বাংলাদেশের রাজনীতিতে মূল সংসদ নির্বাচনের চেয়ে উপ-নির্বাচন মাঝে মাঝে বড় আলোচনার জন্ম দেয়। বিএনপি ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় ১৯৯৪ সালে মাগুরা-২ আসনে উপ-নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ ওঠে। এরপর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আন্দোলনের মুখে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি সংবিধানে যোগ করতে বাধ্য হয়েছিল বিএনপি।
Advertisement
সাম্প্রতিক কালের বড় আলোচনার জন্ম দিল গাইবান্ধা-৫ আসনের উপ-নির্বাচন। ঢাকায় বসে সিসি ক্যামেরায় গোপন কক্ষে একাধিক ব্যক্তির প্রবেশসহ ব্যাপক অনিয়ম দেখে গাইবান্ধা-৫ (ফুলছড়ি-সাঘাটা) আসনের উপ-নির্বাচন বন্ধ করে দিল নির্বাচন কমিশন।
এখনই বলা যাচ্ছে না, সামগ্রিক রাজনীতিতে এই ঘটনা কী ফলাফল বয়ে আনবে। তবে এমনভাবে নির্বাচন বন্ধ করে দেওয়ার নজির আমাদের স্মরণে নেই। আইনে নির্বাচন কমিশনকে যে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে সেটা প্রয়োগ করে কাজী হাবিবুল আওয়াল ও তার সহকর্মীরা সেই ক্ষমতার সর্বোচ্চ প্রয়োগ করলেন। তাই স্বাভাবিক কারণে এখন প্রশংসায় ভাসছে কমিশন যদিও এই সিদ্ধান্তের বিপক্ষেও কম কথা হচ্ছে না।
সকাল থেকেই একের পর এক অনিয়মের খবর আসতে থাকলে ৫১টি কেন্দ্র বন্ধ ঘোষণা করে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছিলেন নির্বাচন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। সিইসি ঠিক কি বলেছিলেন সেটা তুলে ধরলে এই নির্বাচনের একটা চিত্র পাওয়া যায়। তিনি বলেন, আমরা প্রথম থেকেই লক্ষ্য করেছি ভোটগ্রহণে অনিয়ম হচ্ছে এবং অনেকের গোপন কক্ষে অনুপ্রবেশ লক্ষ্য করছে। অবৈধভাবে প্রবেশ করে ভোটারকে ভোট দিতে সহায়তা বা বাধ্য করছে- এটা সুস্পষ্ট লক্ষ্য করেছি। যেটি নিয়ম নয়। অনেকের গায়ে যে পোশাক, সেখানে প্রতীক ছাপানো ছিল। মেয়েদের একই রকমের শাড়ি, ওড়না ছিল যেটা নির্বাচনী আচরণবিধির পরিপন্থি। আমাদের দৃষ্টিতে মনে হয়েছে- একটি পক্ষ বা একজন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ভোট প্রভাবিত করতে পারছেন। ফলে সুষ্ঠু নির্বাচন গ্রহণ সম্ভব হচ্ছে না। এ অবস্থায় অর্ধশত ভোটকেন্দ্র বাতিলের পর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়ায় আইন-কানুন পর্যালোচনা করে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
Advertisement
বক্তব্য পরিষ্কার। কিন্তু পিকচার আভি বাকি হে -এর মতো বলতে হয় সামনের পথ আরও বন্ধুর। একটি মাত্র আসন, তাও উপ-নির্বাচন। নেই কোন বড় প্রতিদ্বন্দ্বী। তাই কমিশন সিসিটিভির মাধ্যমে কেন্দ্র পর্যবেক্ষণ করতে পেরেছেন, ব্যবস্থা নিতে পেরেছেন। কী হবে সেই আসল দিনে যেদিন সারাদেশে ৩০০ আসনে লাখ লাখ কেন্দ্রে ভোট হবে? কেমন করে ব্যবস্থা নেবেন তিনি যদি পরিস্থিতি এমন হয়?
ইভিএম মেশিনের পক্ষে সব দল ও মতের গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়নি এখনো। মেশিনের একটি বড় ইতিবাচক দিক হলো ভোটারকে কেন্দ্র পর্যন্ত আসতে হয়, আঙুলের ছাপ মেলাতে হয়। ফলে তার ভোটটা আরেকজনের পক্ষে দিয়ে দেওয়া সম্ভব হয় না। কিন্তু মানবসৃষ্ট দুর্যোগ ঠিকই থাকল। ভোটারকে সহযোগিতার নামে জোর করে বা কারসাজি করে বুথে ঢুকে একটি নির্ধারিত প্রতীকে ভোট দিয়ে দেওয়া বা দিতে বাধ্য করার মধ্য দিয়ে এই মেশিন নিয়ে বড় প্রশ্ন উঠল। প্রশ্ন উঠল মাঠ পর্যায়ের প্রশাসনের আন্তরিকতা ও সক্ষমতা নিয়ে। বলতে গেলে পুরো নির্বাচনী ব্যবস্থাপনা নিয়ে।
এই একটি উপ-নির্বাচন সুন্দর করে করতে শাসক দল আওয়ামী লীগের দায়িত্ব ছিল সবচেয়ে বেশি। সেখানে দল সেটা দেখাতে পারেনি। এই আসনের ফলাফল নেতিবাচক হলেও সরকার বদলে যেতো না। আর চাপ সৃষ্টি করে, প্রভাব বিস্তার করে, বুথে নৌকা মার্কার লোক না পাঠালে দল ও প্রার্থী উভয়েরই ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হতো বলেই বিশ্বাস হয়।
সত্য সততই সরল। কিন্তু রাজনীতি সে পথে চলে না। সপক্ষে যুক্তি আর বিপক্ষের বিরোধিতাই রাজনীতির সারবস্তু। শাসক দলের আর্থিক এবং সাংগঠনিক শক্তি অনেকটা বেশি থাকে। কিন্তু সবসময় সেটা দেখাতে হয় কি না, সেই বিচারটুকু আমাদের থাকে না।
Advertisement
জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারদের সাথে অম্ল মধুর বৈঠকে আগামী নির্বাচন সম্পর্কে কিছু বার্তা পেয়েছে কমিশন। গাইবান্ধা-৫ আসনের উপ-নির্বাচন তার জন্য এলিমেন্টারি নলেজ বলেই মনে হচ্ছে। তাই স্বভাবতই বাস্তব পরিস্থিতিকে বিচার করে সামনের দিনগুলো চলতে হবে নির্বাচন কমিশনকে।
তার আদেশ নির্দেশ প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, ভোটকেন্দ্রে দায়িত্বরত প্রিসাইডিং অফিসার, পোলিং অফিসাররা যেন মানে, তা সুনিশ্চিত করতে হবে কমিশনকে। কিন্তু একই সাথে এসব ভোটকর্মীর নিরাপত্তা নিয়েও ভাবতে হবে। কতটা চাপের মধ্যে তারা নির্বাচন করেন বা করতে হবে সেটা ভাবনায় থাকা দরকার। গোটা নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে অসহায় ভূমিকায় থাকেন কিন্তু এই ভোটকর্মীরাই।
সিইসি বলছেন, আগামী সংসদ নির্বাচন নিয়ে এখনই গান গাওয়া অবান্তর। তখন পরিস্থিতি কী থাকবে, তা এখন বলা সম্ভব নয়। তিনি ঠিকই বলেছেন, এখনই বলা সম্ভব নয়। কিন্তু এখনকার পরিস্থিতি তখনকার জন্য আগাম বার্তা দেয় এবং সেটা যে কত কঠিন হবে, তার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। তিনি হয়তো ভাবছেন, পরিস্থিতি অনুসারে পদক্ষেপ নিতে অসুবিধা হবে না।
নির্বাচনের মাঠে সবচেয়ে বড় খেলোয়াড় রাজনৈতিক দলগুলো। তাদের ভূমিকার ওপর ভোটের পরিবেশ নির্ভর করে। গণতন্ত্রকে নিশ্ছিদ্র করার স্বার্থেই দলগুলোকে আইন মেনে নির্বাচন করতে হয়, সহনশীলতা দেখাতে হয়। নির্বাচনী সংস্কৃতি যদি দখলের সংস্কৃতিতে পরিণত হয় তবে গণতন্ত্রের পক্ষে তার থেকে বড় লজ্জার ব্যাপার আর কিছুই হতে পারে না।
লেখক: প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন।
এইচআর/ফারুক/এএসএম