মতামত

চীনা কমিউনিস্ট পার্টির কুড়িতম জাতীয় কংগ্রেস ও প্রসঙ্গ কথা

১৯২১ সালের ২৩ জুলাই থেকে ৩ আগস্ট পর্যন্ত শাংহাইয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছিল চীনা কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিসি) প্রথম জাতীয় কংগ্রেস। তখন পার্টির সদস্য সংখ্যা ছিল পঞ্চাশের কিছু বেশি। অংশগ্রহণকারী প্রতিনিধিদের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে, কংগ্রেসের শেষ দিনের অধিবেশন বসেছিল চেচিয়াং প্রদেশের চিয়াসিং শহরের নানহু-র (চীনা ভাষায় ‘নান’ মানে ‘দক্ষিণ’ এবং ‘হু’ মানে ‘হ্রদ’) একটি নৌকায়। শেষ দিনের অধিবেশনে অংশগ্রহণ করেছিলেন চেয়ারম্যান মাওসহ মাত্র ১৩ জন প্রতিনিধি।

Advertisement

শেষ দিনের অধিবেশনে ‘চীনা কমিউনিস্ট পার্টির কার্যক্রম’, ‘চলমান বাস্তব কর্মসম্পর্কিত সিদ্ধান্ত’সহ বিভিন্ন দলিল গৃহীত হয়। সিদ্ধান্ত হয়, পার্টির নাম হবে ‘চীনা কমিউনিস্ট পার্টি’। ভোটাভুটির মাধ্যমে পার্টির প্রথম কেন্দ্রীয় কমিটিও নির্বাচন করা হয়। আর এভাবেই চিয়াসিংয়ের সেই ছোট্ট নৌযানে, আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিসি)। চীনের মহান বিপ্লবের সূচনাও ঘটে ঠিক তখনই।

পরবর্তীকালে সেই ছোট্ট পার্টিই তিলে তিলে বড় হয়; নয়াচীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে চীনা জনগণকে নেতৃত্ব দিয়ে জয় ছিনিয়ে আনে; একবিংশ শতকে এসে দেশকে পরিণত করে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিতে; সমাজ থেকে ঝেটিয়ে বিদায় করে হতদারিদ্র্য। প্রথম জাতীয় কংগ্রেসের সময় সিপিসি’র মোট সদস্য ছিল অর্ধশতাধিক। একশ বছর পরে এসে, সেই পার্টির সদস্য সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ১০ কোটিতে। এখন প্রতি পাঁচ বছর অন্তর পার্টির জাতীয় কংগ্রেস বসে রাজধানী বেইজিংয়ে। কংগ্রেসে সারাদেশ থেকে নির্বাচিত দুই সহস্রাধিক প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করেন। আর কদিন বাদেই সিপিসি’র ২০তম জাতীয় কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হবে।

কোভিড-১৯ মহামারি গোটা বিশ্বকে বদলে দিয়েছে। বৈশ্বিক রাজনীতিতেও এসেছে যুগান্তকারী পরিবর্তন। ইউক্রেনে রুশ বাহিনীর বিশেষ সামরিক অভিযান শুরুর পর, পরিবর্তনের উত্তাপ বেশি করে টের পাওয়া যাচ্ছে। এই উত্তাপ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি চীনের গায়েও এসে লাগছে। চীনের সামনে এখন অনেক জটিল ঝুঁকি ও চ্যালেঞ্জের হাতছানি।

Advertisement

এমনি এক প্রেক্ষাপটে, আগামী ১৬ অক্টোবর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে চীনের ক্ষমতাসীন দল সিপিসি’র ২০তম জাতীয় কংগ্রেস। এই কংগ্রেসে সিপিসিকে আগামী পাঁচ বছর বা তারও বেশি সময়ের জন্য, অগ্রগতির রোডম্যাপ উপস্থাপন করতে হবে। মনে রাখতে হবে, সামনের কয়েকটি বছর চীনের মহান পুনরুত্থানের ‘চীনা স্বপ্ন’ বাস্তবায়নের জন্যও খুবই গুরুত্বপূর্ণ সময়কাল।

২০তম জাতীয় কংগ্রেস যখন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, তখন সিপিসি চীনা জনগণকে নিয়ে একটি সচ্ছল আধুনিক সমাজতান্ত্রিক দেশ গড়ার জন্য কাজ করছে। এরই মধ্যে চীনকে মধ্যম মানের সচ্ছল সমাজ হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্য পূরণ হয়েছে; দেশ হয়েছে হতদারিদ্র্যমুক্ত। মাত্র কয়েক দশকে চীনের ৮০ কোটি মানুষকে চরম দরিদ্রতা থেকে তুলে এনেছে সিপিসি’র নেতৃত্ব। এ কাজের জন্য চূড়ান্ত বছর নির্ধারিত ছিল ২০২০ সাল। ঠিক সেই বছরই কোভিড আঘাত হানে। কিন্তু নানান প্রতিকূলতার মধ্যেও, দারিদ্র্যমুক্তির সেই লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে। এবার আরও সামনে এগিয়ে যাওয়ার পালা।

জাতীয় কংগ্রেসের চূড়ান্ত প্রস্তুতি নিতে, গত তেরসা অক্টোবর বেইজিংয়ে শুরু হয় ১৯তম সিপিসি কেন্দ্রীয় কমিটির সপ্তম পূর্ণাঙ্গ অধিবেশন। এর আগে জাতীয় কংগ্রেসের জন্য মোট ২২৯৬ জন প্রতিনিধি নির্বাচিত হন। জাতীয় কংগ্রেসে এই প্রতিনিধিরাই নেবেন গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন সিদ্ধান্ত।

আগামী পাঁচ বছরের জন্য একটি রোডম্যাপ প্রণয়নের বিষয়টি আগেই উল্লেখ করেছি। এছাড়া ২০তম জাতীয় কংগ্রেসে খুবই গুরুত্বপূর্ণ কিছু পদে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এই কংগ্রেসেই নির্বাচিত বা পুনর্নির্বাচিত হবেন পার্টির শীর্ষ নেতারা। একটি নতুন সিপিসি কেন্দ্রীয় কমিটিও নির্বাচন করা হবে। নতুন করে গঠিত হবে ‘শৃঙ্খলা পরিদর্শনের জন্য সিপিসি কেন্দ্রীয় কমিশন’। এবারের কংগ্রেসে পার্টির সংবিধান সংশোধিত হবে বলেও আশা করা হচ্ছে।

Advertisement

বোঝাই যাচ্ছে, বিভিন্ন কারণে সিপিসি’র আসন্ন জাতীয় কংগ্রেস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির ও সবচেয়ে বেশি জনসংখ্যার দেশ চীনের ক্ষমতাসীন দলের জাতীয় কংগ্রেসের গুরুত্ব শুধু চীনের জন্য নয়, বরং আন্তর্জাতিক অঙ্গনের জন্যও বটে। আন্তর্জাতিক সমাজের সাথে চীনের সম্পর্কের গতিপ্রকৃতি কেমন হবে, এক্ষেত্রে বিদ্যমান স্থিতাবস্থা (staus quo) বজায় থাকবে কি না— এমন অনেক প্রশ্নের প্রাথমিক উত্তর পাওয়া যাবে সিপিসি’র জাতীয় কংগ্রেসের ফলাফল থেকে।

পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ২০তম জাতীয় কংগ্রেসে সিপিসি’র জনকেন্দ্রিক শাসনের দর্শন এবং চীনা বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন সমাজতন্ত্র অনুসরণ অব্যাহত রাখার ওপর স্বাভাবিকভাবেই গুরুত্বারোপ করা হবে। পাশাপাশি কংগ্রেসে উন্নয়ন ও নিরাপত্তার মধ্যে সমন্বয়ের বিষয়টিও গুরুত্ব পাবে। কারণ, চীনের উন্নয়ন, সংস্কার ও উন্নমুক্তকরণ প্রক্রিয়ায় যেমন নতুন নতুন উপাদান ও পরিবর্তন যোগ হয়েছে, তেমনি বহিরাগত ঝুঁকি ও চ্যালেঞ্জও বেড়েছে।

গত জুলাইয়ে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক ও দেশের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং পার্টির সিনিয়র কর্মকর্তাদের এক কর্মশালায় সিপিসি’র আসন্ন জাতীয় কংগ্রেস সম্পর্কে তার নিজের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেন। তিনি বলেন, আগামী পাঁচ বছর পার্টির অভ্যন্তরে কৌশলগত যে-সব বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে এবং পার্টি যে-সব বড় বড় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে, সেগুলো হবে দেশের চলমান আধুনিকায়ন প্রক্রিয়ার মূল চালিকাশক্তি। সিপিসি’র ২০তম জাতীয় কংগ্রেসে এসব বিষয় ও পদক্ষেপের ওপর সবেচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হবে।

বিগত দশ বছরে চীন বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনেক অগ্রগতি অর্জন করেছে, সেকথা বলাইবাহুল্য। তবে দেশব্যাপী ভারসাম্যহীন ও অপর্যাপ্ত উন্নয়নের সমস্যা এখনও বিদ্যমান। এ ব্যাপারে নিজের উদ্বেগও প্রকাশ করেছেন সি চিন পিং। কর্মশালায় তিনি বলেন, এ সমস্যা মোকাবিলায় নতুন পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি হয়ে পড়েছে। দল ও দেশের শীর্ষ নেতা যখন কোনো সমস্যা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন, তখন তা বেশি গুরুত্ব পাবে সেটাই স্বাভাবিক। সিপিসি’র আসন্ন জাতীয় কংগ্রেসে তাই উন্নয়নের ভারসাম্যহীনতা ও অপর্যাপ্ততা হতে যাচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয়।

কর্মশালায় সি চিন পিং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ইতোমধ্যে যে বিশাল পরিবর্তন ঘটে গেছে—সেদিকেও সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তিনি বলেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে চীনের সামনে উন্নয়নের নতুন নতুন সুযোগ যেমন আছে, তেমনি আছে নানান ঝুঁকি ও চ্যালেঞ্জও। চীনের সামনে যেসব সমস্যা ও চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান, সেগুলো ক্রমশ জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। এসব সমস্যার চরিত্র মিশ্রও বটে।

এ পরিস্থিতিতে প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের বক্তব্য স্পষ্ট। পার্টিকে বর্তমানে বিদ্যমান ও ভবিষ্যতের সম্ভাব্য ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে; সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতির জন্য তৈরি থাকতে হবে; এবং যথাযথ কৌশল গ্রহণের মাধ্যমে, পরিবর্তনশীল আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি সামাল দিতে হবে। পর্যবেক্ষকরাও মোটামুটি একই ধরনের কথা বলছেন। শাংহাইয়ে অবস্থিত ইস্ট চায়না নর্মল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ছি ওয়েইফিংও বিশ্বাস করেন, সিপিসি’র জাতীয় কংগ্রেসে ভারসাম্যহীন ও অপর্যাপ্ত উন্নয়নের সমস্যা বিশেষ গুরুত্ব পাবে। তিনি বলেন, চীনা জাতির মহান পুনরুত্থানের স্বপ্ন পূরণের পথে দেশ অনেক দূর এগিয়েছে। এখন ১৪০ কোটি মানুষের চীনকে সচ্ছল ও আধুনিক সমাজতান্ত্রিক দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে গোটা জাতিকে আরও ঐক্যবদ্ধ করে সফলভাবে নেতৃত্ব দিতে হবে সিপিসিকেই। কারণ, জনগণের উন্নত ও সচ্ছল জীবনের আকাঙ্ক্ষা পূরণের দায়িত্ব ক্ষমতাসীন দলের।

পর্যবেক্ষকরা আরও বলছেন, ভবিষ্যতেও, বিশেষ করে আগামী পাঁচ বছরের জন্য চীনের প্রয়োজন শক্তিশালী নেতৃত্ব। জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে, চলমান উন্নয়ন-প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে এবং ‘চীনা স্বপ্ন’ বাস্তবায়নের স্বার্থে, সিপিসি’র নেতৃত্বে স্থিতাবস্থা বজায় থাকাও জরুরি। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক শান্তি ও উন্নয়নের জন্য চীনের প্রস্তাবিত ‘বৈশ্বিক উন্নয়ন উদ্যোগ’ এবং ‘বৈশ্বিক নিরাপত্তা উদ্যোগ’ সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মূল দায়িত্ব পালন করতে হবে সিপিসিকেই। আসন্ন জাতীয় কংগ্রেসে সিপিসি’র পক্ষ থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রতি এ ব্যাপারে যৌথভাবে কাজ করার আহ্বান পুনর্ব্যক্ত হবে বলেও তারা বিশ্বাস করেন।

শুধু চীনা বিশেষজ্ঞরা নন, বিদেশি বিশেষজ্ঞরাও সিপিসি’র আসন্ন জাতীয় কংগ্রেসের সাফল্যের ব্যাপারে আশাবাদী। বেইজিংয়ে নামিবিয়ার রাষ্ট্রদূত এলিয়া কায়ামো সম্প্রতি গণমাধ্যমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ২০তম জাতীয় কংগ্রেসের পরও সিপিসি চীনকে, চীনা জনগণকে উন্নয়নের পথে নেতৃত্ব দিয়ে যাবে বলে তিনি আশা করেন। তিনি মনে করেন, কীভাবে একটি দেশ উন্নয়নের স্বাধীন পথ অনুসরণ করতে পারে, চীন তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে ইতোমধ্যে। বেইজিংয়ে নিযু্ক্ত সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাষ্ট্রদূত আলী ওবাইদ আল দাহেরি সিপিসি’র জাতীয় কংগ্রেসের পূর্ণাঙ্গ সাফল্য কামনা করে একটি বিবৃতি দিয়েছেন। আগেই বলেছি, সিপিসি’র জাতীয় কংগ্রেস কেবল চীনের জন্য নয়, গোটা বিশ্বের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। পৃথিবী নামক আমাদের সবুজ গ্রহটা এখন পরিণত হয়েছে বিশ্বগ্রামে। এখানে সবাই একে অপরের ওপর কোনো না কোনোভাবে নির্ভরশীল। এক ইউক্রেন সংকট গোটা পৃথিবীকে কীভাবে নাড়া দিয়েছে, তা আমরা দেখছি। চীন বড় দেশ, বড় বাজার; বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি। চীনের কাছে যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ, সেটা তাই বিশ্বের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণেই, সিপিসি’র আসন্ন জাতীয় কংগ্রেসের সাফল্য যেমন চীনের জন্য চীনা জনগণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি এর সাফল্য বিশ্বের জন্য ও বিশ্ববাসীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

লেখক: বার্তা সম্পাদক, চায়না মিডিয়া গ্রুপ (সিএমজি), বেইজিং।alimulh@yahoo.com

এইচআর/ফারুক/এএসএম