রাজনীতি

আওয়ামী লীগের ঘাঁটিতে ঘুরে দাঁড়াতে মরিয়া বিএনপি

আজমিরীগঞ্জ ও বানিয়াচং উপজেলা নিয়ে গঠিত হবিগঞ্জ-২ আসন। জাতীয় সংসদের ২৪০ নম্বর এ আসনটি বরাবরই আওয়ামী লীগের দখলে। স্বাধীনতার পর ’৮৬ ও ’৮৮ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি নিলেও ’৯১ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত জিতেছে আওয়ামী লীগ। ভোটের পরিসংখ্যানে এই আসনে বিএনপি বরাবরই পিছিয়ে। তবে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের দাবি, আওয়ামী লীগের আগের সেই অবস্থান এখন আর নেই। সুষ্ঠু ভোট হলে বিএনপিই জিতবে।

Advertisement

এ আসন ঘিরে আগামী নির্বাচনে বিএনপির দুজন মনোনয়নপ্রত্যাশীর নাম শোনা যাচ্ছে। একজন বিএনপির সিলেট বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ডা. সাখাওয়াত হাসান জীবন ও আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক আহমেদ আলী মুকিব। তবে সাধারণ মানুষের কাছে জীবনের পরিচিতি বেশি।

অপরদিকে এ আসনে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন চাইবেন টানা তিনবারের এমপি প্রবীণ নেতা আব্দুল মজিদ খান, সাবেক এমপি শরিফ উদ্দীন আহমেদের ছেলে তরুণ আওয়ামী লীগ নেতা ময়েজ উদ্দিন শরীফ রুয়েল, আজমিরীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বীর মুক্তিযোদ্ধা আমির হোসেন মাস্টার এবং ব্যবসায়ী বিধান দাস সরকারসহ অনেকে।

স্থানীয়দের মতে, এ আসনের ভোটের মাঠের মূল কারিগর ৭৫ হাজার সংখ্যালঘু ভোটার। তাদের ভোট অনুযায়ী নির্ধারিত হয় জয় পরাজয়।

Advertisement

১০ নম্বর সুবিদপুর ইউনিয়নের রত্না বাজার এলাকায় প্রাইমারি স্কুলের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক সুরেশ দাশ বলেন, এখানে হিন্দু-মুসলিম একত্রে শান্তি-শৃঙ্খলার সঙ্গে বসবাস করে। এখানে নৌকাই জনপ্রিয়।

মাছচাষি ধনঞ্জয় সরকার বলেন, এই আসনে বিএনপি কম। আগে থেকেই আওয়ামী লীগ বেশি। বিএনপির নেতারা কি আসেন না? জবাবে তিনি বলেন, ‘আসেন কম। ডা. জীবন আসেন। মাঝে মধ্যে ফ্রি চিকিৎসা দেন।’

গত ১৫ বছর এ এলাকায় বিএনপির কোনো কর্মসূচি দেখেননি বলে জানান তিনি।

তবে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাদের মুখে শোনা গেছে ভিন্ন সুর। তারা বলছেন, দলের কাউন্সিল হচ্ছে, মাঠেও রয়েছেন তারা। বৃহত্তর আন্দোলনের ডাক দিলেও তারা মাঠে থাকবেন। আর সুষ্ঠু নির্বাচন হলে প্রার্থী ফ্যাক্ট নয়।

Advertisement

আজমিরীগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক মো. শামসুল আলম বলেন, আন্দোলনের প্রথম থেকেই আমাদের আজমিরীগঞ্জ উপজেলা এগিয়ে রয়েছে। এখনকার অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত।

স্থানীয় বিএনপির বিভাজন আন্দোলনে কতটা প্রভাব ফেলবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, না তেমন প্রভাব ফেলবে না। দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে আন্দোলন হলেও এগুলো সুন্দরভাবে হচ্ছে। সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে ধানের শীষ বিপুল ভোটে বিজয়ী হবে। এ আসনের ধানের শীষের সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে আহমেদ আলী মুকিব রয়েছেন। আগামীতে তার সম্ভাবনা বেশি। এর আগে জীবন ডাক্তার নির্বাচন করেছিলেন।

বানিয়াচং উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ফজলে নকীব মাখন জাগো নিউজকে বলেন, আমরা বানিয়াচং উপজেলা কাউন্সিল করেছি, ইউনিয়ন কাউন্সিল করেছি। দলকে আশ্বস্ত করতে পারি, এই উপজেলায় ইভিএম দিয়ে নির্বাচন করা সহজ হবে না।

দলীয় বিভাজন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমাদের সংগঠনে যারা বিরোধিতা করছেন তাদের মাঠ পর্যায়ে নেতাকর্মী নেই। দলের যারা অনুগত তাদের সমর্থন আমাদের প্রতি। বৃহত্তর আন্দোলনে কোন্দল থাকে না। যখন কিছু হয় তখন আমরা সবাই একত্রে ঝাঁপিয়ে পড়ি।

আগামী নির্বাচনে এই আসন থেকে ধানের শীষের সম্ভাব্য মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে ডা. সাখাওয়াত হোসেন জীবন এবং আহমেদ আলী মুকিব রয়েছেন বলে জানান তিনি।

এই দুই নেতার মধ্যে দলীয় নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ডা. জীবন সাহেব মাঠে-ঘাটে যান। মানুষের সঙ্গে মেশেন। আহমেদ আলী মুকিব ভাই তো এই পলিটিক্সটা করেননি। উনি সৌদি আরবে পলিটিক্স করেছেন এবং কমিটিকেন্দ্রিক কিছু কাজ করছেন। ঢাকা থেকে তদবির করে কমিটিতে পদ-পদবি দেন। উনি দলের জন্য কাজ করেন এটা অস্বীকার করছি না। যিনি দলের জন্য কাজ করেন মানুষ সব সময় কাছে পায় তাকেই পছন্দ করে।

উপজেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ওয়ারিশ উদ্দিন খান বলেন, আহমেদ আলী মুকিব সাহেব যদিও সৌদি আরবে থাকেন উনি কিন্তু সার্বক্ষণিক সহযোগিতা করছেন। এখন উপজেলা বিএনপিতে কিছু গ্রুপিং রয়েছে। আমাদের যখন ঐক্য ছিল তখন থেকে তিনি সহযোগিতা করছেন। করোনার সময় অনেক টাকা-পয়সা দিয়েছেন। বন্যার সময়ও। উনি অনেক ভালো মানুষ। এখানে যদি সুষ্ঠু নির্বাচন হয় তাহলে আমাদের প্রার্থী যেই হোক বিজয় ছিনিয়ে আনাটা কোনো বিষয়ই নয়। এটা আওয়ামী লীগের আসন ছিল কিন্তু এখন আর নেই। মানুষ এখন অতিষ্ঠ। আওয়ামী লীগের লোকজন এখন নৌকায় ভোট দিতে চায় না।

এসব বিষয়ে কথা হলে দলের সম্ভাব্য অন্য মনোনয়নপ্রত্যাশী আহমেদ আলী মুকিবের নাম উল্লেখ না করে ডা. জীবন জাগো নিউজকে বলেন, ওয়ান/ইলেভেনের পর থেকে উনি এলাকায় আসেননি। তবে কমিটি করে, টাকা-পয়সা দিয়ে একটা বলয় তৈরির চেষ্টা করছেন।

এই আসন সম্পর্কে জীবন বলেন, জিয়াউর রহমানের সময় একবার বিজয়ী হয়েছিল বিএনপি, জাতীয় পার্টি একবার, বাকি সময় আওয়ামী লীগের ছিল। তবে ২০০১ সালে বিএনপির প্রার্থী ৩৪০ ভোটে হেরেছিলেন।

‘এতদিন মাঠ পর্যায়ে বিএনপির কোনো সংগঠন ছিল না। আমি যখন ২০০৮ সালে নির্বাচন করতে যাই তখন আংশিক উপজেলা কমিটি পেলাম। ইউনিয়ন কমিটির কোনো স্ট্রাকচারই পাওয়া গেলো না। এখন বানিয়াচংয়ে আমাদের ওয়ার্ড কমিটি, ইউনিয়ন কমিটি, উপজেলা কমিটি কমপ্লিট। আজমিরীগঞ্জে ওয়ার্ড কমিটি আছে, ইউনিয়ন কমিটির প্রক্রিয়া চলছে। উপজেলা কমিটি হবে। এখন একটা স্ট্রাকচার দাঁড়ানোর কারণে আমাদের ফাইট করার সুযোগ হয়েছে।’

জীবন বলেন, এ আসনে বিএনপির প্রস্তুতি ভালো। যদি সঠিক প্রার্থী দেওয়া যায় তাহলে আমরা আশা করতে পারি। ২০১৮ সালে জোট প্রার্থী মাওলানা বাসিতকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিল। তার সংগঠন নেই। এ উপজেলা নির্বাচনে আমরা অংশগ্রহণ করিনি। এর আগে আমরা যখন অংশগ্রহণ করেছি সফলতা আনতে পেরেছি। তাতে বোঝা যায় সংগঠন ওভাবে দাঁড় করানো গেছে। সেক্ষেত্রে সঠিক প্রার্থী হলে আসনটি ধানের শীষের জন্য উপহার হতে পারে।

স্থানীয় বিএনপির বিভাজন ভোটের ক্ষেত্রে কতটা প্রতিবন্ধকতা হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা কোনো সমস্যা হবে না। তবে, দেশের বাইরে থেকে একজন আছেন তিনি সাংগঠনিক ক্ষেত্রে নার্সিং করেন যেটা ক্ষতিকর।

গত কয়েক বছরে ভোটের ফলাফল বলছে, এখানে আওয়ামী লীগের শক্ত ভোটব্যাংক আছে। যারা সব সময়ই নৌকায় ভোট দেয়। যে কারণে ১৯৯১ ও ২০০১ সালেও জাতীয়ভাবে আওয়ামী লীগ পরাজয় বরণ করলেও এই আসনে নৌকা জয়লাভ করেছিল।

এ আসনে মোট ভোটার ৩ লাখ ৬ হাজার ৯৭২। পুরুষ ভোটার ১ লাখ ৫২ হাজার ৭৫২ এবং নারী ভোটার ১ লাখ ৫৪ হাজার ২২০।

বিগত নির্বাচনগুলোর ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে (২০১৮) আওয়ামী লীগের আব্দুল মজিদ খান ১ লাখ ৭৯ হাজার ৪৮০ ভোট পেয়েছেন। নিকটতম খেলাফত মজলিশের আব্দুল বাসিত আজাদ ৫৯ হাজার ৭২৪ ভোট পেয়েছেন।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে (২০১৮) আওয়ামী লীগের আব্দুল মজিদ খান ১ লাখ ৭৯ হাজার ৪৮০ ভোট পান। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী খিলাফত মজলিশের আব্দুল বাসিত আজাদ পান ৫৯ হাজার ৭২৪ ভোট।

১০ম সংসদ নির্বাচনে (২০১৪) আওয়ামী লীগের আবদুল মজিদ খান নৌকা প্রতীকে পান ৬৫ হাজার ৩৬২ ভোট। জাতীয় পার্টির শংকর পাল লাঙল প্রতীকে পান ২১ হাজার ৫৫৯ ভোট।

৯ম সংসদ নির্বাচনে (২০০৮) আওয়ামী লীগের প্রার্থী আবদুল মজিদ খান নৌকা প্রতীকে ভোট পান ১ লাখ ২২ হাজার ২৫ এবং বিএনপির ডা. সাখাওয়াত হাছান জীবন ধানের শীষ প্রতীকে ৬৭ হাজার ৫৯ ভোট পান।

৮ম সংসদ নির্বাচনে (২০০১) আওয়ামী লীগের প্রার্থী নাজমুল হাসান জাহেদ নৌকা প্রতীকে পান ৫০ হাজার ৩৬১ ভোট এবং বিএনপির প্রার্থী নুরুল আমিন চৌধুরী ধানের শীষ প্রতীকে পান ৫০ হাজার ১৪ ভোট।

৭ম সংসদ নির্বাচনে (১৯৯৬) আওয়ামী লীগের প্রার্থী শরিফ উদ্দীন আহমেদ নৌকা প্রতীকে ৫১ হাজার ৩৬৯ ভোট পান। বিএনপির জাকারিয়া খান চৌধুরী ধানের শীষ প্রতীকে পান ৩৪ হাজার ৫৩০ ভোট।

৫ম সংসদ নির্বাচনে (১৯৯১) আওয়ামী লীগের প্রার্থী শরিফ উদ্দীন আহমেদ নৌকা প্রতীকে ৫০ হাজার ৩৯৭ ভোট এবং বিএনপির জাকারিয়া খান চৌধুরী ধানের শীষ প্রতীকে পান ৪০ হাজার ২৫ ভোট।

কেএইচ/এএসএ/জেআইএম