মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমানের গড়া জাতীয়তাবাদী দলের মহাসমাবেশে অন্যান্য নেতার সঙ্গে বক্তৃতা করলেন সাজাপ্রাপ্ত এক যুদ্ধাপরাধীর সন্তান। যুদ্ধাপরাধীদের তিনি শহীদ হিসেবে আখ্যায়িত করলেন, শুধু তাই নয় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার দায়ে আওয়ামী লীগকে তার ভাষায় শহীদদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ক্ষমা চাইতে হবে, তাও বললেন।
Advertisement
এমন বক্তব্য দেওয়ার পর স্বাভাবিক কারণেই প্রশ্ন জাগে, বিএনপিও কি এই মতকে লালন করে কি না। দীর্ঘ সময় পর্যন্ত চলা সমাবেশে সিনিয়র নেতারা বক্তব্য রেখেছেন, সভার সভাপতিসহ কেউই এই বক্তব্যের বিষয়ে কিছু বলেননি। যার অর্থ দাঁড়ায় যুদ্ধাপরাধীদের শহীদ বলা এবং যুদ্ধাপরাধীর বিচারের জন্য ক্ষমা চাইতে বলাটা তাদের দলীয় বিশ্বাস হিসেবে গণ্য হয়ে যায়।
যদিও পরদিন বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী সমাবেশের ওই বক্তব্যকে যুদ্ধাপরাধীর সন্তানের ব্যক্তিগত অভিমত হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। দলীয় সমাবেশে কোনো বক্তা কি দলের আদর্শবিরোধী এবং ব্যক্তিগত বক্তৃতা করতে পারেন কি, প্রশ্নটি স্বাভাবিকভাবেই এসে যায়। ধরা যাক, ওই বক্তা তার ব্যক্তিগত অভিমতই প্রকাশ করেছেন।
যে বিএনপি মনে করে, তাদের দলের শ্রষ্ঠা জিয়াউর রহমান বীর উত্তম একজন মহান মুক্তিযোদ্ধা এবং তারা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে লালন করেন অর্থাৎ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধকে তাদের দলের চালিকাশক্তি হিসেবে ভাবেন। তাহলে দলের আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে যাওয়া বক্তব্যের জন্য কি তাদের ওই নেতাকে কারণ দর্শানো হয়েছে? কিংবা তাদের দলীয় মহাসমাবেশে এমন বক্তব্য দেওয়ার জন্য তারা কি ক্ষমা চেয়েছেন? এই নিবন্ধ লেখা পর্যন্ত বিএনপির মন্তব্য হিসেবে এটুকুই জানা গেছে যে, বিএনপির সমাবেশে দেওয়া বিএনপির নেতার বক্তব্যটি তার ব্যক্তিগত অভিমত।
Advertisement
রহস্য জাগে, ওই বিএনপি নেতা গুম হয়ে গিয়েছেন এমন অভিযোগ আগে করা হয়েছে। বিএনপি সরকারকে গুম করার অপরাধে সবসময়ই সরকারকে অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড় করায়। কিন্তু তাদের এই নেতার গুম হওয়া এবং প্রকাশ হওয়ার বিষয়ে এখন তারা কি বলবে?
গুম হওয়া ব্যক্তি গুম অবস্থায়ই জানতে পারলেন ১২ অক্টোবর চট্টগ্রামে বিএনপির মহাসমাবেশ হবে, তাই সমাবেশের আগের দিন তিনি গুম থেকে মুক্তি পেলেন। তিনি গুম হয়ে থাকা অবস্থায়ই তাকে জানিয়ে দেওয়া হলো যে সমাবেশে তুমি বক্তৃতা করবে।
এমনটা কি ভাবা যায় না, কথিত গুম হওয়া এবং রহস্যজনকভাবে মহাসমাবেশের পূর্বক্ষণে ঢাকার বাসায় ফিরে আসার পর। ঘটনাক্রম বিশ্লেষণ করলে এটাই অনুমান হয়, তিনি আত্মগোপনে থেকে গুমের নাটক সাজিয়েছেন। এবং এই গুমের নাটকের নাট্য পরিচালক হচ্ছে বিএনপি।
গুম হওয়া নেতা বলেছেন, তাকে কে বা কারা গুম করে রেখেছিল, কোথায় তিনি ছিলেন কিছুই জানেন না। শুধু তাই নয়, তাকে কে বা কারা বাসার সামনে সমাবেশের আগের দিন রেখে গেছে তাও তিনি জানেন না। মাসের পর মাস গুম থাকা অবস্থায় তিনি জানতে পারেননি তিনি কোথায় গুম ছিলেন। তাকে বাসায় পৌঁছে দিলো কারা সেটাও তিনি বলতে পারবেন না। সবকিছুই রহস্যজনক নয় কি?
Advertisement
যখন বিএনপিতে যুদ্ধাপরাধী আব্দুল আলীম এবং যুদ্ধাপরাধী সাকা চৌধুরীর ছেলেদের কেন্দ্রীয় পদে আসীন করা হয়, তখন তারা বলেছিল বাবার অপরাধে সন্তান অপরাধী নয়। আজ প্রকাশ্য সমাবেশে বিএনপির কেন্দ্রীয় প্রায় সব সিনিয়র নেতার সামনে যখন সাজাপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধীদের শহীদ বলা হলো এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার দায়ে যখন আওয়ামী লীগকে ক্ষমা চাওয়ার কথা বলা হলো, তখনও কি তাদের মনে হয় না, যুদ্ধাপরাধীর সন্তান হওয়াটা অপরাধ নয়, তারা যুদ্ধাপরাধীর রক্ত শুধু ধারণই করে না, বাংলাদেশবিরোধী মানসিকতাও পোষণ করে এবং সরাসরি মুক্তিযুদ্ধ বিরোধিতা করেছে।
সুতরাং বিএনপিকে এখন বলতে হবে, তারাও কি পাকিস্তানি বাহিনীর দোসরদের পক্ষে অর্থাৎ জিয়াউর রহমান যাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন তাদেরই সংগঠন এখন বিএনপি? যদি বিএনপি বাংলাদেশবিরোধী মানসিকতার লোকদের তাদের দলে স্থান দিয়ে রাখে এবং ত্রিশ লাখ মানুষের রক্তের শত্রু প্রায় সাড়ে সাত কোটি মানুষের মরণ যন্ত্রণা দানকারীদের লালন করে, তাহলে তাদের বলতে হবে তারা আদৌ মুক্তিযুদ্ধকে স্বীকার করেন কি না। কিংবা জিয়াউর রহমান এদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন কি না।
এই নিবন্ধ লেখার সময় পর্যন্ত কথিত গুম হওয়া নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছে এমন সংবাদ প্রকাশ হয়নি। যে স্বাধীনতাবিরোধী এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কারণে আওয়ামী লীগকে যুদ্ধাপরাধীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ক্ষমা চাওয়ার মতো ঔদ্ধত্যপূর্ণ কথা বলতে পারে, যে/যারা গুম হয়ে গিয়েছিল বলে সরকারকে বিশ্বব্যাপী জবাব দিতে হয়েছে, শুধু তাই নয় আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র যেই অভিযোগে বাংলাদেশ সরকারের কয়েকজন কর্মকর্তার আমেরিকা ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা প্রদান করেছে। রাষ্ট্রের এমন ক্ষতি যার এবং যাদের দ্বারা হয়েছে, তাদের আইনের আওতায় আনা রাষ্ট্রের দায়িত্ব বলে মনে করি।
যদি নিজে থেকে গুম হয়ে যাওয়াদের বিচার না হয়, তাহলে দেশে এমন গুমের ঘটনা বাড়তেই থাকবে। আর আমেরিকার মতো আরও কোনো দেশও যদি নিষেধাজ্ঞা দেয়, তাতেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। তাই গুম রহস্য উদ্ঘাটন হওয়া জরুরি বলে মনে করি। ঘাপটি মেরে থাকা স্বাধীনতাবিরোধীদের পথ রুদ্ধ করার জন্য, যারাই স্বাধীনতাবিরোধী, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী বক্তব্য রাখবে তাদেরও বিচার হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করি।
সবশেষে মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমানের সৃষ্টি দল বিএনপিকে স্পষ্ট করতে হবে, আসলে তাদের দলের আদর্শ-লক্ষ্য কি? এবং মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তির লালন করে তারা মুক্তিযুদ্ধের দল এমন বলার অধিকার রাখে কি না।
সম্প্রতি অন্যতম যুদ্ধাপরাধী দল জামায়াতকে বিএনপি জোটে রাখা হবে কি হবে না এ নিয়ে বিতর্ক শুনেছি। তাদের সামনে স্পষ্ট হয়ে গেছে, যুদ্ধাপরাধীদের জোটে কেন, তাদের নিজ দলেই রাখা হয়েছে। ভবিষ্যতেও বাংলাদেশবিরোধী স্বাধীনতাবিরোধীদের আরও ঢোকানোর পরও তারা দাবি করবে, তাদের দলের প্রতিষ্ঠাতা একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং তারা মুক্তিযোদ্ধার দল। দু’মুখো নীতি নিয়েই কি চলবে তারা?
লেখক: সাংবাদিক, মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ও শিশুসাহিত্যিক।
এইচআর/ফারুক/এমএস