দেশজুড়ে

মৃত্যুর আধাঘণ্টা আগে মায়ের সঙ্গে কথা বলেছিলেন শাহরিয়ার

মঙ্গলবার (১৮ অক্টোবর) দিনগত রাতে খারাপ স্বপ্ন দেখে বুধবার (১৯ অক্টোবর) সন্ধ্যায় ছোট ছেলে গোলাম মুস্তাক শাহরিয়ারকে ফোন দিয়েছিলেন মা শাহনাজ বেগম। বেশকিছু সময় ধরে মা-ছেলের মধ্যে অনেক কথা হয়েছিল। কথার একপর্যায়ে মুস্তাক শাহরিয়ার তার মাকে বলেছিলেন, ‘মা, তুমি খালি খালি চিন্তা করো না তো। আমি আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের বারান্দায় আছি। আজ হলে খাবো না, হলের খাবার ভালো লাগে না। তাই বাইরে হোটেলে খেতে যাবো।’

Advertisement

তখন মা শাহনাজ বেগম বলেছিলেন, এতো তাড়াতাড়ি খাবি? ক্ষুধা লেগে যাবে তো। তখন মুস্তাক শাহরিয়ার বলেন, ‘না, মা। এখনই যাবো না তো। একটু পরে যাবো’। তার এ কথা শুনে শাহনাজ বেগম বলেন, ‘ঠিক আছে বেশি রাত করিস না। সাবধানে যাবি। তাড়াতাড়ি ফিরে আসিও।’

ঘটনার মাত্র আধঘণ্টা আগে মা এবং ছেলের মধ্যে মোবাইল ফোনে এমনটাই আলাপ হয়েছিল। ছেলেহারা মা শাহনাজ বেগম ছেলের মৃত্যুর খবর শুনে এখন শুধু বিলাপ করছেন এবং বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন। মাঝে মাঝে বলছেন, ‘সোনা বাবা, তুমি আমাকে বিশ্ববিদ্যালয় দেখাবা না?’

শাহরিয়ারের মৃত্যুর খবর এলাকায় ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে তার পরিবারকে সান্ত্বনা দিতে আসা লোকজন মায়ের আর্তনাদ শুনে চোখের পানি কেউ ধরে রাখতে পারেননি। শাহরিয়ারের মা-বাবাসহ আত্মীয়-স্বজনরা এমন মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে প্রকৃত ঘটনা জনসম্মুখে তুলে ধরার দাবি জানিয়েছেন স্বজনরা।

Advertisement

শাহরিয়ারের বাবা সাবেক সেনাসদস্য গোলাম মোস্তফা বলেন, পূজার ছুটিতে বাড়িতে এসেছিল ছেলে। বাড়ি থেকে যাওয়ার ১০ দিন হলো। ছেলে আমার বাড়িতে ফিরলো নিথর দেহ নিয়ে।

এলাকাবাসী ও পরিবারের লোকজন জানান, কিছুদিন হলো শাহরিয়ারের বড় ভাই গোলাম সারওয়ার শাকিল গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেছেন। সে উপলক্ষে গত ৯ অক্টোবর বাড়িতে আত্মীয়-স্বজন নিয়ে অনুষ্ঠান করা হয়। সেদিন অনুষ্ঠান শেষ ১০ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে যায় শাহরিয়ার।

নিহত গোলাম মুস্তাক শাহরিয়ারের মা শাহনাজ বেগম বলেন, ‘আমার ছেলে মারা যাওয়ার আধঘণ্টা আগে আমার সঙ্গে কথা বলেছিল। কারও বিরুদ্ধে আমার কোনো অভিযোগ নেই । কেউ যদি কিছু করে থাকে তার বিচার আল্লাহ করবেন।’

মরদেহের সঙ্গে আসা রুমমেট ও সহপাঠী নাজমুল হাসান বলেন, ‘চার বছর ধরে আমরা একসঙ্গে, এক রুমে থাকি। গতকাল (বুধবার) বিকেলে আমরা রুম থেকে বের হয়ে যাই। ও এক জায়গায় চলে যায় আর আমি অন্য জায়গায় চলে যাই। সন্ধ্যার দিকে শাহরিয়ার ছাদ থেকে পড়ে গেছে এমন খবর আমি পাই। পরে হাসপাতালে গিয়ে দেখি সে আহত অবস্থায় ছটফট করছে। আমরা সে সময় কোথাও কোনো ডাক্তারকে খুঁজে পাইনি। তাকে জরুরিভাবে আইসিইউতে ভর্তি করানোর জন্য বারবার বলা হলেও আমাদের কথায় কেউ কর্ণপাত করেনি।’

Advertisement

মরদেহের সঙ্গে আসা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের হবিবুর রহমান হলের প্রভোস্ট শরিফুল ইসলাম বলেন, ভালো ছাত্রের পাশাপাশি শাহরিয়ার একজন ভালো ফুটবল খেলোয়াড় ছিল। ছাদ থেকে পড়ে যাওয়ার পর আমি হাসপাতালে গিয়ে দেখি সে মারা গেছে। তার এই মৃত্যুতে আমরা শোকাহত।

পারিবারিক সূত্র জানায়, তাদের জানানো হয়েছে গোলাম মুস্তাক শাহরিয়ার যখন মায়ের সঙ্গে কথা শেষ করে হবিবুর রহমান হলের তৃতীয় তলার বারান্দা থেকে নামতে যাবে, এ সময় বারান্দার রেলিংয়ের ওপর থেকে একটি বিড়াল নিচে পড়ে যাচ্ছিল। এ সময় বিড়ালটিকে ধরতে গিয়ে তিনি পড়ে যান। কিন্তু ঘটনাটি কতটুকু সত্য তা কেউ নিশ্চিত করতে পারেননি।

এ বিষয়ে বিরল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফখরুল ইসলাম বলেন, রাজশাহী থেকে বিরল থানায় জানানো হয়েছে যে শাহরিয়ার অসাবধানতাবশত তৃতীয় তলার রেলিং থেকে পড়ে গিয়ে মারা গেছেন। নিহত শাহরিয়ার দিনাজপুরের বিরল উপজেলার ভান্ডারা ইউনিয়নের বেতুড়া গ্রামের ডিপপাড়া গ্রামের সাবেক সেনাসদস্য গোলাম মোস্তফার দ্বিতীয় ছেলে। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন।

বৃহস্পতিবার (১৯ অক্টোবর) বিকেল ৪টার দিকে তার মরদেহ গ্রামের বাড়ি এসে পৌঁছালে কান্নার রোল পড়ে যায়। মা, ভাই-বোনের আহাজারিতে আকাশ বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। বিকেল সাড়ে ৪টায় জানাজা শেষে পারিবারিক গোরস্থানে দাফন করা হয় শাহরিয়ারকে।

বুধবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে রাবির হবিবুর রহমান হলের তৃতীয় তলার বারান্দা থেকে পড়ে যান শাহরিয়ার। শব্দ পাওয়ার পর কয়েকজন দেখতে পেয়ে তার কাছে ছুটে যান। ততক্ষণে তার মাথা ফেটে প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। পরে তাকে মুমূর্ষু অবস্থায় রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার কিছুক্ষণ পরই কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।

এমদাদুল হক মিলন/এসআর/জেআইএম