মতামত

‘হারকে ঘৃণা করো’ বাংলাদেশ দলকে বলবেন কে?

ক্লাইভ লয়েড। নামটা বলতেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে মোটা ফ্রেমের চশমা পরা বিশালদেহী এক ভদ্রলোকের চেহারা। লর্ডসের ব্যালকনিতে প্রথম দুটো বিশ্বকাপের ট্রফি উঁচিয়ে ধরেছেন। কিন্তু ছবিতে খুব একটা আবেগ উচ্ছ্বাসের ছোঁয়া নেই! কারণ, ভদ্রলোক ক্রিকেট মাঠে হারকে প্রচণ্ড ঘৃণা করতেন।

Advertisement

জয়কে ধর্ম মনে করতেন। তারপরও ক্রিকেট বিধাতা তাকেও হারের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছেন। হার কি জিনিস সেটা তিনি এবং তার প্রায় প্রতিরোধ্য ওয়েস্ট ইন্ডিজও টের পেয়েছে। কিন্তু তিনি ক্লাইভ লয়েড। যিনি ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ক্রিকেটে শুধু সফলতম অধিনায়ক নন। তিনি ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটের সার্থক সংস্কারক। ক্যারিবীয় ক্রিকেটে রোমান্টিসিজম ঘরানাকে বদলে দিয়েছিলেন।

অনেকটা অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট দর্শন আমদানি করেছিলেন নিজের দলের মধ্যে। ভিভ, গ্রিনিজ, হেইন্স, হোল্ডিং, গার্নার, রবার্টস, মার্শালদের মধ্যে ‘ঘৃণা’ শব্দটাকে দারুণভাবে ঢুকিয়ে দিতে পেরেছিলেন। হারকে ঘৃণা করতে শিখিয়েছিলেন। তিনি তার দলের ক্রিকেটারদের যে দর্শনে উদ্দীপ্ত করতেন, সেখানে একটা বাক্য নাকি প্রায় থাকতো। ‘ভালো খেলে তারাই হারে, যারা প্রতিবার হারে।’ আর জিতলে খুব বেশি পিঠ চাড়ড়ে দেওয়ার নীতিতে বিশ্বাস করতেন না তিনি। বরং একটা জয়ের পরই নাকি বলতেন, ‘চল পরের সাম্রাজ্য জয়ের যুদ্ধে নেমে পড়ি।’ এভাবেই একের পর এক সাফল্যকে তাড়া করে সফল হয়েছিলেন লয়েড।

ক্লাইভ লয়েডের ক্রিকেট দর্শন এখনও তার সতীর্থদের কাছে ক্রিকেটীয় বাইবেলের বাক্য বলে মনে হয়। বছর তিনেক আগে ঢাকায় বসে গর্ডন গ্রিনিজ একটা টেলিভিশন শো-র মাঝখানে বিরতিতে বলছিলেন, ‘ক্লাইভের কাছ থেকে আমি একটা শব্দ খুব ভালো করে শিখেছিলাম। ঘৃণা। পরাজয়কে ঘৃণা করতে না পারলে জেতা যায় না। বাংলাদেশ দলের কোচিংয়ের দায়িত্ব যখন নিয়েছিলাম তখন আমার কোচিং অভিজ্ঞতা তেমন ছিল না। তবে খেলার অভিজ্ঞতা ছিল। সেটাই কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছি। আমিও দলের ক্রিকেটারদের ওটাই বোঝাতে চেয়েছি, লড়াই করে হারার মাঝে কোনো কৃতিত্ব নেই। দিন শেষে তোমরা পরাজিত দলের সদস্য। অতএব হারকে ঘৃণা করো। হারা যাবে না। দুর্ধর্ষ ক্রিকেট খেলেছি। অথচ ম্যাচটা হেরেছি। ওই দুর্ধর্ষ ক্রিকেট ইতিহাসের কাছে মূল্যহীন। ইতিহাস শুধু জয়টাকে মনে রাখবে। হারকে নয়।’

Advertisement

ক্লাইভ লয়েডের ওই তত্ত্ব প্রয়োগ করতে গিয়ে গ্রিনিজ অনেক সময় ক্রিকেটারদের কাছে অপ্রিয়ও হয়েছেন। কারণ, গর্ডনের ওই দর্শন বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা ঠিকঠাক উপলব্ধি করতে পারতেন না। ম্যাচ হারের পর লয়েড নাকি প্রায়ই বলতেন, ‘লজ্জা করে না তোমাদের! তোমরা এমন একটা দেশের প্রতিনিধিত্ব করছো যে দেশের মানুষের কাছে ক্রিকেট খেলা নয়। ধর্ম। তারা তোমাদের সাফল্যের গল্প শুনতে চায়। তোমাদের জয় দেখতে চায়। প্রতিদিনের জীবন-জীবিকার লড়াইয়ের মাঝে তোমাদের সাফল্য ওদের মনে নতুন করে জ্বালানি সরবরাহ করে, যা নিয়ে ওরা নতুন করে আবার স্বপ্ন তাড়া করে। ওই মানুষগুলোর প্রতি তোমাদের কর্তব্য আছে। সেটা ভুলে যেও না।’

বাংলাদেশের মানুষের প্রতি আমাদের ক্রিকেটারদের কর্তব্য কী সেটা নতুন করে বলার প্রয়োজন পড়ে না। তবু তাদের মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য এতো কথা লেখা। রাশিয়া- ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে হোক কিংবা কোভিড পরর্বতী অর্থনৈতিক মন্দার কারণে হোক, দেশের মানুষের বেঁচে থাকার লড়াইটা প্রতিদিন কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে যাচ্ছে।

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। লোডশেডিংয়ের যন্ত্রণা। মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্তের জীবন থমকে যাওয়ার অবস্থা। তার মধ্যেও তারা টেলিভিশনে চোখ রাখে কিংবা চলতি পথে মোবাইল সেটের স্ক্রলে চোখ রাখেন, বাংলাদেশ ক্রিকেটের খোঁজ রাখতে। একটা জয়ের জন্য মুখিয়ে থাকেন। কিন্তু মানুষগুলোর হতাশা দিন দিন বাড়ছে। কারণ, নারী দল বা পুরুষ দল কেউ তাদের মনে দাগ কাটতে পারছে না জয় দিয়ে!

হারকে ঘৃণা করার তত্ত্ব তাদের মস্তিষ্কে ঢুকেছে বলে মনে হয় না। তাই জয়ের জন্য মরণ কামড়টা তারা দিতে পারছে না! প্রাণপণ লড়ই করতে পারছে না। তাহলে বাংলাদেশ ক্রিকেটে কী কোনো মোটিভেশন এক্সপার্ট দরকার। ক্রিকেটারদের হারিয়ে যাওয়া আস্থা যিনি ফিরিয়ে দিতে পারবেন। সাকিব আল হাসানের দলের ভেতর ইতিবাচক চিন্তার তরঙ্গ পাঠাতে পারবেন যিনি। অনেকে বলেন, অতীতের সাফল্যস্মৃতি বা ছবি দলের সামনে ভাসিয়ে তুলতে পারলে অনেক সময় দল উজ্জীবিত হয়।

Advertisement

অস্ট্রেলয়ায় টি-টেয়েন্টি বিশ্বকাপের সময় সেটা জরুরি হতে পারে। ২০১৫ সালের বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে বেশ ভালো কিছু স্মৃতি আছে বাংলাদেশের। সেই স্মৃতিগুলো উসকে দেওয়ার জন্য মোটিভেশন স্পিস দেওয়ার মতো লোক বাংলাদেশ ক্রিকেটে আপাতত একজনই আছেন। মাশরাফি বিন মর্তুজা।

বিশ্বকাপ শুরুর আগে বাংলাদেশ ড্রেসিংরুমের দরজা ঠেলে মাশরাফি কী ঢুকবেন ক্রিকেটারদের কিছু বলার জন্য। কিংবা তাকে সেই আমন্ত্রণ কী জানাতে পারে না টিম ম্যানেজমেন্ট! দেশি-বিদেশি অনেকের পেছনে কাড়িকাড়ি ডলার খরচ করা হচ্ছে। কিন্তু ভালো কোনো রেজাল্ট তো আসছে না। খেলোয়াড়দের জাগিয়ে তোলার মন্ত্রটা যদি মাশরাফি একটু উচ্চারণ করেন ড্রেসিংরুমে, তাতে কিছুটা কাজ হলেও হতে পারে।

ক্লাইভ লয়েড অবশ্য ওয়েস্ট ইন্ডিজ টিমের ম্যানেজার হিসেবে তেমন সফল হতে পারেননি। তার বড় কারণ, তার ব্যক্তিত্ব। তাকে ক্যারিবীয় ক্রিকেট বোর্ডও সামলাতে পারেনি। যে কারণে তিনি সরে গিয়েছিলেন। বুঝেছিলেন তিল তিল করে গড়ে তোলা তার সাম্রাজ্যে ভাঙনের আওয়াজ শুরু হয়েছে।

মাশরাফি ম্যানেজারের দায়িত্ব নাই নিলেন। কিন্তু বাংলাদেশ দলের হারানো আত্মবিশ্বাস ফেরানোর কিছু মন্ত্র তিনি উচ্চারণ করতেই পারেন অতিথি হিসেবে বাংলাদেশ দলের ড্রেসিংরুমে। উদ্যোগটা বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডকেই নিতে হবে। তারা নেবেন কী!

লেখক: সিনিয়র ক্রীড়া সাংবাদিক, কলামিস্ট।

এইচআর/ফারুক/এএসএম