দেশজুড়ে

সুনামগঞ্জে মেয়েদের পড়াশোনায় অনীহা অভিভাবকদের

সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার সুরমা ইউনিয়নের সৈয়দপুর গ্রামের বাসিন্দা এরশাদ মিয়া। নিজের ছেলেকে চাঁদপুরের একটি মাদরাসায় পড়াশোনা করাচ্ছেন। বাড়ির পাশের স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়তো মেয়ে আয়েশা আক্তার। করোনাকালে মেয়েটির পড়াশোনা বন্ধ করে দিয়ে গ্রামেই আরেক বাড়িতে গৃহপরিচারিকার কাজ করতে পাঠিয়েছেন এরশাদ মিয়া।

Advertisement

এরশাদ মিয়া জাগো নিউজকে বলেন, ‘দুজনকে পড়ালে খরচ বেশি লাগে। সংসারে টানাপোড়েন হয়। তাই শুধু ছেলেটাকে পড়াচ্ছি। সে পড়াশোনা শিখলে সংসারের কাজে লাগবে।’

তিনি যখন কথাগুলো বলছিলেন তখন তার পাশেই ছিল মেয়ে আয়েশা আক্তার। কন্যাশিশুর প্রতি এমন অবজ্ঞার কথা শুনে সে কাঁদছিল। বারবার ওড়না দিয়ে চোখ মুছতে দেখা যায় তাকে।

এরশাদ মিয়ার কথা শেষ হলে তার স্ত্রী মালেকা বেগমের কাছে জানতে চাওয়া হয় মেয়েদের জন্য সরকার উপবৃত্তির টাকা দেয়। আপনার মেয়ে পেয়েছিল কি না? মালেকা বেগম উত্তর দেন ছয় মাসে ১২শ টাকা পেয়েছিল। তাহলে মেয়ের পড়াশোনা বন্ধ করলেন কেন, এমন প্রশ্ন করলে তিনি স্বামীর দিকে ইঙ্গিত করে তাকে দুষলেন।

Advertisement

আয়েশা আক্তারের কাছে জানতে চাওয়া হয় স্কুলে যাচ্ছ না কেন। চোখের পানি মুছতে মুছতে সে বলে, ‘মা-বাবা খরচের টাকা দিতে পারেন না। তাই এখন পড়াশোনা ছেড়ে অন্যের বাড়িতে কাজ করছি। মাস শেষে যে টাকা পাই তা বাবার হাতে তুলে দেই।’

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শুধু এরশাদ মিয়া ও মালেকা বেগমই নন; কন্যাশিশুর প্রতি অবজ্ঞা রয়েছে সুনামগঞ্জের বেশিরভাগ গ্রামীণ জনপদে। কুসংস্কার, দরিদ্রতা ও যৌন নিপীড়নের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে হাওরাঞ্চলে কন্যাশিশুদের ওপর। করোনা ও বন্যার কারণে শিক্ষা-দীক্ষায় ঝরে পড়া হাওরের বেশিরভাগই কন্যাশিশু। সৈয়দপুর গ্রামের ফুল বানু। নামের আগেই ‘ফুল’। কিন্তু অসময়ে যেন সেই ফুলটা ঝরে পড়ে গেলো মাটিতে। কেন পড়াশোনা করতে পারলে না জিজ্ঞাসা করতেই তার দু’চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে।

ফুল বানু জাগো নিউজকে বলে, ‘পড়ার খুব ইচ্ছা ছিল। কিন্তু সংসারে এত অভাব যে আমাকে পড়াশোনা ছাড়তে বাধ্য করেন মা।’

ফুল বানুর মা শাহিনা বেগম জাগো নিউজকে বলেন, ‘অভাবের সংসার। মেয়েকে পড়ানোর টাকা নাই। পরে করোনা আইছে (এসেছে)। সবমিলিয়ে মেয়ের পড়া বাদ দিয়া লাইসি (বাদ দিয়েছি)। তবে আমার ছেলেটায় অল্প বয়সে বিয়া (বিয়ে) করছে। সে যদি পড়াশোনা করতো তাহলে তাকে ভিটেমাটি বিক্রি করে পড়াশোনা করাইতাম।’

Advertisement

তিনি বলেন, শুধু আমি না, হাওর এলাকার সবাই জানে ঝিয়েরে (মেয়েকে) পড়াইয়া লাভ নাই। ঝিয়াইত বিয়ের পরের ঘরও যাইবো গি (বিয়ের পরে পরের ঘরে যাবে)।

সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার সৈয়দপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শামছুল আলম রাসেলের মতে, মেয়েদের বেশি ঝরে পড়ার কারণ অভিভাবকরা মনের দিক থেকে এখনো ছেলে ও মেয়ে শিশুকে সমানভাবে দেখতে পারছেন না।

২০১১ সালের পরিসংখ্যানে সুনামগঞ্জে কন্যাশিশু ছিল ছয় লাখ। এবারের পরিসংখ্যানে এই সংখ্যা বাড়তে পারে জানিয়ে জেলা শিশুবিষয়ক কর্মকর্তা বাদল চন্দ্র বর্মণ বলেন, দরিদ্রতা ও বাল্যবিয়ের নেতিবাচক প্রভাব কন্যাশিশুদের ওপরই বেশি পড়ছে।

সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, হাওরের জেলা সুনামগঞ্জ। আমরা এই জেলায় নারীশিক্ষার প্রতি জোর দিয়েছি।

তবে কন্যাশিশুদের শিক্ষা, পুষ্টি, স্বাস্থ্য, আইনি সহায়তা ও ন্যায্য অধিকার, চিকিৎসা, বৈষম্য থেকে সুরক্ষা, বাল্যবিয়ের বিরুদ্ধে কার্যকরী ভূমিকাই সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারে বলে মনে করেন হাওরাঞ্চলের নারী অধিকার ও মানবাধিকার কর্মীরা।

এসআর/এএসএম