মতামত

দুয়ারে দুর্ভিক্ষের দূত আমরা কতটা প্রস্তুত?

দীর্ঘ সময় ধরে যখন অর্থনৈতিক কার্যক্রম এর গতি অস্বাভাবিক ভাবে কমতে থাকে তখন সৃষ্টি হয় মন্দার। মন্দার পরিস্থিতি যদি টানা কয়েক বছর স্থায়ী হয় তাহলে সৃষ্টি হয় মহামন্দার। আর সেই মহামন্দার হাত ধরেই আসতে পারে দুর্ভিক্ষ বা খাদ্যসংকট। যা নিয়ে এই ইতোমধ্যেই আতঙ্ক প্রকাশ করেছে পুরো বিশ্ব।

Advertisement

২০১৯ এ করোনা, ২০২১ এ ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধ ও ২০২২ এ জলবায়ুর ব্যাপক তারতম্য। আর ২০২৩ এ? ইতোমধ্যেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অর্থনীতিবিদসহ সংশ্লিষ্টরা সতর্ক করেছেন, ২০২৩ এর মহামন্দা এবং দুর্ভিক্ষ নিয়ে।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এবং বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির তথ্যমতে, ২০২৩ এর দুর্ভিক্ষে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বিশ্বের ৪৫ টি দেশের প্রায় ২০ কোটি মানুষ। অর্থনীতিবিদরা ২০২৩ সালের সম্ভাব্য দুর্ভিক্ষের কারণ হিসেবে ৩টি প্রধান কারণ দাঁড় করিয়েছেন। করোনা মহামারি ও বিশ্ব অর্থনীতিতে এর প্রভাব, বিশ্বের প্রধান দুটি দেশের ভেতরকার যুদ্ধ এবং নানাবিধ সংঘাতকে ২০২৩ সালের সম্ভাব্য দুর্ভিক্ষের কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে। এছাড়াও জলবায়ু পরিবর্তনকেও দুর্ভিক্ষের মত মহামারির জন্য দায়ী করেছেন অর্থনীতিবিদরা।

প্রথমে আসা যাক, করোনার প্রভাব নিয়ে। ২০১৯ থেকে এখনো পর্যন্ত পুরো বিশ্বকে গ্রাস করে রেখেছে করোনা মহামারি। বিশ্বের অনেক দেশ এখনো পুরোপুরি ভাবে কোভিড-১৯ এর ধাক্কাটা সামাল দিয়ে উঠতে পারেনি। যেসব দেশ কিছুটা পেরেছিল, করোনার দ্বিতীয় ও তৃতীয় ঢেউয়ে আবারও হেলে পড়েছে সেসব দেশের অর্থনীতি। যেই চাপ সামলে ওঠা ২০২২ সাল নাগাদ এখনো পর্যন্ত সম্ভব হয়ে ওঠেনি।

Advertisement

দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাস করা এবং কিছু উন্নয়নশীল দেশও এই তালিকার অন্তর্ভুক্ত। বিশ্বব্যাপী খাদ্যপণ্যের দাম এর ওঠানামা, কর্মসংস্থান হারানো, পেশার পরিবর্তন, শেয়ারবাজারে দরপতনসহ অসংখ্য বিষয় আসে মহামারির ক্ষতির আলোচনার বিষয়বস্তু হিসেবে। বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতির প্রভাব পড়েছে বিশ্বের অন্তত ৭০ শতাংশ দেশে। বাংলাদেশে নতুন করে ২ লাখ মানুষ দারিদ্র্য সীমায় নেমে এসেছে। করোনা মহামারি, বিভিন্ন অর্থনৈতিক কৌশলগত কারণসহ মনুষ্য সৃষ্ট নানা কারণে বিশ্বের ৫৮ শতাংশ উন্নয়নশীল ও উন্নত দেশে মূল্যস্ফীতির হার এখন ৬ শতাংশের ওপরে।

বিশ্ব শ্রম সংস্থা আইএলও এর তথ্যমতে, করোনা মহামারির কারণে বিশ্বব্যাপী কর্মসংস্থান হারিয়েছেন প্রায় ২০ কোটি মানুষ। ২০২০ সালের একটি জরিপের মতে, করোনা শুরুর এক বছরের মধ্যেই বাংলাদেশে কর্মসংস্থান হারিয়েছে ১৭ লাখ মানুষ। দারিদ্র্যের হার বেড়েছে ৪২ শতাংশ।

একে তো কর্মসংস্থানের অভাব তার ওপর মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বমুখিতা, এ যেন কাটা ঘায়ে নুনের ছিটার মত। মূল্যস্ফীতির প্রথম প্রভাব হিসেবে দেখা দেয় মুদ্রা ক্রয় ক্ষমতা হ্রাস। এছাড়াও আন্তর্জাতিক ও বহুমাত্রিক সমস্যায় চাপ তৈরি হয়েছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে। যার ফলে বিশ্বের অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও কমেছে মুদ্রার মান। এই তালিকায় সব থেকে এগিয়ে ভারত ও পাকিস্তান।

এদিকে বাংলাদেশের মতো আমদানি নির্ভর দেশগুলো পড়েছে বিপাকে। মুদ্রাস্ফীতির কারণে যে হারে আমদানি ব্যয় বেড়েছে, তার সাথে সামঞ্জস্য হারিয়েছে রপ্তানি ও রেমিটেন্স থেকে দেশগুলোর আয়। জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) মনে করে, করোনা মহামারির পুরো সময়টাতে বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর আয় ২২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হ্রাস পেতে পারে।

Advertisement

ইতোমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রে নতুন গাড়ির বিক্রয় কমেছে ৪০ শতাংশ। বোয়িং ও এয়ারবাস কয়েকটি কারখানায় উৎপাদন স্থগিত করেছে। আইএলও এর তথ্যমতে, বর্তমান পরিস্থিতিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সবচেয়ে ভয়াবহ সঙ্কট হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক এডিবির এক জরিপে দেখা গেছে, করোনা মহামারির কারনে সৃষ্ট মন্দায় বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াতে পারে ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এদিকে চলতি অর্থবছরের বাজেটে ঘাটতি রয়েছে ২ লাখ ১৪ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। যা দেশের মোট জিডিপির ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। ২০১৯-২০ অর্থবছরে এ পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৪১ হাজার ২১২ কোটি টাকা।

করোনা মহামারির আগের অর্থবছর অর্থাৎ ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এই পরিমাণ ছিল ৫৬ হাজার কোটি টাকা।অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, করোনা মহামারির পর এই পরিমাণ হয়েছে প্রায় দ্বিগুণের বেশি। বাংলাদেশে বাজেট ঘাটতি বৃদ্ধিসহ রাজস্ব আয় হ্রাস, রপ্তানি আয় হ্রাস, রেমিট্যান্স কমে যাওয়া, পর্যটনশিল্পে ধস, ব্যাংকিং খাতে তারল্যসংকট বৃদ্ধি, বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয়বৃদ্ধি, প্রবাসি আয়ে ধসসহ নানা দুর্যোগের সম্মুখীন হয়েছে পুরো বিশ্ব শুধু করোনা মহামারির কারণে।

২০১৯ সাল থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত বিশ্ব যেখানে পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারেনি করোনা মহামারির ধাক্কা, সেখানে করোনার আগুনে ঘি ঢাললো রাশিয়া ইউক্রেনের মত প্রভাবশালী দুটি দেশের অন্তর্কোন্দল। সিএনএন এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এটিই সবচেয়ে বড় যুদ্ধ। যার প্রভাব পড়েছে পুরো বিশ্বে। করোনার পর ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধের ফলে আরো একবার মূল্যস্ফীতির কবলে এখন পুরো বিশ্ব।

মহামারির ক্ষত একটু একটু করে কাটিয়ে ওঠার মুহূর্তেই আরো একবার মুখ থুবড়ে পড়ল বিশ্ব অর্থনীতি। জ্বালানি তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সকল দ্রব্যাদির দাম বাড়ছে হু হু করে। কেননা বিশ্ববাজারে খাদ্যশস্য সরবরাহে দেশদুটির রয়েছে বিস্তর অবদান। রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব হিসেবে বিশ্বে সবথেকে উল্লেখযোগ্য ক্ষতি হয়েছে জ্বালানি খাতের। ইউরোপ এর মোট তেল গ্যাসের ২৫ শতাংশই সরবরাহ হয় রাশিয়া থেকে। স্লোভাকিয়া, এস্তোনিয়া, লাটভিয়া কিংবা ফিনল্যান্ড এর শতভাগ জ্বালানি আসে রাশিয়া থেকে। জার্মানি তার মোট জ্বালানির প্রায় অর্ধেক এজন্য নির্ভর করে রাশিয়ার ওপর।

এদিকে ইউরোপে গ্যাস সরবরাহের মূল ফটক ইউক্রেন। রাশিয়ার উৎপাদিত গ্যাসের ৪০শতাংশ যায় ইউক্রেনের পাইপলাইন থেকে। তাই ইউক্রেনকে জিম্মায় রাখতে সংঘটিত ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধে বিশ্বে মূল্যস্ফীতিসহ দৃশ্যমান জ্বালানি সংকট তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশেও এর প্রভাব ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। কেননা রূপপুর-পারমাণবিক-বিদ্যুৎ-কেন্দ্রসহ আরো বেশ কিছু প্রকল্পে কাজ করছে রাশিয়া। তৈরি পোশাকের নতুন বাজার হিসেবেও বাংলাদেশে ভূমিকা পালন করছে রাশিয়া। এছাড়া বিভিন্ন সামরিক সরঞ্জাম, খাদ্যপণ্য সরবরাহ তো আছেই ।

পৃথিবীর মধ্যে কয়েকটি দেশকে এগ্রিকালচারাল পাওয়ার হাউস বলা হয়। ব্রাজিল, ক্যালিফোর্নিয়া, চায়না, কানাডা, আসিয়ানভুক্ত ১০টি দেশ এবং ইউক্রেন রাশিয়া। পুরো বিশ্বের মোট গমের ৩০ ভাগই উৎপাদিত হয় রাশিয়ায়। সূর্যমুখী তেলের ৬৫ ভাগ ও উৎপাদিত হয় রাশিয়ায়। যেই সংখ্যা নেহাতই কম নয়। অর্থাৎ বোঝাই যাচ্ছে বিশ্বের মোট খাদ্য সরবরাহের রাশিয়ার ভূমিকা কত বিশাল।

যুদ্ধ এবং যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়ায় উৎপাদিত খাদ্য দ্রব্যাদির পুরোটাই বিভিন্ন দেশে সরবরাহ থেকে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এদিকে ইউক্রেনের যুদ্ধের কারণে সেখানে খাদ্যশস্য উৎপাদনই হচ্ছে ব্যাহত। ইতোমধ্যেই ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি জানিয়েছেন, যুদ্ধের কারণে এই বছর শস্য উৎপাদন নেমে যেতে পারে অর্ধেকে। আর উৎপাদিত ফসল গুলো রপ্তানিতে পোহাতে হচ্ছে নানাবিধ বাধা।

এছাড়াও সার উৎপাদনে বেশ ভূমিকা রাখে ইউক্রেন। কিন্তু চলতি যুদ্ধের কারণে সার রপ্তানি ব্যাহত হওয়ায় অনেক দেশেই ব্যাহত হচ্ছে যথাযথ ভাবে খাদ্য উৎপাদন। ৬টি এগ্রিকালচারাল পাওয়ার হাউসের একটি দেশ ব্রাজিল, যে নিজদেশে খাদ্য-উৎপাদনের জন্য সার আমদানি করে ইউক্রেন থেকে। সার আমদানি ব্যাহত হওয়ায় ব্রাজিলের খাদ্য উৎপাদন মারাত্মকভাবে ক্ষতির মুখে পড়েছে। ফলশ্রুতিতে পুরো পৃথিবী ব্রাজিলের উৎপাদিত খাদ্যশস্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

আবার এদিকে সার এর অভাবে যেসব দেশে কোনমতে উৎপাদিত হচ্ছে খাদ্যশস্য, সেগুলোর দামও স্বাভাবিকভাবেই বৃদ্ধি পাবে।আর তাতে নির্ধারিতভাবেই বিপদে পড়বে সাধারন মানুষ। এই অল্প সংখ্যক বাড়তিদামের খাদ্য দিয়ে সুবিশাল জনগোষ্ঠীর চাহিদা মেটানো যেতে পারে বড়জোর ৩/৪ মাস। এরপরই নিশ্চিতভাবে দেখা দেবে খাদ্য-সংকট।

এবার আসি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে। চলতি বছর থেকেই জলবায়ুতে এসেছে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন। কিছু কিছু দেশে যেখানে দেখা দিয়েছে খরা, আবার কিছু দেশে দেখা যাচ্ছে মারাত্মক বন্যা। ক্ষরা বা বন্যা, দুটোই খাদ্যশস্য উৎপাদনের অন্তরায়। একদিকে অতীত থেকে শুরু করে চলমান করোনা, চলমান ইউক্রেন রাশিয়া কোন্দল, সাথে জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহ প্রভাব, সব মিলিয়ে পুরো বিশ্ব যে ১৯৩০ সালের পর যেকোন সময়ের চেয়ে কঠিন সময় পার করছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

ইতোমধ্যেই বিশ্বের বিভিন্নদেশের প্রধান এই ব্যাপারে জনগণকে সতর্কবার্তা দিয়েছেন। জাতিসংঘ প্রধান এন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন ২০২২ সাল থেকেই আসতে পারে কয়েকটি দুর্ভিক্ষের ঘোষণা। আর ২০২৩ হতে পারে ভয়াবহ। এদিকে জাতিসংঘের ফুড এন্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজেশন (ফাও) এর তথ্যমতে ২০২৩ সালে বিশ্বের প্রায় ৪৫ টি দেশ চরম খাদ্যসংকটের মুখোমুখি হবে। যার মধ্যে ১টি বাংলাদেশ। অর্থনীতিবিদদের মতে, ১৯৩০ সালের মত আরো একটি সাল দেখতে চলেছে বিশ্ব। আর বাংলাদেশ আবারো পড়তে পারে '৭৬ এর মনন্তর' এ।

তাই এখন থেকেই বৈশ্বিক বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও প্রতিটি দেশ জোর দিচ্ছে খাদ্য উৎপাদন ও সঞ্চয়ে। কমানো হচ্ছে বিলাসবহুল পণ্যের আমদানি। আর কমানো হচ্ছে আমদানি ব্যয়। পুরো বিশ্বের লক্ষ্য এখন একটিই। আর যেন দেখতে না হয় ১৯৩০ সাল। প্রশ্ন হচ্ছে সংকট মোকাবেলায় আমরা কতটা প্রস্তুত?

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।

এইচআর/এএসএম