শেখ রাসেল এক মায়াবী মুখের প্রতিচ্ছবি। ফোটার আগেই ঝরে যাওয়া এক রক্ত গোলাপের কলি। ঝরে না গেলে আজ যে গোলাপ গন্ধ বিলাতো। দেশ ও সমাজ গঠনে বোনের পাশে থেকে রাখতো ইতিবাচক ভূমিকা। অনুপ্রেরণার উৎস হতো বড় বোনের সব মানবিক কর্মকাণ্ডের। সেই হতভাগ্য শিশুটি জন্মের সময় পাশে পায়নি পিতাকে। মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার আগেও দেখা পায়নি পিতার।
Advertisement
১৯৬৪ সাল। এক অস্থির সময় পূর্ব পাকিস্তানজুড়ে। লড়াই আর যুদ্ধে উত্তেজনামুখর চারদিক। পাকিস্তানজুড়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ডামাডোল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে অংশ নেওয়া প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ফাতেমা জিন্নাহর নির্বাচনী প্রচারণায় ব্যস্ত। ১৯৬৪ সালে ১৮ অক্টোবর নির্বাচনী প্রচারণায় চট্টগ্রামে বঙ্গবন্ধু। ওইদিনই ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক বাড়িটি আলোকিত করে পৃথিবীর বুকে এক নতুন অতিথির আগমন। রাজনৈতিক ব্যস্ততায় প্রিয় সন্তানের জন্মদিনেও পাশে থাকতে পারেননি বঙ্গবন্ধু।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রিয় লেখক ছিলেন বার্ট্রান্ড রাসেল। পৃথিবীর বিখ্যাত দার্শনিক, সাহিত্যে নোবেল পাওয়া বার্ট্রান্ড রাসেল পারমাণবিক যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনের একজন বড় ধরনের নেতাও ছিলেন। বিশ্বশান্তি রক্ষায় বিশ্ব মানবতার প্রতীক হয়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন এই মানবিক নেতা। বড় হয়ে নিজ শিশু পুত্র এমন মানবিকতার আলোয় আলোকিত হবে এই মহৎ আশায় বঙ্গবন্ধু তাঁর কনিষ্ঠ সন্তানের নাম রেখেছিলেন শেখ রাসেল।
শিশু রাসেলের জীবনের বেশির ভাগ সময় কেটেছে বাবাকে ছাড়া। রাজনৈতিক কারণে পিতা বঙ্গবন্ধুর জীবনের অধিকাংশ সময়ই কেটেছে কারাগারে। তাই পিতাকে বেশি সময় কাছে পায়নি শেখ রাসেল। বাবাকে কাছে না পেয়ে মা ফজিলাতুন নেছা মুজিবকেই আব্বা বলে ডাকতেন শিশু রাসেল।
Advertisement
আদরের ছোট ভাই শেখ রাসেলকে নিয়ে অনেক বেদনাময় স্মৃতি এখনো দু’চোখে অশ্রু ঝড়ায় বড় বোন শেখ হাসিনার দু’চোখে। নিজের লেখা, ‘আমাদের ছোট রাসেল সোনা’ বইয়ের ২১ পৃষ্ঠায় কারাগারে পিতার সাথে সাক্ষাৎ করতে যাওয়ার বিষয়ে শেখ হাসিনা লিখেছেন, ‘আব্বার সঙ্গে প্রতি ১৫ দিন পর আমরা দেখা করতে যেতাম। রাসেলকে নিয়ে গেলে ও আর আসতে চাইতো না। খুবই কান্নাকাটি করতো। ওকে বোঝানো হয়েছিল যে আব্বার বাসা জেলখানা আর আমরা আব্বার বাসায় বেড়াতে এসেছি। আমরা বাসায় ফেরত যাব। বেশ কষ্ট করেই ওকে বাসায় ফিরিয়ে আনা হতো। আর আব্বার মনের অবস্থা কী হতো তা আমরা বুঝতে পারতাম। বাসায় আব্বার জন্য কান্নাকাটি করলে মা ওকে বুঝাতেন এবং মাকে আব্বা বলে ডাকতে শেখাতেন। মাকেই আব্বা বলে ডাকতো ।”
শিশু রাসেলের দুরন্তপনা, বাইসাইকেলে ঘুরে বেড়ানো, নানান আবদার এখনো কাঁদায় বড় বোন শেখ হাসিনাকে।
শেখ রাসেলের জন্মের যেমন ইতিহাস আছে, আছে নাম রাখারও ইতিহাস। তার চেয়ে করুণ ও বেদনার ইতিহাস আছে মাত্র ১১ বছর বয়সে মা-বাবার লাশের পাশে ঘাতকের বুলেটে ঝাঝরা হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীনতাবিরোধী ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রে সপরিবারে প্রাণ হারায় বঙ্গবন্ধু। ঘাতকদের নৃশংসতা থেকে রক্ষা পায়নি বঙ্গবন্ধুর শিশুপুত্র শেখ রাসেলও।
নিজেকে বাঁচাতে সেন্টিপোস্টের পেছনে লুকিয়ে ছিল ১১ বছরের এই শিশু। পরিবারের সবাইকে হত্যা করে ঘাতকরা খুঁজে বেড়ায় শেখ রাসেলকে। ঘাতকরা যখন তাঁকে খুঁজে পায় তখনও শেখ রাসেল জানে না পৃথিবীতে আর বেঁচে নেই তার বাবা-মা। ভয় পেয়ে রাসেল কাঁদতে থাকে আর বলে, ‘আমাকে মেরোনা, আমাকে মায়ের কাছে নিয়ে যাও। ঘাতকরা টানতে টানতে নিয়ে যায় দোতলায়। বাবা-মায়ের রক্তাক্ত লাশ দেখে চমকে উঠে সে, কাঁদতে থাকে অঝোরে। নিষ্ঠুর ঘাতকরা মায়ের কাছে নিয়ে গুলি করে ঝাঝরা করে দেয় শেখ রাসেলকে। রাসেলের নিথর দেহ ঢলে পড়ে মৃত মায়ের লাশের ওপর।
Advertisement
এমন নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। কী অন্যায় ছিল শেখ রাসেলের? সেদিন কোথায় ছিল মানবতা? রাসেলের বুক ফাটা চিৎকার ও আর্তনাদের কোনো মূল্য ছিল না ঘাতকদের কাছে। বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতার স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শিশুপুত্র শেখ রাসেলের এই মৃত্যুর বেদনার ইতিহাস এখনো ঘাতক ও তাদের রাজনৈতিক উত্তরসূরিদের মনে কোনো রেখাপাত করতে পারেনি। বিচারহীনতার সংস্কৃতি চালু করে ইনডেমিনিটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার বন্ধের নামে শিশু রাসেল হত্যার বিচারও বন্ধ ছিল।
মানবাধিকার রক্ষার নামে যারা বিভিন্ন সময় শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের বিরুদ্ধে আঙুল তোলেন। সমালোচনায় তোলেন বিতর্কের ঝড়। আজ পর্যন্ত সেই সুশীল সমাজের কয়জন শিশু রাসেল হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে কথা বলছেন? বিচার চেয়েছেন সেই হত্যাকাণ্ডের?
ইতিহাসের খলনায়ক জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা করে বিভিন্ন দূতাবাসে পদায়ন করেছেন খুনিদের। সেই জিয়াউর রহমানের বিচার দাবি করেছেন বা সমালোচনা করেছেন কজন মানবাধিকার নেতা? সেদিন মানবাধিকার ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। বঙ্গবন্ধুর হত্যার নীলনকশাকারী ও নেপথ্য কুশীলবদের মুখোশ উন্মোচনের আজ সময়ের দাবি, ঠিক তেমনি শিশু রাসেলের হত্যাকারীদের মুখোশ উন্মোচন করা হোক।
শিশু রাসেল আজ শিশু অধিকার আদায়ের প্রতীক। যখনই গণমাধ্যমে শিশু নির্যাতন বা হত্যার খবর প্রকাশিত হয়, আমাদের চোখে ভেসে ওঠে রাসেলের প্রতিচ্ছবি। আমরা চাই শিশুর অধিকার, তাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্য ও বাসযোগ্য পৃথিবীর নিশ্চিত করার পাশাপাশি শিশু নির্যাতন বন্ধের কার্যকরী পদক্ষেপ নেবেন সরকার। শিশুদের অধিকার আদায়ের প্রতীক হয়ে সবার মাঝে বেঁচে থাকুক শেখ রাসেল। শেখ রাসেলের শুভ জন্মদিনে এমন প্রত্যাশা সবার।
লেখক: ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সহ-সভাপতি ও বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য।
এইচআর/ফারুক/জিকেএস