আজ বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস। বেঁচে থাকার পৃথিবীতে সব থেকে অবহেলিত বিষয় এই মানসিক স্বাস্থ্য। ছুটে চলা জীবনে শারীরিক সুস্থতার শতভাগ মানসিক সুস্বাস্থ্যের ওপর নির্ভরশীল, এটা আমরা কজন জানি? মেনে নেওয়ার নাম জীবন আর ছুটে চলাই জীবনের গতি। এটাকেই বাস্তবতা মনে করে আমরা প্রতিটি দিন শেষ করি।
Advertisement
আমাদের সমাজে দুই শ্রেণির মানুষের বসবাস। একদল শাসিত আরেক দল শোষিত। সমাজতান্ত্রিকতায় সুবিধাভোগী গোষ্ঠী সর্বদাই নিজেদের প্রয়োজনে নিয়ম তৈরি করে তা আরোপ করেছে। সাধারণরা তা অনুসরণ করেছে বিনা বাক্য ব্যয়ে। প্রতিবাদ তো দূরে থাক ভালো নেই এইটুকু বলার সাধ্য কারও নেই।
অথবা আমরা বলতে চাই না কেননা বিপরীত স্রোতে চলা কারও ঠাঁই হয় না তথাকথিত এই সভ্যতায়। অথচ সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয়, রাষ্ট্রীয় এবং ব্যক্তিগত নানা কারণেই আমরা মানসিকভাবে অসুস্থ। সম্পর্কের টানাপোড়েন, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ, নির্ভরতার ঘাটতি, প্রত্যাশার খুন এসব কিছুই আপনাকে মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত করে তুলবে অথচ আপনি টেরও পাবেন না।
গত ছয়মাসে মানসিক বিষণ্ণতায় শত শত আত্মহত্যার খবর আমি পড়েছি। শিক্ষাজীবনে বিষণ্ণতায় আত্মহত্যা, কর্মজীবনে সুযোগের অভাবে আত্মহত্যা, সম্পর্কের অবহেলায় একজন মায়ের আত্মহত্যা, অর্থনৈতিক টানাপোড়েনে আত্মহত্যা আরও কত কি।
Advertisement
জাগতিক জীবনের দায়মুক্তি নেওয়া এই মানুষগুলোকে নিয়ে আমাদের ভিন্ন মতবাদ ও বিশদ গবেষণা আছে। যেকোনো ধর্মেই যা মহাপাপ আর সামাজিকতায় তা দুর্বল মানসিকতার পরিচয়। কিন্তু কেন মানুষ জীবন থেকে দায়মুক্তি চায় এটি নিয়ে আমরা কজন ভাবি?
প্রতিদিন অন্তত একটি ইচ্ছে আত্মহত্যা করে পূরণ না হওয়ায়। হাজারো অভিমান আত্মহত্যা করে; মান ভাঙানো ভালোবাসার অভাবে। ভাবনাগুলো আত্মহত্যা করে সামাজিক নিয়মের ফাঁদে পড়ে। আকাশছোঁয়া স্বপ্নের আত্মহত্যা প্রতিদিনের চোখ রাঙানো বাস্তবতায়।
সাজানো মন আত্মহত্যা করে একজন ভুল সঙ্গীর সংস্পর্শে। প্রতি মুহূর্তের আত্মহত্যার কোনো খবর আমরা রাখি না। অথচ এতগুলো আত্মহত্যার ভার সইতে না পেরে শরীরের আত্মহত্যায় চলে নানা রকম বিশ্লেষণ। কেউ কষ্ট পেলে, তাকে বলি, কষ্ট কেন পেতে হবে?
যা হওয়ার তাতো হবেই, তাকে মেনেই নিতে হবে তাহলেই যুদ্ধজয়ীর মুকুট পাওয়া যাবে। মেনে নেওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। কিন্তু আমার প্রশ্ন মেনে নেওয়া আর মনে নেওয়া কি এক? মনেই যদি না নেওয়া গেলো তবে অভিমানী কষ্টের চিৎকার কি থেমে থাকে?
Advertisement
হয়তো সেই চিৎকার আমরা শুনতে চাই না বলে সেই আওয়াজ আমাদের কাছে পৌঁছাতে পারে না। নীরব চিৎকারে জমে থাকা ক্ষত কতটা যন্ত্রণার সেই হিসাব আমরা করি না। আর তাই ভার বইতে না পেরে, একা যুদ্ধ করে অনেকেই আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।
কতটা নিঃসঙ্গ আর হতাশাগ্রস্ত হলে এমন সিদ্ধান্ত আসে, তা হয়তো লিখে বোঝানো সম্ভব নয়। কিন্তু চাইলেই আমরা এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার সংখ্যা কমিয়ে আনতে পারি যদি আমরা মানসিক স্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দেই। একজন ব্যক্তি মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের কাছে যাওয়া মানেই সে পাগল এই ভয়ে আমরা ভালো না থাকাও প্রকাশ করি না।
পাশের মানুষটিকে যত্ন করা, তার না বলা কথাগুলো শুনতে চাওয়া কিংবা তাকে কষ্ট না দেওয়া। সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত অপার সৌন্দর্যের পাশাপাশি মনের সৌন্দর্য মানুষের সবচেয়ে বড় সম্পদ। একটা অদৃশ্য দায়ভার আমাকে প্রতি মুহূর্তে মনে করিয়ে দেয় আমাদের ব্যর্থতা, আমরা ভালো নেই কৃত্রিমতায় ফরমালিন হাসিতে ভালো থাকার সনদ নিচ্ছি প্রতি মুহূর্তে। এ এক অস্বস্তিকর অসম প্রতিযোগিতা।
জীবনটা যেমন মূল্যবান, স্বপ্নময় অর্জনের ভিত, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে দেওয়া উপহার। ঠিক তেমনি একবুক কষ্ট নিয়ে বেঁচে থাকা দুর্বিষহ, অর্থহীন। সম্পর্কের মূল্যায়ন, কাজের প্রশংসা, নিজের পছন্দ প্রকাশের স্বাধীনতা জীবনটাকে সহজ করতে পারে। যেখানে শুধু আনন্দ, বাধা পেরিয়ে গুটি গুটি পায়ে স্বপ্ন বোনা আর সেই স্বপ্নে বসবাস।
আসুন মানসিক স্বাস্থ্যের মূল্য দেই সুন্দর পৃথিবীর আয়োজনে। যেখানে ভাবলেশহীন ভাবনাগুলো গুরুত্ব পাবে আগামীর স্বপ্ন বোনায়। সেজন্য সবার অংশগ্রহণে সমন্বিত সামাজিক আন্দোলনে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা জরুরি।
মানসিক স্বাস্থ্যকে জাতীয় বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করে সুন্দর ও সুস্থ আগামীর যাত্রার অঙ্গীকার হোক। প্রতিটি মনের প্রত্যাশা নির্ভার হয়ে ডানা মেলুকমুক্ত আকাশের ঠিকানায় যেখানে দূষণহীন বাতাসে নিঃশ্বাস নেবে প্রতিটি প্রাণ। স্বপ্নের মূল্যায়ন হবে এ প্রত্যাশায় আসুন না সবাই মিলে খানিক স্বস্তি নিয়ে বাঁচি।
লেখক: উন্নয়ন ও গণমাধ্যমকর্মী।
এইচআর/জেআইএম