ফাত্তাহ তানভীর রানা
Advertisement
বেলা ১২টায় হাসপাতাল থেকে বের হলাম। আমার ইকো, ইসিজিসহ সব টেস্টের ফলাফল পজেটিভ আসায় ভাবলাম কোথাও ঘুরে আসি। বাসায় এসে ব্যাগ রেখে একাই বেরিয়ে পড়লাম লোটাস মন্দির দেখতে। মেট্রোরেল ধরে লাজপত নগর থেকে এলাম কালকাজি মন্দিরে স্টেশনে।
তবে ট্রেন থেকে নামলেও স্টেশন থেকে নড়ছি না! মনে হলো এই ট্রেনের শেষ স্টেশন কোথায়? আর কতটুকুই বা সময় লাগে? আমি তখন দিল্লিতে নতুন, সবকিছু ঠিক মতো চিনে উঠতে পারিনি।
যথানির্দিষ্ট নিয়মে গুগলের শরণাপন্ন হলাম। দেখলাম শেষ স্টেশন তো রাজা নাহর সিংহ স্টেশন। এই রাজা তো ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের নেতা ছিলেন। সেখানে রাজার বাড়িও আছে।
Advertisement
এবার টিকিট/টোকেন জমা দিয়ে, আবার মেট্রোরেলের টিকেট কেটে রওনা দিলাম অভিষ্ঠ লক্ষ্যে। গন্তব্য পর্যন্ত মেট্রোরেলের ভাড়া ছিল ৫০ রুপি। লোটাস টেম্পল শহরে পরে কখনো ঢুঁ মারা যাবে!
মেট্রোরেলে যাওয়ার সময় গোবিন্দপুরি, তুঘলকবাদ, নেহেরু প্লেস, এপোলো জসোলা, ফরিদাবাদসহ অনেক স্টেশন পেরিয়ে যেতে হলো। অবশেষে ৫০ মিনিট পর রাজা নাহর সিং স্টেশনে নেমে পড়লাম।
তবে পেটে অনেক ক্ষুধা! কয়েক মিনিট হাঁটার পরে একটা হোটেল পেলাম। বাহ! সেখানে তো মিষ্টির বাহার! রসগোল্লা, স্পঞ্জ মিষ্টি, ঝিলাপি, ছানা মিষ্টি, লাড্ডুও আছে। তবে এখানে এরা কিঞ্চিত ভিন্ন বা কাছাকাছি নামে ডাকে। আমি জিলাপি আর লাড্ডু দিয়ে লুচি খেলাম।
এরপর হাঁটতে হাঁটতে হাটের ভেতর দিয়ে কয়েক মিনিট যেতেই চোখে পড়লো রাজা নাহর সিংয়ের বাড়ির প্রাচীর। তারপর বাইরের গেট দিয়ে ঢুকতেই একটা গাড়ি চোখে পড়লো।
Advertisement
আরও ভেতরে মূল গেটে যেতেই মনে হলো জনমানবহীন। কিছুক্ষণ পড়ে একজন এগিয়ে এলেন। আমি পরিচয় দিতেই তিনি ২০ রুপির একটা রশিদ ধরিয়ে দিলেন। মহলের সব জায়গায় যাওয়া নিষেধ।
কারণ এখন এটি মোটেল। যারা বিভিন্ন রুম ভাড়া নিয়ে আছেন, তাদের প্রাইভেসি নষ্ট করা যাবে না। অতঃপর, মোটেল এরিয়া ছাড়া বাকিটুকু ভালো করে দেখতে শুরু করলাম। পর্যটকদের জন্য পুরো বাড়িটি দর্শনের অনুমতি নেই।
রাজা নাহর সিংহ যেখানে বাস করতেন, সম্ভবত আবাসিক অংশটুকু মোটেল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বাকি অংশ উঠান, উদ্যান, পূজা ঘর, ছাদ, বসার জায়গাসহ অন্যান্য এরিয়া ভালো মতো দেখলাম।
মহলের রাস্তার উল্টো দিকে রাজা নাহর সিংহ পার্কের দেখা গেল গুগলে। সেখানে ছোট পার্ক থাকলেও একটা অফিসের সাইনবোর্ড ও অন্যান্য ভবন দেখা গেল।
রাজার বাড়ির ছাদ, বেলকনি, বসার চেয়ার, পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থাসহ সব কিছুতেই নান্দনিকতার ছোঁয়া আছে। সতেরো শতকে নির্মিত বিল্ডিং যেন এখনো নতুন!
রাজার বাড়িতে এক রাত থাকতে হলে কমপক্ষে ২৫০০ রুপি দিয়ে শুরু করতে হবে। রুমভেদে সুবিধা হিসেবে ভাড়া আরও বেশি হবে। এখানে খাবারের ব্যবস্থাও আছে। আপনিও চাইলে এক রাত নিরিবিলি পরিবেশে রাজার বাড়িতে থাকার অভিজ্ঞতা নিতে করতে পারেন।
এবার রাজা নাহর সিংহ সম্পর্কে কিছু তত্য জেনে নিন। রাজা নাহর সিংহ ১৮২৩ সালের ৬ এপ্রিল জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ১৮৩০ সালে মারা যান, তখন তার বয়স ৭ বছর। চাচা নাভাল সিংহ তাকে প্রতিপালন করেছিলেন।
নাহর সিংহ অপ্রাপ্তবয়স্ক থাকায় নাভাল সিংহ রাজ্য পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। নাহর সিংহ ১৮৩৯ সালে রাজ্যের রাজার মুকুট পরেন। তার শিক্ষকদের মধ্যে মৌলভী রহমান খান ও পণ্ডিত কুলকার্নিসহ অনেকেই ছিলেন।
রাজা নাহর সিংহ একজন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের নেতা ছিলেন। তিনি হরিয়ানার ফরিদাবাদ জেলার বল্লভগড়ের রাজা ছিলেন। তাঁর পূর্বপুরুষ হলেন তেওতিয়ার গোত্রের জাট রাজা। ব্রিটিশ ভারতে তখন বেশ কিছু জাট রাজা ছিলেন। তারা আনুমানিক ১৭৩৯ সালের দিকে ফরিদাবাদে একটি কেল্লা নির্মাণ করেছিলেন।
রাজা নাহর সিংহ ১৮৫৭ সালে ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনে বিদ্রোহী ছিলেন। রাজা নাহর সিংহের সৈনিকদের সেনাপতি ভূরা সিংহ বাল্মীকি, গুলাব সিং ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বল্লভগড় সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। রাজা নাহর সিংহের সঙ্গে গুলাব সিংকেও ১৮৫৮ সালের ৯ জানয়ারি চাঁদনি চকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল।
এখন রাজার মহল সরকারি মোটেল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এখানে শুধু পর্যটকরাই নন বরং রাত্রিযাপনের জন্য ভিড় করেন অতিথিরা। পাশাপাশি বিয়ের অনুষ্ঠান অথবা নাটক-সিনেমার শুটিংয়ের জন্য মহল ভাড়া পাওয়া যায়। দিল্লি থেকে বল্লভগড়ে শুধু মেট্রোরেল নয় বাসে বা প্রাইভেট কারেও আসা যায়।
মোটেল থেকে বেরিয়ে আবার হাঁটের ভেতর দিয়ে হাঁটছি আর ভাবছি রাজা নেই তো কি হয়েছে? রাজার নাম তো আছে। দেখলাম বল্লভগড় হাঁট ঘুরে নিলাম। সময় গড়িয়ে বিকেল হয়ে যাচ্ছে এবার ফেরার পালা।
বাসস্ট্যান্ডের পাশে একটি সাধারণ মানের খাবার হোটেলে ঢুকলাম। মোটেলের এক কর্মচারীর কাছে শুনেছিলাম, বল্লভগড়ের রুটি ও ডালের সুনাম আছে। আমি সেই সুযোগ ছেড়ে দিলাম না।
খাবার খেতে খেতে হোটেলের মালিকের সঙ্গে কথা বললাম। আমার হিন্দি বুঝতে ও পড়তে সমস্যা হচ্ছিল, তবে বাংলাদেশি হিসেবে তিনি অত্যন্ত আন্তরিকতাপূর্ণ ব্যবহার করলেন।
রাজা নাহর সিংহ দেশের স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিয়েছেন। অনেক রাজা বা দাপটশালী জমিদার ক্ষমতায় থাকার জন্য ইংরেজ বাহিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন। রাজা নাহর সিংহ দেশের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেননি। মেট্রোরেলের এই স্টেশনের নাম রাজার নামে নামকরণ করা না হলে, একজন ভিনদেশি হিসেবে আমার হয়তো সেখানে যাওয়া হত না।
তবে বল্লভগড় গিয়ে ভালো লেগেছে এই ভেবে যে, ইতিহাস পাঠের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ নিজ চোখে দেখা হলো। রাজা নাহর সিংহসহ ইতিহাস থেকে হারিয়ে যাওয়া ব্রিটিশ বিরোধী সব ত্যাগীদের স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই।
লেখক: ব্যাংকার ও গল্পকার
জেএমএস/এমএস