আন্তর্জাতিক

ইমরান খান এখন আগের চেয়ে জনপ্রিয়

পাকিস্তানে আজকাল সারাক্ষণই নির্বাচনের মৌসুম। গত এপ্রিলে অনাস্থা ভোটে হেরে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। এর প্রতিক্রিয়ায় একযোগে পদত্যাগ করেন তার দল তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) ১৩১ আইনপ্রণেতা। তারপর থেকেই ধাপে ধাপে নির্বাচন চলছে পাকিস্তানে। সবশেষ ভোট অনুষ্ঠিত হয়েছে গত ১৬ অক্টোবর। এতে আটটি আসনের মধ্যে সাতটিতেই প্রার্থী অপরিবর্তিত রেখেছিল পিটিআই, যার মধ্যে ছিলেন ইমরান নিজেও। নির্বাচনে ছয়টি আসনে জয় পায় তার দল। এই ফলাফলে পিটিআই’র জনপ্রিয়তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে বলে দাবি করেছেন দলটির চেয়ারম্যান।

Advertisement

ইমরানের কথাটা ফেলনা নয়। মাস ছয়েক আগে সেনাবাহিনীর আশীর্বাদপুষ্ট বিরোধী দলীয় জোটের চাপে যখন ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন পিটিআই প্রধান, তখন অনেকেই তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের সমাপ্তি দেখে ফেলেছিলেন। কিন্তু চুপচাপ সরে যাওয়ার বদলে রাজপথে নেমে আসেন ইমরান খান। করতে থাকেন একের পর এক জনসভা।

এসময় ইমরান দাবি করেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে তাকে পদচ্যুত করেছে জোট সরকার। যদিও এ বিষয়ে কোনা প্রমাণাদি হাজির করতে পারেননি তিনি। তবে তার সমর্থকরা এই দাবিকে পুরোপুরি যুক্তিসঙ্গত বলে মনে করেন এবং সমাবেশগুলোতে বিপুল সংখ্যায় উপস্থিত হন।

পাকিস্তানে পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে ২০২৩ সালের নভেম্বরের মধ্যে। কিন্তু ইমরান খান কয়েক মাস ধরেই আগাম নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছেন। তিনি এখন তার সমর্থকদের নিয়ে রাজধানী ইসলামাবাদে মিছিল করার হুমকি দিচ্ছেন, যাতে সরকারকে নির্বাচন দিতে বাধ্য করা যায়।

Advertisement

এর ফলে, আগে থেকেই সংকটে জর্জরিত দেশটিতে আরও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা তৈরি হয়েছে। দুশ্চিন্তার বিষয় হলো, ইমরানের হুমকি দেওয়া মিছিলটি রাজধানীর রাজপথে শোডাউন করবে। তবে এতেও তার জন্য নির্বাচনের পথ সহজ হবে না। প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের ক্ষমতা রয়েছে পার্লামেন্টে ভেঙে দেওয়ার। অবশ্য মেয়াদ পূরণ করার বিষয়ে এখনো দৃঢ় আশাবাদী তিনি। শাহবাজ বিশ্বাস করেন, ক্ষমতাসীন পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট জোট আইএমএফের সাহায্যে পাকিস্তানের অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করতে পারবে।

তবে কাজটি দুঃসাধ্যই বটে! সরকার গঠনের মাত্র পাঁচ মাসের মাথায় মূল্যস্ফীতি ইস্যুতে অর্থমন্ত্রী পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছেন শাহবাজ। দেশটিতে মূল্যস্ফীতির হার এরই মধ্যে ২০ শতাংশ ছাড়িয়েছে। তার ওপর রয়েছে সাম্প্রতিক বন্যার আঘাত। ভয়াবহ এ দুর্যোগে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ৩ হাজার ২০০ কোটি থেকে চার হাজার কোটি মার্কিন ডলার হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

বিশ্বব্যাংক মনে করে, আগামী মাসগুলোতে পাকিস্তানে দারিদ্র্যের হার চার শতাংশ পয়েন্ট পর্যন্ত বাড়তে পারে। অর্থাৎ, দেশটিতে নতুন করে দরিদ্র হতে চলেছে অন্তত ৯০ লাখ মানুষ। পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার ২ হাজার ৭০০ কোটি ডলারের ঋণ পুনর্নির্ধারণ করতে চাইছে, যার বেশিরভাগই নেওয়া চীনের কাছ থেকে। গত কয়েক মাসে পাকিস্তানের ঋণখেলাপি হওয়ার ঝুঁকি কিছুটা কমেছে, তবে পুরোপুরি মিলিয়ে যায়নি। তাছাড়া, বিশ্ববাজারে প্রাকৃতিক গ্যাসের বাড়তি মূল্য আগামী শীতে দেশটিতে ব্যাপক জ্বালানি ঘাটতির হুমকি সৃষ্টি করেছে।

এ অবস্থায় ইমরান খানের কাছ থেকে ক্রমাগত চ্যালেঞ্জের মুখে টিকে থাকতে বেশ কিছু কৌশল নিয়েছে পাকিস্তান সরকার। ইমরানকে দমাতে আইনকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। তার নামে একাধিক মামলা করা হয়েছে, যার মাধ্যমে ইমরান খান নির্বাচনে অংশগ্রহণে অযোগ্য ঘোষিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে (শুক্রবার এই রায়ই দিয়েছে পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশন)।

Advertisement

শাহবাজ শরিফের হাতে আরেকটি তুরুপের তাস হলো, আগামী নভেম্বরে নতুন সেনাপ্রধান নিয়োগ দেওয়া যাবে। পাকিস্তানের রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর প্রভাব সর্বজনবিদিত। সেখানে সরকার গঠন বা পতনের পেছনে সামরিক নেতাদের কলকাঠি নাড়ার ইতিহাস পুরোনো। ইমরান খানও প্রধানমন্ত্রিত্ব হারানোর আগে সেনাপ্রধান জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়ার সঙ্গে বিরোধে জড়িয়েছিলেন।

ইমরান খান ক্ষমতায় থাকাকালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের বেশ কিছু কথোপকথনের গোপন রেকর্ডিং সম্প্রতি অনলাইনে ফাঁস হয়েছে। এগুলো ইমরানকে অপমানিত করা এবং তার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পেছনে ওয়াশিংটন জড়িত থাকার দাবিকে মিথ্যা প্রমাণের চেষ্টা বলে মনে করা হচ্ছে। শাহবাজ শরিফের সরকার এ বিষয়ে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে। তবে ইমরান খান দাবি করেছেন, ক্ষমতাসীনরা তার ক্ষতি করার চেষ্টায় এরপর ভুয়া ‘নোংরা ভিডিও’ প্রকাশ করবে।

শাহবাজ শরিফকে নির্বাচনের জন্য আর মাত্র কয়েক দিন সময় দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন ইমরান খান। তবে পাকিস্তানি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, [ইমরান] লংমার্চ নিয়ে ইসলামাবাদে গেলে তাকে উল্টো করে ঝোলাবে সরকার।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সম্প্রতি বলেছেন, পাকিস্তান সম্ভবত বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক দেশগুলোর মধ্যে একটি। কারণ এর পারমাণবিক অস্ত্র থাকলেও কোনো সমন্বয় নেই। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়, বাইডেনের এই কথাকে সঠিক প্রমাণ করতেই সম্ভবত উঠেপড়ে লেগেছেন পাকিস্তানের বিবদমান রাজনীতিবিদরা।

সূত্র: দ্য ইকোনমিস্টকেএএ/