মতামত

ঘটনা সামান্য নাকি বড় কিছু

১৭ অক্টোবর দৈনিক সংবাদপত্রে দুটি খবর ছাপা হয়েছে। একটি হলো গত ৪ অক্টোবর গ্রিড বিপর্যয়ের ঘটনায় দায়িত্বে অবহেলার দায়ে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের (পিজিসিবি) দুই প্রকোশলীকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। এরা হলেন পিজিসিবির উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী (এসসিএমডি, ঢাকা-১) আল্লামা হাসান বখতিয়ার এবং সহকারী প্রকৌশলী (এসপিএমডি, ঢাকা-১) মো. মোস্তাফিজুর রহমান।

Advertisement

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ সাংবাদিকদের বলেছেন, বিদ্যুৎবিভ্রাটের ঘটনায় মোট তিনটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছিল। এর মধ্যে পিজিসিবির তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, দুই কর্মকর্তার অবহেলার বিষয়টি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় তাদের বরখাস্ত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এই দুই প্রকৌশলী ঘোড়াশাল সাব-স্টেশনের কিছু কাজ ভুলভাবে করেছিলেন বলেই ওই স্টেশনটি ট্রিপ করে যায়। তবে গ্রিড বিপর্যয়ের জন্য মুখ রক্ষার উপায় হিসেবে এই দুই প্রকৌশলীকে বলির পাঁঠা বানানো হলো কি না, সে প্রশ্নও উঠছে।

বিদ্যুৎখাতের অনিয়ম নিয়ে অনেক কথা আছে। জরুরিভাবে বিদ্যুৎ সংকট নিরসন করতে গিয়ে পরিকল্পিতভাবে না এগিয়ে এমন কিছু চটজলদি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, যেগুলো সাময়িক উপশম দিলেও স্থায়ী সমাধানের বদলে এখন বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্যাপক অর্থ ব্যয় হয়েছে, ব্যক্তিবিশেষের পকেটভারি হয়েছে, দুর্নীতি-অনিয়ম সবই হয়েছে কিন্তু এখন পুরো অব্যবস্থাপনা ও অদূরদর্শিতার কারণে একে একে অনেক কিছু মুখ থুবড়ে পড়ার উপক্রম হয়েছে।

দুজন প্রকৌশলীকে সাময়িক চাকরিচ্যুত করে একটি কিছু করা হলো ধরে নিয়ে নীতিনির্ধারকরা স্বস্তি বোধ করতে পারেন কিন্তু এটা টেকসই সমাধান নয়। ব্যবস্থাপনার গলদ ব্যাপক। যারা লাভের বখরা বাড়ানোর নানা প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত তাদের দিকে নজর না দিয়ে আইওয়াশ করার পদক্ষেপ বিপদ না কমিয়ে বাড়াবে। বাইরে চুনকাম করে ফিটফাট দেখানোর পরিবর্তে আসলে নজর দেওয়া দরকার ভেতরের মরচে পড়া বিষয়গুলোর দিকে।

Advertisement

সহজ কাজ করে বাহবা কুড়ানোর প্রবণতা পরিহার করে বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয় কঠিন বিষয়গুলোর প্রতি মনোযোগ দেবে কি? বিদ্যুৎ উৎপাদন, সঞ্চালন লাইনসহ সামগ্রিক বিষয়টি আধুনিকায়ন করার কোনো বিকল্প যে নেই, সেটা বুঝতে হবে তাদের যারা নীতিনির্ধারণ করেন।

দ্বিতীয় খবরটি হলো, মেয়াদ শেষের আগেই তথ্য সচিব মো. মকবুল হোসেনকে অবসরে পাঠানো। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে তাকে অবসরে পাঠানোর কথা জানানো হয়েছে। মকবুল হোসেন জানিয়েছেন, তিনি অবসরের জন্য আবেদন করেননি। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন আসছে, কি এমন হলো, যার জন্য এই সচিবকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হলো? তিনি কি গুরুতর কোনো অনিয়মের সঙ্গে জড়িত? অথবা সরকারের সঙ্গে কি কোনো নীতিগত বিরোধে জড়িয়েছিলেন তিনি? এসব প্রশ্নের জবাব এখনই পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না।

তবে রোববার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব কে এম আলী আজমের স্বাক্ষরে অবসরের যে প্রজ্ঞাপন দেওয়া হয় তাতে বলা হয়েছে, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মকবুল হোসেনকে সরকারি চাকরি আইন-২০১৮-এর ধারা ৪৫ অনুযায়ী জনস্বার্থে সরকারি চাকরি থেকে অবসর দেওয়া হলো। জনস্বার্থে জারিকৃত এ আদেশ অবিলম্বে কার্যকর হবে বলেও জানানো হয়েছে প্রজ্ঞাপনে।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদায় যৌথ মূলধন কোম্পানির ফার্মসমূহের পরিদপ্তরের নিবন্ধক পদে কর্মরত থাকাকালে ২০২১ সালের ৩০ মে সরকার তাকে সচিব পদে পদোন্নতি দিয়ে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ে পদায়ন করে। ২০২৩ সালের ২৫ অক্টোবর তার অবসরে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তার আগেই কী কারণে তাকে অবসরে পাঠানো হলো, সে বিষয়ে কিছু জানা যায়নি। তবে এ ঘটনা নিয়ে প্রশাসনে নানা গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে। যে যার মতো করে নানা আলোচনা করছেন।

Advertisement

জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী মো. ফরহাদ হোসেন গণমাধ্যমের কাছে বলেছেন, সরকারি চাকরিতে ২৫ বছর হলে সরকার যে কাউকে অবসরে পাঠাতে পারে। বিষয়টি গুরুতর কিছু নয় বলেও জানান প্রতিমন্ত্রী। তবু আচমকা কেন অবসর- এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, এটা এমন কিছু নয়, সরকারের নিজস্ব ব্যাপার।

কুষ্টিয়ায় জন্ম নেয়া মকবুল বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডারের দশম ব্যাচের কর্মকর্তা হিসেবে ১৯৯১ সালে সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। ২০২১ সালের ৩১ মে তথ্য মন্ত্রণালয়ে যোগ দেন। তথ্য মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ এক কর্মকর্তা বলেন, কী কারণে বাধ্যতামূলক অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে, সেটা আমার জানা নেই। তবে তার চাকরির বয়স আরও একবছর বাকি ছিল। এ বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নে তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, তাকে অবসর দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে- এটা জেনেছি। কিন্তু কেন অবসর দেওয়া হলো, সে বিষয়ে আমি অবহিত নই।

তবে যে ধারায় মকবুল হোসেনকে অবসরে পাঠানো হয়েছে, সরকারি চাকরি আইনের সেই ধারায় (৪৫) বলা হয়েছে, কোনো সরকারি কর্মচারীর চাকরির মেয়াদ ২৫ বছর পূর্ণ হওয়ার পর যে কোনো সময় সরকার জনস্বার্থে প্রয়োজন মনে করলে কোনো কারণ দর্শানো ছাড়াই তাকে চাকরি থেকে অবসর দিতে পারবে। তবে যেক্ষেত্রে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ, রাষ্ট্রপতির অনুমোদন গ্রহণ করতে হবে।

মকবুল হোসেন বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডারের ১০ম ব্যাচের কর্মকর্তা হিসেবে ১৯৯১ সালে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে যোগদান করেন। তিনি তার চাকরি জীবনের বেশির ভাগ সময় মাঠ প্রশাসনে কর্মরত ছিলেন। মাঠ প্রশাসনে সহকারী কমিশনার, সহকারী কমিশনার (ভূমি), প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট, উপজেলা নির্বাহী অফিসার, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, জেলা পরিষদ; পরিচালক, পরিবেশ অধিদপ্তর এবং সদস্য (ভূমি ও সম্পত্তি ব্যবস্থাপনা), জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

দৈনিক কালবেলায় বিশ্বস্ত সূত্রের বরাত দিয়ে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, সীমাহীন ‘দুর্নীতি ও আর্থিক কেলেঙ্কারির’ দায়ে মকবুল হোসেনকে অবসরে পাঠানো হয়েছে। কালবেলায় বলা হয়েছে, সচিব পদে যোগদানের পর থেকেই তথ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন সব দপ্তর ও সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পদোন্নতির ফাইল আটকে ঘুস নিতেন সচিব মকবুল। অনেক গুরুত্বপূর্ণ ফাইল মন্ত্রীর দপ্তরকে অবহিত না করেই তিনি অনুমোদন দিতেন। এছাড়া বাংলাদেশ টেলিভিশন, বাংলাদেশ বেতারসহ মন্ত্রণালয়ের অধীন অন্যান্য দপ্তর ও সংস্থার উন্নয়ন প্রকল্পের কাজে কোটি কোটি টাকার দরপত্র বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। বিভিন্ন সময় সচিব মকবুল হোসেনের দুর্নীতির নানা বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়কে অবহিত করে।

এর আগের কর্মস্থলেও নাকি তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ছিল। তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে বদলি হয়ে উন্নয়নমূলক কাজে বেশি সম্পৃক্ত কোনো মন্ত্রণালয়ে সচিবের দায়িত্ব পেতে কয়েক মাস ধরে তিনি ব্যাপক তদবির করছিলেন বলেও খবরে বলা হয়েছে। তার বিষয়ে জানতে পেরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্ষুব্ধ হওয়ার তথ্যও খবরে আছে।

সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, দপ্তর, বিভাগ, সংস্থার দুর্নীতি অনিয়মের খবর নিয়মিতই শোনা যায়। মন্ত্রী, সচিবসহ বিভিন্ন সংস্থার এমডিদের দুর্নীতির খবর এখন আলোচিত বিষয়। কিন্তু দুর্নীতি কিংবা কাজে গাফিলতি বা অন্য কোনো অভিযোগে কারও বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণের নজির খুব একটি দেখা যায় না। সরকারের বিরুদ্ধে কত বিষয়ে কত অভিযোগ করে আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার পতনের লাইনে আছে বিএনপি।

সরকার বিরোধীদের কোনো অভিযোগ আমলে নেয় না। তথ্য সচিব মকবুল হোসেনকে অবসরে পাঠিয়ে সরকার অন্য দুর্নীতিবাজদের কোনো সতর্ক সংকেত দিল না কি এটা খুবই মামুলি একটি বিষয় তা এখনো স্পষ্ট নয়। তবে সরকার অ্যাকশনে থাকলে জনমনে কিছুটা চনমনে ভাব তৈরি হয় বৈকি!

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট।

এইচআর/ফারুক/জিকেএস