অর্থনীতি

এক ডিমের উৎপাদন খরচ সাড়ে ১০ টাকা

খামারে মুরগির একটি ডিম উৎপাদনে খরচ হচ্ছে ১০ টাকা ৪৪ পয়সা। সেই ডিম কয়েক হাত ঘুরে খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে সাড়ে ১২ টাকায়। খুচরা বাজারে ডিমের দাম এক দশকে বেড়েছে ৩১২ শতাংশ। অন্যদিকে একই সময়ে খামারে একটি ডিমের উৎপাদন খরচ বেড়েছে ৩২১ শতাংশ।

Advertisement

২০১৩ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত উৎপাদন ও বাজারের দামের তথ্য বিশ্লেষণে এ পরিসংখ্যান দিয়েছে বাংলাদেশ এনিম্যাল এগ্রিকালচার সোসাইটি (বিএএএস)।

সংগঠনটি বলছে, একটি ডিম উৎপাদনে খাবারের (ফিড) খরচই প্রায় ৮০ শতাংশ। ডিমের দাম ও উৎপাদন খরচ যে হারে বেড়েছে, তারচেয়ে বেশি হারে বেড়েছে খাবারের দাম। ২০১৩ সালে প্রতি কেজি ফিডের দাম ছিল ১৫ টাকা, সেটি এখন ৫৮ টাকায় দাঁড়িয়েছে। একই সময়ের ব্যবধানে বৃদ্ধির হার ৩৭৮ শতাংশ।

ফিডের এ অস্বাভাবিক দামই ডিমের দাম বাড়ার প্রধান কারণ বলে মনে করছেন সাধারণ খামারিরা। পাশাপাশি বাচ্চা ও ওষুধের দাম বৃদ্ধি, বিদ্যুৎ ও পরিবহনে বাড়তি ব্যয়, দীর্ঘদিন ডিমের কম দামে উৎপাদন কমে যাওয়া এবং রোগবালাই প্রতিরোধে ব্যর্থতার কারণে ডিমের দাম হুট করে বেড়েছে বলে দেশের বেশ কয়েকটি এলাকার প্রান্তিক খামারিরা জাগো নিউজকে জানিয়েছেন।

Advertisement

জয়পুরহাট জামালগঞ্জের ডিম উৎপাদনকারী রশিদ খন্দকার জাগো নিউজকে বলেন, ফিডের দামের কারণে ডিমের বাজার অস্থির হয়েছে। বর্তমান বাজারে প্রতি বস্তা ব্রয়লার মুরগির খাবার ৩ হাজার ২০০ টাকা, সোনালি মুরগির খাবার ৩ হাজার টাকা ও লেয়ারের ২ হাজার ৭০০ টাকা দরে কিনতে হচ্ছে। যা গত বছর ৬০০ থেকে ১০০০ টাকা কম ছিল।

নিজ খামারে কয়েক হাজার লেয়ার মুরগির ডিম উৎপাদন করেন মানিকগঞ্জে সাটুরিয়া ধুল্লা গ্রামের খামারি আব্দুস সালাম। তিনি হিসাব দিয়ে বলেন, গত বছর যখন লেয়ারের খাবার ১ হাজার ৮০০ ছিল তখন এক হাজার মুরগি ডিম দেওয়া পর্যন্ত ২২৫ বস্তার মতো খাবার লেগেছে। যার দাম ছিল চার লাখ ৬ হাজার টাকা। এখন একই পরিমাণ খাবারে খরচ হচ্ছে ৬ লাখ সাড়ে ৭ হাজার টাকা। অর্থাৎ এক বছর ব্যবধানে প্রতি হাজার মুরগির খাবারে খরচ বেড়েছে ২ লাখ টাকা।

আর পড়ুন: খাদ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে চিড়েচ্যাপ্টা পোলট্রি খামারিরা

খামারিদের দেওয়া হিসাব নিয়ে বিএএএস’র প্রেসিডেন্ট মোরশেদ আলম জাগো নিউজকে বলেন, একটি ডিম উৎপাদনে প্রতিটি মুরগি ১২০ গ্রাম খাবার খায়। গড়ে প্রতি কেজি ফিডের দাম ৫৮ টাকা হিসাবে শুধু ফিডে খরচ হয় ৬ টাকা ৯৬ পয়সা। তবে শতভাগ মুরগি ডিম দেয় না, দেয় ৮০ শতাংশ। ফলে গড়ে একটি ডিমে ফিডের খরচ ৮ টাকা ৭০ পয়সা। বাকি ২০ শতাংশ খরচ ওষুধ, বাচ্চা কেনা, অবকাঠামো, খামারের খরচ, লেবার খরচ ছাড়াও অন্যান্য খরচ আছে। সে হিসাবে লাগে আরও ১ টাকা ৭৪ পয়সা। ফলে মোট খরচ ১০ টাকা ৪৪ পয়সা।

Advertisement

কয়েকজন খামারি জানিয়েছেন, একটি একদিনের বাচ্চা কেনার পর সেটি পাঁচ মাস খাবার খায়। এরপর গড়ে ২৪ মাস ডিম দেয়। এরপর ক্রমান্বয়ে এর ডিম দেওয়ার ক্ষমতা কমে আসে। তখন সেগুলো খামারিরা বাজারে বিক্রি করে দেন মাংসের মুরগি হিসেবে।

খামারি আব্দুস সালাম বলেন, লোকসান হিসেবে নিলে ডিমের দাম আরও বেশি হবে। যে কারণে দেশের অধিকাংশ খামারি এর আগে কমদামে ডিম বিক্রি করে লোকসান করেছেন। সেসব খামার বন্ধ হয়ে গেছে। এখন বাড়তি দামে খামারিদের কিছুটা লাভ হচ্ছে।

আরও পড়ুন: ডিম-মুরগির দাম বাড়িয়ে ১৫ দিনে ৫২০ কোটি টাকা লুট

একই মতামত বিএএএস’র প্রেসিডেন্ট মোরশেদ আলমেরও। তিনি বলেন, সাড়ে ১২ টাকা ডিমের বর্তমান দাম অবশ্যই যৌক্তিক। খামার ও খুচরা ডিমের দামের মধ্যে বর্তমান পার্থক্য ২ টাকা। যেখানে পরিবহন, ডিলার ও খুচরা বিক্রেতার লাভের অংশ রয়েছে। এছাড়া প্রচুর ডিম পরিবহনের সময় নষ্ট হয়ে যায় এবং ভেঙে যায়। সে কারণে ডিমের বর্তমান দাম স্বাভাবিক।

বিশালাকারের খামারের সংখ্যা বাড়ছে

তিনি বলেন, একটি কোম্পানি তার ১২ টাকার পণ্যে এরচেয়ে বেশি মুনাফা করে কিন্তু সেটা নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই। কিন্তু ডিমের ক্ষেত্রে সমস্যা সবার।

এদিকে দেশে বর্তমানে ডিমের বাজারের আকার ২৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি। ছোট খামারি থেকে বড় বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠানও এ খাতে বিনিয়োগ করেছে। সবমিলে বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা।

মুরগির খাবারের প্রধান উপকরণ ভুট্টা ও সয়াবিন। বিএএএস’র তথ্য বলছে, দেশে এক কেজি ভুট্টার দাম এখন ৪০ টাকা। যা ২০১৩ সালে ১৮ টাকা ছিল। একইভাবে সয়াবিনের দাম ২০ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৭০ টাকা। এ দুই খাবারের দাম বেড়েছে যথাক্রমে ২২২ ও ৩৫০ শতাংশ। এছাড়া একই সময়ে চালের কুড়ার দাম ৪০০ শতাংশ বেড়ে প্রতি কেজি ৮ টাকা থেকে ৩২ টাকায় উঠেছে। বেড়েছে সয়ামিলের দামও।

ফিড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে মুরগির খাবার তৈরিতে ব্যবহৃত ২২টি উপকরণের মধ্যে ১৯টির দাম বেড়েছে। এর মধ্যে ১৫টি উপকরণের মূল্য দ্বিগুণ হয়েছে। এছাড়া ডলারের দাম ৯৪ টাকা থেকে ১০৭ টাকা হয়েছে। ফলে বেড়েছে মুরগির খাবারের দাম।

আরও পড়ুন: সিন্ডিকেট নির্মূলে ‘পোল্ট্রি বোর্ড’ গঠনের দাবি

তবে খামারিদের মধ্যে একটি অংশ ফিডের দামকে যৌক্তিক মনে করেন না। তারা বলছেন, করপোরেট কোম্পানিগুলো ফিডের দাম অস্বাভাবিক বাড়িয়ে ডিমের দাম বাড়াতে বাধ্য করছে। তারা বলছেন, এ খাতে বেশ কিছু ‘অস্পষ্টতা’ রয়েছে। সে অস্পষ্টতার সুযোগ নিয়ে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো নানা ধরনের অনিয়ম করছে। বাজার দখলের জন্য মরিয়া হয়েছে।

সাধারণ খামারিদের সংগঠন বাংলাদেশ পোল্ট্রি আ্যসোসিয়েশনের সভাপতি সুমন হাওলাদার বলেন, আমাদের দেশে যারা ফিড তৈরি করছেন, সেখানে কাঁচামালে মনোপলি হচ্ছে। কেউ ফিডে মনোপলি করছে, কেউ ডিমে মনোপলি করছে। শুধু ফিডের দাম কমালেই ডিমের দাম কমবে।

তিনি বলেন, পুরো সিস্টেমটা একটি সিন্ডিকেটের হাতে গেছে। যে কারণে সাধারণ খামার বন্ধ হয়ে এক লাখ ৬০ হাজার থেকে এখন শুধু ৬০ হাজারে নেমেছে। এরমধ্যে আবার ২০ হাজারের মতো খামার কন্ট্রাক্টে (চুক্তিতে) নিয়েছে কোম্পানিগুলো। ফলে সাধারণ খামারিরা মার খাচ্ছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ডিমের দাম বাড়লেও তারা নায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

এনএইচ/এমএইচআর/এএসএম