জাতীয়

লোডশেডিংয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে জনভোগান্তি

লোডশেডিংয়ে অতিষ্ঠ রাজধানীসহ সারাদেশের মানুষ। প্রতিদিন কয়েক দফা লোডশেডিং করা হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, কোনো কোনো অঞ্চলে দৈনিক তিন-চার ঘণ্টা আবার কোথাও বা ১২-১৫ ঘণ্টাও থাকছে বিদুৎবিহীন। সেপ্টেম্বরের তুলনায় অক্টোবরে লোডশেডিং বেড়েছে কয়েকগুণ। এতে দিন দিন মানুষের দুর্ভোগ তীব্রতর হচ্ছে। সবচেয়ে বেশি ভোগান্তি পোহাচ্ছেন রাজধানী ঢাকার বাসিন্দারা। অসহনীয় এ পরিস্থিতিতে জনমনে বাড়ছে ক্ষোভ, উৎকণ্ঠা।

Advertisement

বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম বাড়ার পরিপ্রেক্ষিতে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের লক্ষ্যে গত ১৯ জুলাই থেকে সারাদেশে শিডিউল করে প্রতিদিন এক ঘণ্টা লোডশেডিং করার ঘোষণা দিয়েছিল সরকার। সেপ্টেম্বরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে বলে তখন আশ্বস্ত করেছিল বিদ্যুৎ বিভাগ। কিন্তু সে আশ্বাস হালে পানি পায়নি। অক্টোবরের শুরু থেকে লোডশেডিং আরও প্রকট আকার ধারণ করে। এরই মধ্যে গত ৫ অক্টোবর হঠাৎ জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনে বিপর্যয় ঘটে। এরপর থেকে লোডশেডিং বাড়ে অস্বাভাবিক মাত্রায়। নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে পুরো বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থা।

অক্টোবরে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন হওয়ার ঘোষণা থাকলেও সরকারের জ্বালানি বিভাগ তা পিছিয়ে এখন নভেম্বরের কথা বলছে। তবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম বাড়ার পাশাপাশি যে অর্থনৈতিক সংকট ঘনীভূত হচ্ছে, তাতে নভেম্বরেও দেশে লোডশেডিং কমবে কি না, তা নিয়ে সংশয় কাটছে না মানুষের।

সারাদেশে চলমান লোডশেডিং পরিস্থিতি নিয়ে তৃণমূলে গ্রাহক পর্যায় থেকে শুরু করে বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থার কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছে জাগো নিউজ। এসব কথোপকথনে ওঠে এসেছে বর্তমান বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনার হালচাল, জনভোগান্তি ও সম্ভাব্য ভবিষ্যতের চিত্র।

Advertisement

নীলফামারী সার্কিট হাউজ এলাকার বাসিন্দা শরিফুল ইসলাম জানিয়েছেন, তার এলাকায় প্রতিদিন গড়ে আধঘণ্টা করে দুই থেকে তিনবার করে লোডশেডিং করা হচ্ছে। ফেনীর বাসিন্দা আহসান জুবায়ের জানান, তার এলাকায় দিনরাত মিলিয়ে বড়জোর ছয় ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে। হবিগঞ্জের মাধবপুর থেকে মনিরুল ইসলাম জানান, দৈনিক অন্তত চার ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে না। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের মোমিনুল রাকিব জানান, এক ঘণ্টা করে প্রতিদিন তিন-চারবার লোডশেডিং করা হচ্ছে। সাভারের সোবহানবাগ এলাকার তাজরী মিন শিমুল জানান, প্রতি দুই ঘণ্টা লোডশেডিংয়ের পর মাত্র ৩০-৪০ মিনিট বিদ্যুৎ পাচ্ছেন।

কথা হয় মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার উচুটিয়া গ্রামের মো. শরিফ হোসেন, সিঙ্গাইর উপজেলার লিতু ও কবির, ঘিওরের পেচারকান্দা গ্রামের মোজাম্মিল হোসেন হাবিবুল্লাহ, রাঙ্গামাটির কাউখালীর আরিফুল হক মাহবুব, নোয়াখালীর কবিরহাটের তানজিদ হোসাইন রাফী, জামালপুরের ইসলামপুর উপজেলার মুশফিকা ফেরদাউস মাহিদা এবং মাদারীপুরের বাসিন্দা রকিব তালুকদারের সঙ্গে। সেসব এলাকার বাসিন্দারাও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। জানিয়েছেন, মাত্রাতিরিক্ত লোডশেডিংয়ে জনজীবন বিপর্যস্ত

তবে মফস্বল শহরগুলোর তুলনায় লোডশেডিংয়ে দুর্ভোগ বেশি ঢাকাবাসীর। ইট-পাথর আর তীব্র কোলাহলের এ মহানগরীতে দিন দিন বাড়ছে লোডিশেডিংয়ের পরিমাণ। এতে অতিষ্ঠ নগরবাসী। রাজধানীর কোনো কোনো এলাকায় দিনরাত মিলিয়ে চার-পাঁচবার লোডশেডিং করা হচ্ছে। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ৬-৭ ঘণ্টাই বিদ্যুৎ পাচ্ছেন না ঢাকার মানুষ। এমনকি মধ্যরাতেও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে এসি বা ফ্যানের পাখা। এ অসহনীয় অবস্থা থেকে মুক্তি মিলবে কবে- এ প্রশ্নই এখন ঢাকার বাসিন্দাদের।

রাজধানীর বনশ্রী এলাকার বাসিন্দা কাজী সোহেল রানা জাগো নিউজকে জানান, তার এলাকায় দিনরাত মিলিয়ে এক ঘণ্টা করে অন্তত চারবার লোডশেডিং করা হচ্ছে। কুড়িলের কামাল হোসাইন জানিয়েছেন, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অন্তত ছয় ঘণ্টা বিদ্যুৎবিহীন থাকতে হচ্ছে তাদের। পূর্ব জুরাইনের আহসান হাবিব জানান, তার এলাকায় দিনে কমপক্ষে দুই ঘণ্টা লোডশেডিং করা হচ্ছে। উত্তরা-৬ নম্বর সেক্টরের জহিরুল ইসলাম সাদ্দাম জানান, সকাল থেকে দুপুর পর্যন্তই তিনবার বিদ্যুৎ চলে যাচ্ছে। তেজগাঁওয়ের নাখালপাড়া থেকে অরিন হাসান জানান, প্রতিদিন এক ঘণ্টা করে অন্তত দু-তিনবার লোডশেডিং করা হচ্ছে।

Advertisement

মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা সুমাইয়া রহমানের সঙ্গে কথা বলে একই তথ্য জানা যায়। মিরপুরের কাজীপাড়ার সাঈফ ওমর আহমেদ জানান, দিনরাত মিলিয়ে এক থেকে দেড় ঘণ্টা করে অন্তত তিন-চারবার বিদ্যুৎ চলে যাচ্ছে। অভিন্ন তথ্য ওঠে এসেছে রাজধানীর বাড্ডা, মান্ডা, খিলগাঁও, মুগদা, রামপুরা, ধানমন্ডি এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথায়।

এলএনজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) আমদানিতে ভাটা পড়ায় ব্যাহত হচ্ছে বিদ্যুৎ উৎপাদন। এ অবস্থায় শুরুতে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের কথা বলে রোস্টার করে লোডশেডিং কার্যক্রম শুরু করে সরকারের জ্বালানি বিভাগ। তবে লোডশেডিং বাড়ার বিষয়ে অনেকটা কৌশলী অবস্থান নেন বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। গত ১১ অক্টোবর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, স্পট মার্কেটে এলএনজির দাম বাড়ায় আমদানি বন্ধ রেখেছে সরকার। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদনও কমিয়ে দিতে হয়েছে। গরম কমে চাহিদা কমলে বিদ্যুৎ ম্যানেজ করতে পারবো। এর একদিন আগেই তিনি জনগণকে ধৈর্য ধরতে বলেন। অক্টোবরের পর বিদ্যুতের কষ্ট কমবে বলে জানান।

গত ৭ অক্টোবর এক সংবাদ সম্মেলনে জ্বালানি মন্ত্রী বলেছিলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে অস্থিরতার কারণে আপাতত দেশে জ্বালানি তেলের দাম কমার সম্ভাবনা নেই। তবে লোডশেডিং আগের চেয়ে কমেছে বলে দাবি করেন তিনি।

দেশের ১৩৩টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে গ্যাসচালিত ৫৭টি। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তেল-গ্যাস মিলিয়ে বর্তমানে ৩৮টি কেন্দ্রই জ্বালানি সংকটে উৎপাদন বন্ধ রেখেছে। বেশ কিছু কেন্দ্রে চলছে আংশিক উৎপাদন। গত সেপ্টেম্বরে বিদ্যুৎ সচিব হাবিবুর রহমান জাগো নিউজকে জানিয়েছিলেন, তেল বা গ্যাসচালিত কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্রই বন্ধ নেই। বন্ধগুলো বরং সচল করা হচ্ছে।

সেপ্টেম্বরের শুরুর দিকে পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন জাগো নিউজকে জানান, স্বাভাবিক চাহিদা ১৫ হাজার মেগাওয়াট হলেও সরকার বিভিন্নভাবে চাহিদা কমিয়ে সাড়ে ১৩ হাজার মেগাওয়াটে নিয়ে এসেছে। প্রতিদিন মাত্র ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ লোডশেডিং করা হচ্ছে।

তবে মাত্র এক মাসের ব্যবধানে দৈনিক ৫০০ মেগাওয়াট লোডশেডিং বেড়ে এখন প্রায় দেড় থেকে দুই হাজার মেগাওয়াটে গিয়ে ঠেকেছে। সম্প্রতি পিডিবির এক কর্মকর্তা এমন তথ্যই জানিয়েছেন। অর্থাৎ আগে প্রতিদিন এক ঘণ্টা করে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রেখে ৫০০ মেগাওয়াট লোডশেডিং করা হতো। এখন দিনরাত মিলিয়ে চার-পাঁচ ঘণ্টা করে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখা হচ্ছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই লোডশেডিংয়ের পরিমাণ সেপ্টেম্বরের তুলনায় অক্টোবরে কয়েকগুণ বেড়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পিডিবির এক কর্মকর্তা জাগো নিউজকে জানান, গত সপ্তাহে একদিনে সর্বনিম্ন লোডশেডিং ছিল ১ হাজার ১১২ মেগাওয়াট। সর্বোচ্চ ১ হাজার ৯৩৭ মেগাওয়াট।

অর্থাৎ সর্বোচ্চ লোডশেডিংয়ের দিন কোনো অঞ্চলে দিনে তিন-চার ঘণ্টা আবার কোথাও ১০-১২ ঘণ্টা বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখা হয়।

এ বিষয়ে পিডিবি চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. মাহবুবুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, কিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ আছে এটা ঠিক। তবে স্বাভাবিক সময়ও নিয়মিত আমাদের কোনো না কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্র কারিগরি হোক বা অন্য কোনো কারণে বন্ধ রাখতে হয়। বর্তমানে তেল-গ্যাসের সংকট তো রয়েছেই। এছাড়া জাতীয় গ্রিডে সমস্যার কারণে বাড়তি কিছু কেন্দ্র বন্ধ রাখতে হচ্ছে। সমস্যা সমাধান হলে সেসব কেন্দ্র চালু হয়ে যাবে।

তিনি বলেন, গরম কমলে বিদ্যুতের চাহিদা কমবে। তখন লোডশেডিংও কমে আসবে। এর মধ্যে আন্তর্জাতিক বাজারের অস্থিরতা কাটলে তেল-গ্যাস আমদানি স্বাভাবিক হবে। তখন বিদ্যুৎ সংকট এবং লোডশেডিংয়ের ভোগান্তি দ্রুত নিরসন হবে।

এমআইএস/এমকেআর/এমএস/জেআইএম