কামরুল হাসান
Advertisement
এ যেন বিমানের পাইকারি বাজার! যেন বিক্রির জন্য বিমানগুলো সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। সুবর্ণভূমি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আমাদের বাংলাদেশ বিমানের এয়ারক্রাফটি ল্যান্ডিং করার আগে উপর থেকে সারি সারি সাজিয়ে রাখা বিমানগুলো দেখে এমনটাই মনে হলো। এর আগে দুইবার থাইল্যান্ডে এলেও প্রতিবারই ল্যান্ড করেছি ডং মুয়াং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। আর সুবর্ণভূমিতে এবারই প্রথম। তাছাড়া এবারের বিদেশ যাত্রাটা একটু কঠিনই বৈকি। এটা ওটা থেকে শুরু করে ট্রাভেল ইন্স্যুরেন্স, থাই পাস কত কী যে লাগলো। আর এজন্য জাবের মাহবুব ভাইকেও জ্বালিয়েছি অনেক। ছয়টি আলাদা ফ্লাইট বুকিং, পাঁচটি হোটেল রিজার্ভেশন ছাড়াও আরও কত কী! এরপরও বাকি আছে আরও অনেক কিছুই। ইমিগ্রেশনের কাজ সেরে হোটেলে ফেরার গাড়িতে উঠে নিজেকে যেন জোকারই লাগছিল। গাড়ির ভেতরটা অদ্ভুতুড়ে বিয়ে বাড়ির মতো ডেকোরেশন করা। যেন, লাল-নীল বাত্তি জ্বলে, জ্বলে রে... জ্বলে, একবার জ্বলে একবার নিভিয়া...
শুধু উপমহাদেশেই নয়, সমস্ত পৃথিবী থেকে থাইল্যান্ডে বেড়াতে আসেন অসংখ্য পর্যটক, দর্শনার্থী। প্রাকৃতিক রূপ লাবণ্যে ভরা থাইল্যান্ডে অসংখ্য দর্শনীয় স্থান রয়েছে, যা আগত দর্শনার্থীদের ব্যাপক আনন্দ দেয়। এ থাইল্যান্ড হলো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি দেশ, যা বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বে মিয়ানমারের পরেই অবস্থিত। বিখ্যাত সাদা হাতির দেশ নামেই দেশটি অতি সুপরিচিত। শুধু চিকিৎসার জন্যই নয়, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার পর্যটনের জন্য ব্যাপক জনপ্রিয় গন্তব্যর অন্যতম একটি হলো থাইল্যান্ড। থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংকক। ফ্রায়া নদীর তীরে গড়ে ওঠা ব্যাংকক থাইল্যান্ড উপসাগরের বেশ কাছে অবস্থিত প্রাণবন্ত একটি শহর। রঙিন শহর নামেও পরিচিতি আছে ব্যাংককের। তাই এ রঙিন শহরে গিয়ে নিজেদের সজীব করে তুলতে ভ্রমণপিপাসুরা তাদের পছন্দের তালিকায় ব্যাংককে সব সময়ই প্রাধান্য দিয়ে থাকে। তাই আমার এবারের ট্যুর ডেস্টিনেশনে প্রথমে ছিল রঙিন এ থাইল্যান্ড।
করোনা তাণ্ডবে লণ্ডভণ্ড হয়ে থমকে যাওয়া বিশ্বের কোয়ারেন্টাইন বিহীন ভ্রমণ শুরু হয়েছে মাত্র থাইল্যান্ডে। ইমিগ্রেশনের কাজ শেষ করে এয়ারপোর্ট থেকে সেই সুসজ্জিত আলো ঝলমলে বাহারি মাইক্রোবাসে করে চলে গেলাম আগেই বুকিং করে রাখা সুকম্ভিত এরিয়ার হোটেল অ্যাম্বাসেডরে। এয়ারপোর্ট থেকে চাইলে বাসে করে অথবা এমআরটি বা স্কাই ট্রেনে করেও যাওয়া যায় সুকম্ভিত এরিয়ায়। সে ক্ষেত্রে নামতে হয় অশোক বা নানা প্লাজা স্টেশনে। বাংলাদেশিরা থাইল্যান্ড ঘুরতে এলে সাধারণত এ এরিয়াতেই থাকেন। এখানে বাংলাদেশি ১৫০০-২০০০ টাকায়ও হোটেল পাওয়া যায়। ফ্যামেলি নিয়ে গেলে ৩০০০-৩৫০০ টাকার মধ্যে বেশ ভালো হোটেলে আয়েশ করে থাকতে পারবেন। এর চেয়ে আরও ভালো হোটেল পেতে চাইলে ৩ তারকা ৪ তারকা বা ৫ তারকা হোটেলে যেতে পারেন। হোটেলে পৌঁছতে স্থানীয় সময় প্রায় ৮টা বেজে গেল। চেক ইন করে ফ্রেশ হয়ে বাইরে বের হলাম। স্ট্রিট ফুড আর নানা রসালো ফলের জন্যও বিখ্যাত বলা যায় ব্যাংকককে। তাই বেরিয়ে ঘুরে ফিরে দেখে স্ট্রিটফুডে রাতে ডিনার সেরে নিলাম। টুকটাক কেনাকাটা করে হোটেলে ফিরে ক্লান্ত শরীর বিছানায় এলিয়ে দিয়েই ঘুম।
Advertisement
সকালের ব্যাংকক শহর ভিন্ন। সুনসান না হলেও একেবারে সরগরম না। লোকজনের ছোটাছুটি অফিসমুখি। নেই জ্যামজট আর গাড়ির হর্ন। যে যার মতো পায়ে হেঁটে গাড়িতে ছুটে চলছে গন্তব্যে। অ্যাম্বাসেডরের রেস্টুরেন্টে গেলাম ব্রেকফাস্ট করতে। রেস্টুরেন্ট তো নয় যেন বিশাল কর্মযজ্ঞ। উপরে নিচে মিলিয়ে কয়েকশ মানুষের খাবারের আয়োজন। ব্যুফের আয়োজনে বাহারি খাবার সাজিয়ে দেওয়া। মারুফ ভাইসহ ব্রেকফাস্ট করে রুমে ফিরে এলাম। মারুফ লিয়াকত ভাইয়ের মিটিং আছে, আর আমি ফ্রি। দুজনে মিলে প্ল্যান করে উনি মিটিংয়ে গেলেন আর আমি ব্যাংকক শহর দেখতে বের হলাম। স্থানীয় মার্কেট গুলোতে ঢুঁ মারার ইচ্ছে। ব্যাংকক ইন্দ্রা মার্কেট (অনেকটা ঢাকার নিউ মার্কেটের মতো), এমবিকে মার্কেট (এখানে দাম একটু বেশি), চাতুচক মার্কেট, প্লাতুনাম (এখানে বেশ সস্তায় কেনাকাটা করতে পারবেন), বিগ সি, চায়না টাউন থেকে ঘুরে ঘুরে কিনতে পারবেন ব্যাংককের নানা জিনিস। বিশেষ করে ব্যাগ, স্যান্ডেল ও মেয়েদের নানা ধরনের গহনা। আবার সিয়াম সেন্টারের বিপরীতে বেশ কিছু দোকান আছে। ছেলেদের জিনিস কেনার জন্য ‘রবিনসন’ ভালো।
হোটেল থেকে বেরিয়ে নানা স্টেশনের দিকে হাঁটছি। উদ্দেশ্য চাতুচক যাবো। বিদেশের মাটিতে আয়েশে চলার জন্য গুগল ম্যাপই আমার একমাত্র ভরসা। সুকম্ভিত এরিয়ার অশোক স্টেশন থেকে বিটিএস এমআরটি করে মো-চিত গিয়েছি চাতুচক মার্কেট যাবো বলে। ওখানে ঘুরে ফিরে সামান্য কেনাকাটা আর খাওয়া-দাওয়া করে আবার আশোক বা নানাতে ফিরে আসবো। কারণ এখানেই পাশেই আমাদের অ্যাম্বাসেডর হোটেল। তো মো-চিত থেকে ফিরে আসার সময়ে স্কাই ট্রেন সিয়াম ষ্টেশন থেকে ভিন্ন রুটে ব্যাং ওয়া চলে যাবে, তাই স্কাই ট্রেন চেঞ্জ করার বারবার ঘোষণা আসছিল, যা আমি খেয়াল করিনি। ফলে যা হওয়ার তা-ই হয়েছে। স্কাই ট্রেন সিয়াম ছেড়ে ভিন্ন রুটে সিলম পার হওয়ার পরই বুঝেছি আমি ভুল রুটে আছি। দ্রুত রাতচাদামরি নেমে আবার সিয়াম এলাম। ওখান থেকে আরেক স্কাই ট্রেনে চেপে নানা স্টেশনে এসেছি। দারুণ এক অভিজ্ঞতা। এই বিদেশে এসেও ভুল করছি আর শিখছি। বিকেলে বেরিয়েছি মারুফ ভাইসহ। ঘুরে দেখেছি শপিং মলগুলো। চষে বেড়িয়েছি নাইট মার্কেটসহ নানা জায়গায়।
দেখার কী নেই এ ব্যাংকক শহরে! গ্র্যান্ড প্যালেস, সাফারি ওয়ার্ল্ড, রিভার ক্রুজ, ওয়াট অরুন, ওয়াট ফ্রা কাইয়াগ, লুমফিনি পার্ক, বেঞ্চিকিতি পার্ক, চায়না টাউন, মাদাম তুসো মিউজিয়াম, আয়ুতাহায়া হিসট্রিক্যাল পার্কসহ আরও অনেক কিছুই। সুকম্ভিত এরিয়ায় বেশ কিছু ট্যুর অপারেটর রয়েছে, যাদের মাধ্যমে এসব স্পট ঘুরে দেখা যায়। অথবা নিজে নিজেও দেখা সম্ভব। এসব দেখার জন্য বাস, ট্রেন, ট্যাক্সি সবই আছে। বাসে টাকা কম সময় লাগে বেশি, স্কাই ট্রেনে টাকা বেশি সময় লাগে কম। থাই জনগণ কিন্তু খুব বেশি ইংলিশ জানে না। তবে পর্যটন নির্ভর হওয়ায় কাজ হয়ে যায় সবই। অনেকেই বাংলাদেশে ভালো থাই খাবার খোঁজেন, আবার থাইল্যান্ডে গিয়ে বাঙালি খাবার খোঁজেন। অদ্ভুত বাঙালি। বাংলাদেশে যা পাওয়া যায়, তা বাংলাদেশি থাই। থাইল্যান্ডে গিয়ে থাই খাবার খাওয়া অনেক কঠিন। কেমন জানি গন্ধ আর আধা সেদ্ধ। তবে ম্যাকডোনাল্ড’স, কেএফসি, বার্গার কিংসহ নামিদামি সব ফুড ব্র্যান্ডই রয়েছে মোড়ে মোড়ে। খুব সহজেই পছন্দমতো খাবার খাওয়া যায়। এ ছাড়াও সুকম্ভিত এরিয়ায় একটু খুঁজলেই বাঙালি ও ইন্ডিয়ান খাবার পাওয়া যায় অহরহ।
তবে ব্যাংককে মোটরসাইকেল ভাড়া নেওয়া যায়। যদিও আমি সেই সুযোগ নিইনি। ট্যাক্সিতে করে ঘুরেঘুরে রাতজাগা শহরও উপভোগ করেছি। পায়ে হেঁটেছি ব্যাংককের পথে পথে। খেয়েছি সুস্বাদু তাজা নানা ফল। দিনের আর রাতের ব্যাংককের মধ্যে মেলা পার্থক্য। চোখে না দেখলে বোঝা যাবে না। রাতে যেন আলোর রাজ্য হয়ে ওঠে এ শহর। রাতে নানা প্লাজার পাশেই মরোক্কোয়ান রেস্টুরেন্টে ডিনার করেছি। অসাধারণ খাবারগুলো, দামও তুলনামূলকভাবে কম। তবে পরিবেশটা মনে রাখার মতো। রাতের খাবার খেয়েই হোটেলে ফিরেছি। পরদিন ভোরে উঠেই ফ্রেশ হয়ে নিচে নেমে হাঁটলাম কিছু সময়। ব্যাংককে আজকে শেষদিন। তাই নাস্তাটা বাইরে করবো ভাবছি। চলে গেলাম মেইন রোড ধরে। নানা স্টেশনের পাশেই একটা ক্যাফে। দুজনে দুটি আলাদা সেট ব্রেকফাস্ট মেন্যু অর্ডার করলাম। গেমস ক্যাফে। অসাধারণ ক্যাফে কাম বার। মনে রাখার মতো ছিল ব্রেকফাস্টটা। শেষ করেই হোটেলে ফিরে ব্যাগ নিয়ে ট্যাক্সিতে করে রওনা দিই ডন মিয়াং বিমানবন্দরের উদ্দেশে।
Advertisement
বিমানবন্দরের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে উঠে বসলাম নক এয়ারের বিমানে। প্রায় সোয়া একঘণ্টা উড়ে চলে গেলাম পাহাড়ি দ্বীপের নগরী ফুকেটে।
চলবে...
লেখক: ফাউন্ডার অ্যান্ড সিইও, মেডিস্টোরবিডি ডটকম।
এসইউ/জিকেএস