বাংলাদেশ তথা এশিয়ায় অন্যতম আলোচিত এক অঞ্চলের নাম কাশ্মীর। এক সময় একক রাজ্য থাকা এই অঞ্চলটি বর্তমানে তিনভাগে বিভক্ত। এর মধ্যে পাকিস্তান অঞ্চলে রয়েছে আজাদ কাশ্মীর ও চীনের দখল করে নেওয়া দোখলাম। অন্যদিকে ভারতীয় ভূখণ্ডে রয়েছে জম্মু ও কাশ্মীর অঞ্চল। এক সময় এক রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত থাকলেই কাশ্মীরের দখল নেওয়া পাকিস্তান ও চীনের অঞ্চলের তুলনায় বেশ উন্নত জম্মু ও কাশ্মীর অঞ্চল। মূলত ভারত কেন্দ্রীয় সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টায় ধীরে ধীরে ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের মতোই উন্নত এক রাজ্য হিসেবে গড়ে উঠছে জম্মু কাশ্মীর অঞ্চল।
Advertisement
কাশ্মীরের সাধারণ মানুষের যোগাযোগ ব্যবস্থার বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনছে উধমপুর-শ্রীনগর-বারামুল্লা রেল প্রকল্প। সেই সঙ্গে ভারতের কাশ্মীর উপত্যকার মানুষদের কাছে সমৃদ্ধির প্রতীক হয়ে উঠেছে স্বপ্নের এই রেলপথের বাস্তবায়ন। একই সঙ্গে ব্যাপক কর্মসংস্থানেরও দরজা খুলে দিয়েছে ভারতীয় রেলের এই গৌরবোজ্জ্বল সাফল্য। হিমালয়ের দুর্গমতাকে জয় করে সাধারণ মানুষের জন্য যোগাযোগের নতুন রাস্তা খুলে দিতে চেয়েছিল ভারত সরকার। ইউএসবিআরএল বা উধমপুর-শ্রীনগর-বারামুল্লা রেল লিঙ্ক প্রকল্পকে ভারত সরকার আগেই একটি জাতীয় প্রকল্প বলে ঘোষণা করে। ফলে বাড়তি গতি পায় প্রকল্পটি। গোটা দেশের সঙ্গে কাশ্মীর উপত্যকার সরাসরি ব্রডগেজ রেলসংযোগের এ প্রকল্প যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ছাড়াও ভূস্বর্গ বলে পরিচিত কাশ্মীরের মানুষদের কাছে সার্বিক কল্যাণের জন্যও বিশেষ কার্যকর হয়ে উঠেছে।
ভারতীয় রেলের কর্মকর্তারা মনে করেন, উত্তরে দুর্গম পার্বত্য জনপদে সব আবহাওয়ার পক্ষে উপযুক্ত এই রেলপথ সামগ্রিক উন্নয়নের হাতিয়ার হয়ে উঠবে। কম পয়সার এই গণপরিবহনের হাত ধরেই ব্যাপক উন্নয়নের স্বপ্ন দেখছেন কাশ্মীরিরাও। হিমালয়ের বুকে এই রেলপথের প্রথম তিনটি পর্যায়ের কাজ শেষ। কাশ্মীর উপত্যকার বারামুরা ও বানিহাল এবং জম্মু উপত্যকার জম্মু-উধমপুর-কাটরা রেলপথে ট্রেন চলছে। কাটরা থেকে বানিয়াল ১১১ কিলোমিটার দুর্গম রেলপথ নির্মাণের কাজ অবশ্য এখনও শেষ হয়নি। গভীর খাদ ও নদীপথ এক্ষেত্রে পদে পদে বাধার সৃষ্টি করছে। তবু সেই বাধা অতিক্রম করে ভারতের দুর্গমতম রেলপথ নির্মাণে বদ্ধপরিকর রেলের ইঞ্জিনিয়াররা। কাটরা থেকে বানিয়াল নির্মীয়মাণ রেলপথজুড়ে রয়েছে প্রচুর বড় বড় সেতু এবং সুরঙ্গ। হিমালয়ের দুর্গমতার কারণে প্রায় পুরো পথটিই সেতু আর সুরঙ্গনির্ভর। ফলে বাড়তি প্রযুক্তিগত সতর্কতা অবলম্বন করতে হচ্ছে।
কাশ্মীরের জন্য অত্যন্ত জরুরি এই রেলপথ। দুর্গমতা জয়ের পাশাপাশি এই রেলপথ এখনই পাহাড়ি বিভিন্ন জনপদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে উঠছে। যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজতর তো হচ্ছেই, সঙ্গে সুখ-সমৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানের নতুন নতুন দিশা দেখাচ্ছে। রিয়াসি ও রিম্বানের মতো পিছিয়ে পড়া জেলাগুলোতেও উন্নয়নের বার্তা পৌঁছে গেছে। এসব পশ্চাৎভূমিতে এতোদিন পর্যন্ত দেশের অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগের তেমন কোনো সুযোগই ছিল না। এখন সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থাও উন্নততর হয়েছে।
Advertisement
যোগাযোগ ব্যবস্থার হাত ধরে স্বাস্থ্য, শিক্ষা থেকে শুরু করে ব্যবসা-বাণিজ্যের নতুন দিগন্ত খুলে গেছে। উন্নয়নের সুফল সহজেই পৌঁছে যাচ্ছে সাধারণ মানুষের কাছে। ১১১ কিলোমিটার কাটরা বানিয়াল রেলপথ নির্মাণে ৩০ হাজার ৬৭২ কোটি ৩৪ লাখ রুপি খরচ ধরা হয়েছে। তবে ২০১৪ সাল থেকেই ব্যয় বরাদ্দ বেড়েই চলছে। তবু রেলমন্ত্রক দ্রুত শেষ করতে চায় এই দীর্ঘ ও দুর্গম রেলপথ নির্মাণকাজ। চলছে তারই আয়োজন।
চলতি বছরের মে মাসে ভারতীয় উত্তর রেলের জেনারেল ম্যানেজার আশুতোষ গঙ্গাল ঘোষণা করেছিলেন, ২০২৩ সালের মধ্যেই কাশ্মীর গোটা দেশের রেল মানচিত্রের সঙ্গে যুক্ত হবে। যে গতিতে কাশ্মীরে রেলের কাজ হচ্ছে তাতে করে আশা করাই যায়, উত্তরের কাশ্মীর থেকে দক্ষিণের কন্যাকুমারী পর্যন্ত ভারতীয় রেল বিস্তারের স্বপ্ন শিগগির বাস্তব চেহারা নিতে চলেছে।
উধমপুর-শ্রীনগর-বারামুল্লা রেল প্রকল্পের হাত ধরে ইতিমধ্যেই ৫ কোটি শ্রমদিবস তৈরি হয়েছে। এতেই স্পষ্ট, স্থানীয় মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টিতেও রেল নির্মাণ প্রকল্প বিরাট ভূমিকা পালন করে চলেছে। প্রাকৃতিকভাবে দুর্গম বানিয়াল-কাটরা রেলপথ নির্মাণেও প্রচুর শ্রম দিবস তৈরি হচ্ছে। রেলমন্ত্রক স্থানীয়দের নির্মাণকাজের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। আগামী দিনেও থাকছে রিয়াসি ও রাম্বানের মতো প্রত্যন্ত জেলার বাসিন্দাদের জন্য রেলে চাকরির সুযোগ।
১১১ কিলোমিটার দীর্ঘ রেলপথে ৩৭টি সেতু নির্মিত হচ্ছে। এখন পর্যন্ত ৭৫ শতাংশ নির্মাণকাজ শেষ। এই দুর্গম রেলপথের সুরঙ্গ কাটার ৯৭.৬ শতাংশ কাজও ইতিমধ্যে শেষ। রেলমন্ত্রক ২০৫ কিলোমিটার বেশি সমান্তরাল রাস্তা নির্মাণ করছে। এই সড়কপথেও একটি সুরঙ্গ ও ৩২০টি সেতু থাকছে। ৭৩টি গ্রামের আগে শুধু হেঁটে অথবা নৌকায় যাতায়াতই একমাত্র ভরসা ছিল। এখন সেখানে রেল ও সড়ক পৌঁছে যাচ্ছে। স্থানীয়দের ৬৫ শতাংশই এখন রেলের কাজে নিযুক্ত।
Advertisement
বানিহাল-বারামুল্লা ১৩৭ কিলোমিটার রেলপথের হাতধরে কাশ্মীরের মানুষ শিগগির ইলেক্ট্রিক ট্রেন পেতে চলেছেন। ২ অক্টোবর ভারতের জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধীর জন্মদিনে ৩২৪ কোটি রুপি ব্যয়ে নির্মিত এই রেল প্রকল্পের উদ্বোধন হবে। ২০ সেপ্টেম্বর থেকে ট্রায়াল শুরু হয়েছে এবং ২৬ সেপ্টেম্বর নিরাপত্তা কমিশনের চূড়ান্ত পর্যবেক্ষণের পরই চালু হচ্ছে প্রকল্পটি। বৈদ্যুতীকরণের ফলে দূষণের হাত থেকে রক্ষার পাশাপাশি ৬০ শতাংশ জ্বালানিও সাশ্রয় হবে। ২০১৯ সাল থেকেই ভারতীয় রেল, কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের সরকার ও ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার প্রকল্পটি নিয়ে কাজ করে চলেছে। মহামারির মধ্যেও রেলপথ নির্মাণে কোনো ঢিলেমি দেয়নি সরকার।
নির্মীয়মাণ রেলপথে চেনাব সেতুটি অত্যন্ত আশ্চর্যজনক। বিশ্বের সর্বোচ্চ খিলান রেল সেতু এটি। চেনাব সেতুটি তৈরি করতে প্রায় ১৮ বছর সময় লেগেছে। এই রেল সেতুর উচ্চতা ৩৫৯ মিটার। ইতিমধ্যে এটি বিশ্ব রেকর্ড হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। আইফেল টাওয়ারের থেকেও ৩৫ মিটার উঁচু এই সেতু নির্মাণে খরচ হয়েছে ১ হাজার ২৫০ কোটি রুপি। মেঘেদের ওপরেই স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে থাকা সেতুটির ছবি সম্প্রতি প্রকাশ্যে আসে। চেনাব নদীর ওপর নির্মিত সেতুটির ১.৩১৫ কিলোমিটার মেগা আইকনিক কাঠামো ডেকের গোল্ডেন জয়েন্ট নামেও পরিচিত। ২৬০ কিলোমিটার বেগে ঝড় বইলেও সেতুটি টলবে না, এমনটাই দাবি ভারতীয় প্রযুক্তিবিদদের।
পৃথিবীর আধুনিকতম প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে তৈরি হচ্ছে ভারতের এই স্বপ্নের রেলপথ। এটিই ভারতের সর্বোচ্চ উচ্চতায় প্রথম রেলওয়ে নেটওয়ার্ক। এই নেটওয়ার্কের হাত ধরেই কাশ্মীরের সামাজিক ও অর্থনীতিতে আমূল পরিবর্তন আসতে চলেছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। ভারত সরকারও কাশ্মীরের সাধারণ মানুষের উন্নয়নের স্বার্থে দ্রুতগতিতে রেলপথটির বাকি কাজ শেষ করতে বদ্ধপরিকর।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
এইচআর/ফারুক/এমএস