অণুজীববিজ্ঞান হলো জীববিজ্ঞানের একটি শাখা, যেখানে অণুজীব নিয়ে আলোচনা করা হয়। অণুজীববিজ্ঞানের আলোচনার মধ্যে ভাইরাস, ছত্রাক, পরজীবী, ব্যাকটেরিয়া ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত। অণুজীববিজ্ঞানের এসব শাখায় অভিজ্ঞ ও দক্ষ ব্যক্তিদের অণুজীববিজ্ঞানী বলা হয়। মৌলিক বিজ্ঞান জ্ঞানকে এগিয়ে নিতে, ফার্মাসিউটিক্যালস এবং বায়োটেকনোলজির পণ্যগুলোর বিকাশে অবদান রাখতে অণুজীববিজ্ঞানীদের প্রয়োজনীয়তা ব্যাপক।
Advertisement
অণুজীববিজ্ঞান বিভাগে পড়াশোনা ও ক্যারিয়ারের নানা বিষয় নিয়ে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা বলেছেন নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীববিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সঞ্জয় মুখার্জী। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আনিসুল ইসলাম নাঈম—
জাগো নিউজ: অণুজীববিজ্ঞান বিষয়ে পড়ার যোগ্যতা কী?সঞ্জয় মুখার্জী: যেহেতু অণুজীববিজ্ঞান একটি বিজ্ঞানের বিষয়, তাই এ বিষয়ে স্নাতক পর্যায়ে লেখাপড়া করতে চাইলে একজন শিক্ষার্থীকে অবশ্যই এসএসসি এবং এইচএসসিতে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে উত্তীর্ণ হতে হবে। পাশাপাশি এইচএসসিতে অবশ্যই জীববিজ্ঞান থাকতে হবে। আরও সুনির্দিষ্টভাবে যোগ্যতার মানদণ্ডগুলো বলা বেশ কঠিন। কেননা এ মানদণ্ডগুলো বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক নির্ধারিত হয়ে থাকে এবং তা বিশ্ববিদ্যালয়ভেদে ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। এমনকি প্রতিবছর পরিবর্তনও হতে পারে। যেমন- কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে অণুজীববিজ্ঞানে ভর্তির ক্ষেত্রে জীববিজ্ঞানের পাশাপাশি রসায়ন এমনকি ইংরেজি বিষয়ের উপরও জোর দেওয়া হয়। আবার কোথাও এইচএসসিতে জীববিজ্ঞান বা রসায়নে নির্দিষ্ট জিপিএ থাকতে হয় এবং ভর্তি পরীক্ষায় ওই বিষয়গুলোতে বিশ্ববিদ্যালয় নির্ধারিত ন্যূনতম নম্বর পেতে হয়। তাই যোগ্যতার মানদণ্ড বিষয়ক সুনির্দিষ্ট তথ্যের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তিতে নজর রাখাই বাঞ্ছনীয়।
জাগো নিউজ: অনুজীববিজ্ঞান পড়ার জন্য কোথায় কোথায় ভর্তি হওয়া যায়?সঞ্জয় মুখার্জী: দেশের বিভিন্ন পাবলিক এবং প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে অণুজীববিজ্ঞান বিষয়ের ওপর স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে ভর্তি হওয়া যায়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় অন্যতম। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়, প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, ইন্ডিপেনডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয় ও গণ বিশ্ববিদ্যালয় উল্লেখযোগ্য।
Advertisement
জাগো নিউজ: অনুজীববিজ্ঞানে কী কী বিষয় পড়ানো হয়?সঞ্জয় মুখার্জী: খালি চোখে দেখা যায় না এমন সব জীবকে অণুজীব বলা হয়। ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, প্রোটোজোয়া, ছত্রাক, শৈবাল হচ্ছে বিভিন্ন প্রকার অণুজীবের উদাহরণ। এসব অণুজীব নানাভাবে আমাদের জীবজগতকে প্রভাবিত করে থাকে। এসব অণুজীবের গঠন ও কার্যকলাপ, জীবজগতে এদের ইতিবাচক ও নেতিবাচক প্রভাব, মানবকল্যাণে এদের ব্যবহার সম্পর্কে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করাই অণুজীববিজ্ঞানের প্রধান আলোচ্য বিষয়। যেসব কোর্স অণুজীববিজ্ঞান বিষয়ে পড়ানো হয়; সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—ব্যাকটেরিওলজি, ভাইরোলজি, মাইকোলজি, অ্যালগোলজি, ইমিউনোলজি, হিউম্যান ফিজিওলজি, জেনেটিক্স, সেল বায়োলজি, এনজাইমোলজি, বায়োইনফরমেটিক্স ইত্যাদি। আর ক্ষেত্র বিবেচনায় চিকিৎসা অণুজীববিজ্ঞান, পরিবেশ অণুজীববিজ্ঞান, কৃষি অণুজীববিজ্ঞান, শিল্প অণুজীববিজ্ঞান, খাদ্য অণুজীববিজ্ঞান, জৈবপ্রযুক্তিসহ নানা বিষয়ে পাঠদান করা হয়।
জাগো নিউজ: অনুজীববিজ্ঞান বিভাগে পড়ে কোথায় চাকরির সুযোগ আছে? সঞ্জয় মুখার্জী: যেহেতু অণুজীববিজ্ঞান একটি গবেষণাধর্মী বিষয়। তাই এ বিষয়ে পড়ালেখা শেষ করে গবেষণামূলক কাজ করতে পারলে অর্জিত জ্ঞানকে সবচেয়ে ভালোভাবে কাজে লাগানো যায়। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান, যেমন- বাংলাদেশ শিল্প ও গবেষণা পরিষদ (বিসিএসআইআর), ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বায়োটেকনোলজি (এনআইবি), বাংলাদেশ আণবিক শক্তি কমিশন, আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর’বি) ইত্যাদিতে গবেষক হিসেবে কাজের সুযোগ আছে। গবেষণার কাজ ছাড়াও অণুজীববিজ্ঞানের জ্ঞানকে প্রায়োগিক ক্ষেত্রে ব্যবহার বিষয়ক কর্মক্ষেত্রও দেশে আছে। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ বিমান, বিএসটিআই, ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি, ফুড অ্যান্ড বেভারেজ ইন্ডাস্ট্রি, কেমিক্যাল অ্যান্ড অ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রি, বায়োটেকনোলজি ফার্ম ইত্যাদি হচ্ছে এমনই কিছু কাজের ক্ষেত্র; যেখানে অণুজীবের জ্ঞানকে সরাসরি জনকল্যাণমূলক কাজে লাগানো যায়। এ ছাড়াও বিভিন্ন পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা ও গবেষণার পাশাপাশি বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের পরামর্শক হিসেবেও কাজ করা যায়। বর্তমানে অণুজীববিজ্ঞানের গ্রাজুয়েটদের জন্য সরকারি বিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞানের শিক্ষক হিসেবে কাজের ক্ষেত্রও তৈরি হয়েছে।
জাগো নিউজ: পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ভেদে পড়ার খরচ কেমন?সঞ্জয় মুখার্জী: পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অণুজীববিজ্ঞান বিষয়ে পড়ার খরচ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে তুলনামূলক কম। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময় ১৫-২০ হাজার টাকার মতো লাগে। এরপর প্রতি সেমিস্টার শেষে ফাইনাল পরীক্ষার আগে কিছু ফি দিতে হয়। সব মিলিয়ে চার বছরের স্নাতক কোর্স সম্পন্ন করতে ৬০-৭০ হাজার টাকার মতো খরচ হয়। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ভেদে ৩-৬ লাখ টাকার মতো খরচ হয়। তবে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য বিভিন্ন রকম বৃত্তির ব্যবস্থাও থাকে।
জাগো নিউজ: অনুজীববিজ্ঞান বিষয়ে উচ্চশিক্ষার সুযোগ-সুবিধা কেমন?সঞ্জয় মুখার্জী: উন্নত দেশগুলোয় অণুজীববিজ্ঞান বিষয়ক গবেষণায় অর্থায়ন অনেক বেশি হয় বলে সেসব দেশে এ বিষয়ে উচ্চশিক্ষার সুযোগ অনেক বেশি। প্রতিবছর বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী দেশে অণুজীববিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতক সম্পন্ন করে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ানসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে মাস্টার্স এবং পিএইচডি করতে পাড়ি জমাচ্ছেন। সে ক্ষেত্রে মোটামুটি মানের ফলাফল, স্নাতক পর্যায়ে কিছু গবেষণার অভিজ্ঞতা এবং ইংরেজিতে ভালো দক্ষতা দেখাতে পারলে ওইসব দেশের সরকারি বৃত্তি বা বিভিন্ন আর্থিক সুবিধাসহ উচ্চশিক্ষার সুযোগ লাভ করা যায়। আগামী দিনে অণুজীববিজ্ঞান বিষয়ে উচ্চশিক্ষার সুযোগ আরও প্রসারিত হচ্ছে।
Advertisement
জাগো নিউজ: বাংলাদেশে অণুজীববিজ্ঞানীদের প্রয়োজনীয়তা কেমন?সঞ্জয় মুখার্জী: দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের সংক্রামক রোগ বিষয়ক নানা গবেষণাসহ জনস্বাস্থ্য ক্ষেত্রে অণুজীববিজ্ঞানীরা প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করে আসছেন। কোভিড-১৯ মহামারি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে স্বাস্থ্য খাতের দুর্বলতাগুলো দেখিয়ে দিয়েছে। এ খাতেও অণুজীববিজ্ঞানীদের অবদান রাখার বিস্তর সুযোগ আছে। সেইসাথে বর্তমানে দেশে ওষুধ, খাদ্য, কৃষিসহ নানা শিল্পে অণুজীববিজ্ঞানীরা প্রত্যক্ষভাবে অবদান রেখে চলেছেন। আগামীর বাংলাদেশেও অণুজীববিজ্ঞানীদের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। কেননা বাংলাদেশ যে সুনির্দিষ্ট ভিশন নিয়ে ক্রমান্বয়ে উন্নত বিশ্বের কাতারে সামিল হওয়ার চেষ্টা করছে, সেই বাংলাদেশের রূপকল্পে শিক্ষা ও গবেষণাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়ার কোনো বিকল্প নেই। সেই গবেষণাধর্মী, বিজ্ঞানভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় অণুজীববিজ্ঞানীরা দেশীয় নানা সমস্যার পাশাপাশি বৈশ্বিক নানা সমস্যার সমাধান করে দেশের মুখ উজ্জ্বল করতে পারবেন।
এসইউ/এএসএম