তমার কোমল মুখ, কোনো ছলছল ছুটে চলা প্রিয় নদী, বিশাল জলরাশির সুনীল সাগর, অঝোরে ঝরে পড়া ঝরনা বা সুবিশাল কোনো পর্বতমালা। এর যে কোনো কিছুকেই গভীরভাবে জানা, তার সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠা, ভালোবাসা ও প্রেমে পরিণতি নেওয়া—এ সব কিছুর মূলে রয়েছে সেই দর্শনীয় স্থানগুলোকে প্রথম দেখার বিশেষ মুহূর্তটি। ঘোরাঘুরি কে না পছন্দ করে? নতুন অচেনা কোনো দেশে বা অচেনা শহরে গেলে মানুষ শিশু বয়সের বিস্মিত হওয়ার মতো অনুভূতিটি ফিরে পায়। তেমনি বিস্ময়ে ঘুরে বেড়াতে চাই আমি। আমরা সবাই ঘুরতে পছন্দ করি। কিন্তু আমার এ ছোট্ট উদ্যোক্তা জীবনে বড় ধরনের ছুটি কিংবা খণ্ডকালীন অবসর পাওয়াও যেন সোনার হরিণ পাওয়ার সমান। এ ব্যস্ত জীবনে নানা কাজের ভিড়ে যখন আমি ক্লান্ত হয়ে উঠি; তখন এক কাপ চা কিংবা কফি থেকেই আমি অনেক বেশি আনন্দ পাই ঘুরে বেড়িয়ে!

এ যান্ত্রিক জীবনে কর্মময় ইট-পাথরের শহরে কাজ থেকে লম্বা ছুটি বা অবসর পাওয়াটা বেশ কঠিন। আবার ছুটি পেলেও চাই যেন একটু নিরিবিলি শান্ত এবং কোলাহলমুক্ত পরিবেশে আনন্দময় ভাবে কাটানো যায়। এমন পরিবেশ বর্তমানে খুঁজে পাওয়া অনেকটাই কঠিন বা অনেক টাকা-পয়সার ঝামেলা তো আছেই। তাই অনেক সময় নিজের মনের মতো জায়গায় ছুটি কাটানো সম্ভব হয়ে ওঠে না। মানুষ অন্ধকার দ্বারা আবদ্ধ এক নির্লিপ্ত সমুদ্রের বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো। যে তার একাকিত্বের কথা আত্মাকে চূড়ান্তভাবে জানায়, এমনকি সে তার আত্মাকেও পুরোপুরি জানে না। উদ্যোক্তা জীবন বা চাকরি হয়তো আমার পকেট পূরণ করে, কিন্তু ভ্রমণ আমার আত্মা পূরণ করে বলেই আমি বিশ্বাস করি। তাই আমি মনে করি, অফিসে একটি রুমকে আমার পৃথিবী বানিয়ে আমি কেবল টাকাই পাবো হয়তো, কিন্তু আমি যদি পৃথিবী ঘুরে এটিকে নিজের ঘর বানিয়ে নিতে পারি, তবে নিঃসন্দেহে আমি অনেক সুখী হবো।

শামুক-ঝিনুক আর রঙিন কাঁকড়ার পদচারণায় বেলাভূমির নিপুণ কারুকার্যখচিত প্রাকৃতিক নয়নাভিরাম মুগ্ধতায় ডুবে অনন্তের মৌনতা ভাঙে। আর ঘড়ির কাঁটার সাথে সাথে ভ্রমণপিপাসুদের পদচারণায় রূপ বদল করে। এমন সমুদ্রসৈকত পৃথিবীজুড়ে আর কয়টা আছে? তেমনই একটি সমুদ্র সৈকত হলো ‘ল্যান্ড অব স্মাইলস’ খ্যাত থাইল্যান্ডের আন্দামান সাগরে অবস্থিত থাইল্যান্ডের বৃহত্তম দ্বীপ এই ফুকেট প্রভিন্সের পাতং সমুদ্রসৈকত। সকালে ব্যাংককের ডংমুয়াং ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট থেকে প্রায় ৮৪৫ কিলো দূরে থেকে নক এয়ারের প্লেনটি মাটি ছোঁয়ার আগেই বৃষ্টির ঝাঁপটায় প্লেনের উইন্ডশিল্ডগুলো ভিজে আছে। বাতাস কেটে মুহূর্তেই সরে যাচ্ছে পানি।তুমুল বৃষ্টির কারণে পানি সরে আবারো জমছে। এভাবেই প্লেন ল্যান্ড করল। ছোট্ট ছিমছাম গোছানো এয়ারপোর্ট। ইমিগ্রেশন শেষ করে বেরিয়ে এলাম। ভেতরের একটা এজেন্সি থেকে ফুকেট শহরের জন্য ট্যাক্সি ভাড়া নিলাম। আনুমানিক ৪৫ কিলোমিটার দূরত্ব। ৮০ কিলোমিটার বেগে চলছে গাড়ি রাস্তার দুধার দেখেই চোখ জুড়িয়ে গেল।

Advertisement

এত সুন্দর প্রশস্ত রাস্তা দেখে আমাদের ট্যাক্সি ড্রাইভারকে স্পিড বাড়াতে বললাম। কোন সংকোচ ছাড়াই সে বলল, আমরা ২০০০ বাথ ফাইন দিতে রাজি থাকলে সে স্পিড বাড়াবে। বুঝলাম তারা আইনের প্রতি যথেষ্ট অনুরাগী। কথা বাড়ালাম না। দেখতে দেখতে আমাদের হোটেলের সামনে চলে এলাম। পাতংয়ের কিছুটা আগে পূর্বের বুক করা মেরিনা পাতং হোটেলে উঠলাম আমরা। অসাধারণ একটা হোটেল বলা যায়। রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিচে নেমে এলাম লাঞ্চ করতে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল। দূরে কোথাও না গিয়ে বসে চোখ বোলালাম আশেপাশে। হোটেলের ঠিক উল্টো পাশেই একটা হালাল স্ট্রিট ফুডের দোকান চোখে পড়ল। রাস্তা পার হয়ে গেলাম ওখানে। স্বামী-স্ত্রী খুবই আন্তরিক মানুষ। ইয়েলো রাইস আর ফ্রাইড চিকেন অর্ডার করলাম। এত অল্প দামে এত সুস্বাদু খাবার! অনেকক্ষণ বসে গল্প করলাম তাদের সাথে। জানলাম অনেক কিছুই। স্থানীয় রীতি-নীতি। হোটেলে এসে চলে গেলাম রুফটপে। এখানে বার এবং পুল রয়েছে। পুরোটা বিকেল থেকে সন্ধ্যা এ ইনফিনিটি পুলেই ভিজিয়ে রাখলাম নিজেকে।

সন্ধ্যার পরে হোটেল থেকে বেরিয়ে গুগল ম্যাপ ধরে চলে এসেছি থানন রোড়ে। কক্সবাজারে যেমন রাস্তার মোড়ে মোড়ে সেন্টমার্টিন ভ্রমণের শিপের টিকিট বিক্রির বুথ আছে, এখানেও তাই। অনেক ঘুরেফিরে একটা ট্যুর এজেন্সি থেকে পছন্দসই ফি ফি আইল্যান্ডের পিক অ্যান্ড ড্রপসহ ডে ট্রিপের প্যাকেজ নিয়েছি। মানে সকালে ওরা হোটেল থেকে নিয়ে যাবে, আবার ট্যুর শেষ সন্ধ্যায় ড্রপ করে যাবে হোটেলে। প্যাকেজে ব্যুফে লাঞ্চ আর স্নোরকেলিংও ছিল। আমার পরামর্শ হলো, অন্তত কয়েকটা এজেন্সি ঘুরে দাম যাচাই করে নিন। সবগুলোর সার্ভিস একই, কিন্তু দাম কিছুটা এদিক সেদিক হয়! তবে দামাদামি করার সুযোগ আছে। ফুকেট একটি বড় দ্বীপ হওয়ায় পাতং সমুদ্রসৈকত ছাড়াও ফুকেটের চারপাশে রাওয়াই, কারন, কমলা, কাতা ইয়াই, কাতা নোই এবং মাই খাওয়ের মতো অনেক দুর্দান্ত সমুদ্রসৈকত রয়েছে। লাইম ফ্রোমথেপ ভিউপয়েন্টকে থাইল্যান্ডের সবচেয়ে সুন্দর সূর্যাস্ত ভিউ পয়েন্ট বলা হয়। এই দ্বীপের উত্তরে আরও রোমান্টিক কিছু সমুদ্রসৈকত রয়েছে, যা আরও আকর্ষণীয় ও রোমাঞ্চকর বটে! তবে মজার ব্যাপার হলো, দক্ষিণ উপকূলের সৈকতগুলো সাধারণত জনাকীর্ণ এবং উত্তর দিকেরগুলো অনেক বেশি শান্ত।

ট্যুরিস্টদের কাছে স্বপ্নের শহর ফুকেট। এ শহর যেন বিনোদনের সব পসরা সাজিয়ে রেখেছে এখানে আসা পর্যটকদের জন্য। সমুদ্রের নীলাভ পানির হাতছানির এ দ্বীপে জীবনে একবার হলেও আসা উচিত। পর্যটকরা তাই যে কোনো ছুটিতে ছুটে আসেন এ স্বপ্নের শহর ফুকেটে। ফুকেট প্রদেশ থাইল্যান্ডের দক্ষিণাঞ্চলীয় প্রদেশসমূহের একটি। দেশের বৃহত্তম এ দ্বীপ ‘ফুকেট দ্বীপ’সহ এর আশেপাশের আরও ৩২টি ছোট ছোট দ্বীপ নিয়ে গঠিত। ফুকেটের দক্ষিণ-উত্তরের নিকটতম প্রদেশ হল ফাং-নগা এবং পূর্বের নিকটতম প্রদেশগুলো হল ফাং-নগা এবং ক্রাবি। আন্দামান সাগরের উপকূলে অবস্থিত অঞ্চলটি। ফুকেট দ্বীপ সারাসিন সেতুর মাধ্যমে উত্তরে ফাং এনজিএ প্রদেশের সঙ্গে সংযুক্ত। ফুকেটকে বলা হয় ফরেন সিটি। এখানে যত থাই জনগণ আছে, তারচেয়ে বিদেশি জনগণই বেশি। যেদিকেই তাকাবেন দেখবেন পর্যটক আর পর্যটক। বিশ্বের পর্যটকদের জন্য একটি আনন্দ উদযাপনের স্বর্গ বলা চলে। এটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, নাইট লাইফ, মুখরোচক নানা খাবারের আনন্দ, বিশ্বমানের রিসোর্ট, অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টস, কেনাকাটা বা বিনোদন; হোক না কেন সবই পাবেন এ রঙিন শহরে।

থাইল্যান্ডের স্থানীয়দের কাছে বেশ জনপ্রিয় ফুকেট। দেশটির সবচেয়ে বেশি পর্যটক আসে এখানে। ফুকেটের অপূর্ব সৌন্দর্য দেখতে আসেন বিশ্বের পর্যটকরাও। ফুকেটের সবচেয়ে জনপ্রিয় স্থান ফুকেট বিচ। পাহাড়, নীলাভ সমুদ্র, সবুজ গাছ, অপূর্ব আবহাওয়া সব মিলিয়ে পৃথিবীর সেরা সব বিচের মধ্যে একটি। শুধু তা-ই নয়, ফুকেট থাইল্যান্ডের একটি উন্নত অঞ্চল। দেশটির দামি কিছু রেস্তোরাঁ, নাইটক্লাব, রিসোর্ট, পার্ক, জিপলাইন সব মিলিয়ে ফুকেট সেরা। বিভিন্ন ওয়াটার অ্যাক্টিভিটির সুযোগ রয়েছে এ দ্বীপে। ফুকেট দ্বীপের সবচেয়ে জমজমাট স্থান হলো ফুকেট সিটি। কেনাকাটার জন্য উপযুক্ত জায়গা। শহরের চিকন রাস্তাজুড়েই পাবেন পছন্দসই রেস্টুরেন্ট, বুটিক শপ আর অসাধারণ সব গিফটের দোকান। প্রচুর লোকাল মার্কেট এখানে। বিশেষ করে ছুটির দিনে স্পেশ্যাল কিছু লোকাল দোকান বসে। থাইল্যান্ডের সরকারি হিসেবে প্রতিদিন এখানে দেশ-বিদেশের পর্যটকের সংখ্যা পঁচিশ হাজারেরও বেশি। দ্বীপটির দৈর্ঘ প্রায় ৪৮ কিলোমিটার আর প্রস্থ ২১ কিলোমিটার। একবার এলেই বুঝতে পারবেন যে কোনো পর্যটককে সন্তুষ্ট করার জন্য যথেষ্ট স্বপ্নের এ লীলাভূমি।

Advertisement

আগামীকালের ফি ফি আইল্যান্ডের জন্য বুকিং নিশ্চিত করে হেঁটে হেঁটে চলে এসেছি বাংলা রোডে। ফুকেটের রাতের শহর দেখতে হলে এখানে অবশ্যই আসতে হবে। সূর্যাস্তের পর পরই এ রাস্তায় অন্যরকম এক আবহ তৈরি হয়। নিয়ন আলোয় চারপাশ ঝলমলে আর হৈ-হুল্লোড়ে পরিপূর্ণ রাতের এ রাস্তা। এখানকার ডি ক্লাব, মানি নাইট ও মউলিন রউগের মতো ক্লাবে গিয়ে উপভোগ করা যায় অন্য এক ঘোরের জীবন। কিছুটা সময় এখানে কাটিয়ে চলে এলাম পাতং বিচে। ফুকেটের সমুদ্রসৈকত হলো বিশ্বের সেরা সমুদ্রসৈকতগুলোর একটি। যেখানে সূক্ষ্ম সাদা বালি, মাথা নোয়ানো পাম গাছ, চকচকে সমুদ্র এবং প্রাণবন্ত শহর সবই রয়েছে। ফুকেট একটি খুব নিরাপদ গন্তব্য, এমনকি রাতেও। থাইল্যান্ড সাদা হাতির দেশ হলেও, ফুকেট হবে থাইল্যান্ডের মুক্তা। এ ছোট্ট জীবনের সেরা যে মুহূর্ত আবেশে ধরা দিয়েছে আমার কাছে, তার একটি এই পাতং বিচ। শান্ত নিরিবিলি বিচ। সুনসান নীরবতা। কেউ নেই বললেই চলে। হিমেল হাওয়া বইছে। পাশের জোড়া নারিকেল গাছের দোলনায় দুলছে কেউ। সামনে ফ্রেস ফ্রুটস, সালাদ আর বিয়ার। ভাবুন তো একবার!

চলবে...

লেখক: ফাউন্ডার অ্যান্ড সিইও, মেডিস্টোরবিডি ডটকম।

এসইউ/জেআইএম