কুমিল্লার একটি সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারে বেড়ে ওঠা ডা. আহমাদ হাবিবুর রহিম এখন সরকারের প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা। এমবিবিএস পড়েছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজে। ৩৫তম বিসিএসের মাধ্যমে যোগদান করে সেবা দিয়েছেন রাঙ্গামাটির বিলাইছড়িতে। এখন নবজাতক বিষয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে।
Advertisement
হাবিবুর রহিমের ডাক্তার হওয়া এবং বিসিএস জয়ের গল্প শুনিয়েছেন জাগো নিউজকে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মোহাম্মদ রায়হান—
জাগো নিউজ: প্রথমেই আপনার শৈশব ও পড়াশোনা সম্পর্কে জানতে চাই—হাবিবুর রহিম: আমি কুমিল্লা জেলার বুড়িচং উপজেলায় একটি সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করি। অন্যদের মতো আমারও স্বাভাবিক একটা শৈশব ছিল। আমরা পাঁচ ভাই-বোন। সবার পড়ালেখার খরচ জোগানো সহজ ছিল না। আব্বু-আম্মু আমাদের কোনো সীমাবদ্ধতায় আটকে থাকতে দেননি। বাসা থেকে পড়ালেখা নিয়ে অতিরিক্ত চাপ দেওয়া হয়নি কখনো। পড়ালেখায় একটা স্বাধীনতা ছিল। পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি গল্পের বই পড়া বা অন্য সৃজনশীল কাজ করতে কোনো বাধা পাইনি। আব্বু-আম্মুর আস্থা ছিল আমার ওপর। সব সময় চেষ্টা করেছি আস্থাটা ধরে রাখতে। খুব বিলাসিতায় বড় না হলেও পড়ালেখার ব্যাপারে অবারিত সহযোগিতা পেয়েছি। পরিবারে পড়ালেখার যে কোনো প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পায়। আমরা সবাই নিজ নিজ অবস্থানে ভালো করতে পেরেছি। দরকারি কিছু চেয়েছি, অথচ পাইনি এমন হয়নি। আব্বু হোমিও চিকিৎসক। তিনি খুব করে চেয়েছেন, আমি এমবিবিএস চিকিৎসক হই। একটা সময় সেই স্বপ্ন আমার মনের মধ্যেও জায়গা করে নেয়।
জাগো নিউজ: বিসিএস নিয়ে স্বপ্ন দেখলেন কবে থেকে?হাবিবুর রহিম: সত্য বলতে কী, চিকিৎসকদের মধ্যে বিসিএস নিয়ে খুব বেশি স্বপ্ন দেখতে আমি দেখিনি। বিসিএস চিকিৎসকদের ক্যারিয়ারের স্বাভাবিক গতিধারার একটা অংশ বলা যায়। চিকিৎসকরা মূলত স্বপ্ন দেখেন দেশের ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বড় বড় ডিগ্রি নিয়ে; অনেকের স্বপ্ন থাকে উন্নত দেশের অত্যাধুনিক কোনো হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়ার বা বিশ্বখ্যাত কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা নেওয়ার। দেশে থাকতে চাইলে এখন পর্যন্ত সরকারি চাকরিতেই নিজের কাজ ভালোভাবে করার ও পেশাগতভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ তুলনামূলক বেশি। তাই চিকিৎসকরা এমবিবিএস পাস করার পর একটা সময় বিসিএস নিয়ে পড়া শুরু করেন। সাধারণ অনেক শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রে দেখেছি, তারা অনার্সের প্রথম বর্ষ থেকেই বিসিএসের প্রস্তুতি নিচ্ছেন; মেডিকেলে বিসিএস নিয়ে এতটা মেতে থাকার সুযোগ থাকে না। এখানে সিলেবাস অনেক বিশাল। নিজেকে ভালো ডাক্তার বানাতে হলে প্রচুর পড়তে হয়। তা ছাড়া বিসিএসে ঢোকার পরেও চিকিৎসকদের উচ্চশিক্ষা নিয়ে পদোন্নতির যোগ্য হতে হয়। তাই বিসিএসের তুলনায় পোস্টগ্রাজুয়েশন ডিগ্রি বেশি গুরুত্ব পায়।
Advertisement
জাগো নিউজ: বিসিএস যাত্রার গল্প শুনতে চাই, প্রস্তুতি কীভাবে নিয়েছেন?হাবিবুর রহিম: স্বাস্থ্য যেহেতু টেকনিকাল ক্যাডার, তাই এখানে প্রতিযোগিতা চিকিৎসকদের সঙ্গেই হয়। সব মিলিয়ে সবার প্রস্তুতির পরিমাণও কাছাকাছি থাকে। তবে এখন প্রতিবছর কয়েক হাজার করে চিকিৎসক পাস করে বের হচ্ছেন। প্রতিযোগিতাটা তাই বেশ তীব্র হচ্ছে। প্রস্তুতির তীব্রতাও হয়তো বাড়াতে হবে। ভালোভাবে খেয়াল রাখতে হবে, যেন বিসিএস প্রস্তুতি মেডিকেলের জ্ঞানার্জনকে বাধাগ্রস্ত না করে। বিভিন্ন কারণে অনেক চিকিৎসক স্বাস্থ্য ক্যাডারে পরীক্ষা না দিয়ে প্রশাসন, পররাষ্ট্র, পুলিশ ক্যাডারে বিসিএস পরীক্ষা দিচ্ছেন। তাদের সফলতার হারও উল্লেখযোগ্য। জেনারেল ক্যাডারে পরীক্ষা দিতে হলে প্রস্তুতির ধরন আলাদা ও বিশদ।
আমি এমবিবিএস পরীক্ষা পাসের পর যখন ইনটার্নশিপ শুরু করি; তখন ৩৫তম বিসিএসের সার্কুলার দেয়। তখন একসেট বিসিএস প্রস্তুতির বই কিনে কাজের ফাঁকে ফাঁকে পড়া শুরু করি। স্বাভাবিক কারণেই খুব বেশি পড়ার সুযোগ ছিল না। মজার ব্যাপার হলো, আমি ছোটবেলায় ক্যাডেটের জন্য ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছিলাম। আবার মেডিকেলের ভর্তি পরীক্ষার সময়েও সাধারণ জ্ঞান পড়তে হয়েছিল। এ দুটি পরীক্ষার প্রস্তুতি আমাকে বেশ সাহায্য করেছে। তা ছাড়া লেখালেখির সঙ্গে কিছুটা যুক্ত থাকায় দেশ-বিদেশের বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে ধারণা রাখতাম। ছোট ছোট বিষয়গুলো পরীক্ষার সময় আমাকে চমৎকার ভাবে সাহায্য করেছে।
প্রস্তুতি নেওয়ার সময় যেহেতু হাতে অনেক সময় ছিল না, চেষ্টা করেছি একটু কৌশলী ভাবে পড়ার। বিগত দশ বছরের পরীক্ষার প্রশ্নগুলো ভালো করে দেখে প্রশ্নের ধরনটা বুঝেছি। গুরুত্বপূর্ণ টপিকগুলো খুঁজে বের করেছি। এরপর ধারাবাহিক ভাবে গুরুত্বপূর্ণ টপিকগুলো আগে ভালো করে পড়ে এরপর কম গুরুত্বপূর্ণ টপিকের দিকে গিয়েছি। এ ছাড়া কিছু বিষয় থেকে অনেক প্রশ্ন আসবেই। যেমন- বাংলাদেশের ইতিহাস, সংবিধান, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস ইত্যাদি। এসব টপিকের ক্ষেত্রে চেষ্টা করেছি গুছিয়ে, নোট করে এমনভাবে পড়ার, যাতে একই প্রস্তুতি লিখিত ও ভাইভা পরীক্ষায় কাজ লাগানো যায়। এটি অনেক সাহায্য করেছে।
জাগো নিউজ: নতুনরা বিসিএস প্রস্তুতি কীভাবে শুরু করবেন?হাবিবুর রহিম: বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে চিকিৎসকদের জন্য ক্যারিয়ার হিসেবে বিসিএস চমৎকার একটি অপশন। সে হিসেবে দেশে থাকার সিদ্ধান্ত নিলে ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই বিসিএসের জন্য একটি প্ল্যান থাকা উচিত। তবে এমন না যে সরকারি চাকরিতে না ঢুকলে কোনো ভবিষ্যৎ নেই। এখন বেসরকারিতেও চমৎকার সব সুযোগ তৈরি হচ্ছে। সবার আগে মূল ফোকাসটা থাকতে হবে যাতে এমবিবিএসটা ভালো জ্ঞান ও দক্ষতা নিয়ে শেষ করা যায়। ইন্টার্নশিপে সর্বোচ্চ কাজ শেখা নিশ্চিত হয়। জ্ঞানের সঙ্গে দক্ষতা ও পরোপকারী মানসিকতার চমৎকার একটা মেলবন্ধন তৈরি হয়।
Advertisement
প্রস্তুতি নেওয়ার ক্ষেত্রে সেই সময়ে বিসিএসে আসন সংখ্যা কত, সেটি মাথায় রাখলে প্রস্তুতির তীব্রতা কেমন হওয়া উচিত; তার ধারণা পাওয়া যাবে। ডাক্তাররা যেহেতু সায়েন্স ব্যাকগ্রাউন্ডের, তাই বিসিএসে কিছু কিছু বিষয়ে যেমন- গণিত, মানসিক দক্ষতা, বিজ্ঞান প্রযুক্তি প্রভৃতিতে বেশ এগিয়ে থাকেন। একই পড়া বারবার অগোছালো ভাবে না পড়ে যদি একবারেই ভালো করে গুছিয়ে ধারাবাহিক ভাবে পড়া যায়, তা সুবিধাজনক ফলাফল নিয়ে আসবে।
জাগো নিউজ: বিসিএস লিখিতের জন্য কোন বিষয়গুলো ফোকাস করা উচিত?হাবিবুর রহিম: এ ক্ষেত্রেও পরামর্শ হলো, বিগত বিসিএসের প্রশ্ন থেকে ধারণা নিন। সিলেবাস অনেক বড়। অগোছালো ভাবে পড়লে কখনোই শেষ হবে না। লিখিত পরীক্ষার জন্যও নিজে নিজে কয়েকটি পরীক্ষা দিলে মূল পরীক্ষায় যথাযথ ভাবে লেখার অভ্যাস তৈরি হবে।
জাগো নিউজ: বিসিএস যাত্রায় সোশ্যাল মিডিয়া কি কোনোভাবে কাজে এসেছে?হাবিবুর রহিম: সোশ্যাল মিডিয়া আমাদের জীবনের একটি অংশ হয়ে গেছে। এখন অনলাইনে অনেক মডেল প্রশ্ন, সাজেশন পাওয়া যায়। যখন যেই পরীক্ষাই হোক, আমরা ওই পরীক্ষা সংক্রান্ত গ্রুপগুলো থেকে নানা ধরনের সাহায্য পেতে পারি। কিন্তু আমি ফেসবুকে পড়তে আসি না। পড়াশোনার ক্ষেত্রে সোশ্যাল মিডিয়া উল্টো বাধা সৃষ্টি করে বেশিরভাগ সময়ে। চেষ্টা করি, যখন পড়বো; তখন পড়ার টেবিলেই বসতে। নির্দিষ্ট টপিক জানতে হলে বিষয়টি ভালো বোঝে এমন কারো সাহায্য নেওয়া। সোশ্যাল মিডিয়ায় সময় নষ্টের বিপরীতে প্রাপ্তিটা কম। কিছু একটা খুঁজতে ফেসবুকে ঢুকেছেন; দেখা গেল কোনো একটা নোটিফিকেশন বা ভিডিও আপনাকে অন্য কোথাও নিয়ে গেছে। তাতে ঘণ্টাখানেক উধাও! তবে নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার করলে প্রস্তুতি বা নোটস ভাগাভাগি করার জন্য ভালোই কাজে লাগানো যেতে পারে।
জাগো নিউজ: আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?হাবিবুর রহিম: আমি বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে নবজাতক বিষয়ে এমডি কোর্সে পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন করছি। নবজাতক বিশেষজ্ঞ হতে পারলে আমার লক্ষ্য হলো সরকারের কর্মচারী হিসেবে যেখানেই নিযুক্ত হই; সেখানে নিজস্ব বলয়ে নবজাতক শিশুদের জীবন রক্ষায় সক্রিয় ভূমিকা রাখার। যে মাটিতে আমার জন্ম, যে সবুজে আমার বেড়ে ওঠা, যে মানুষের ভিড়ে আমার বসবাস; চেষ্টা করবো সর্বোচ্চটা দিয়ে তাদের সেবা করার।
এসইউ/এএসএম