যশোর-ভাঙ্গা-ঢাকা আঞ্চলিক মহাসড়কের কালনা পয়েন্টে মধুমতি নদীর ওপর সেতু নির্মাণের দাবি ছিল দীর্ঘদিনের। ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা এখানে সেতু করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। সে অনুযায়ী এরই মধ্যে সেতু হয়েছে। সোমবার তিনি (প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা) সেতুর উদ্বোধনও করেছেন।
Advertisement
নড়াইলের সাধারণ জনগণ, যারা এই সেতুর প্রকৃত উপকারভোগী, তারা কীভাবে লাভবান হবেন বা তাদের কাছে মধুমতি সেতুর সুফল কী কী? এমন প্রশ্ন ছিল উদ্বোধনের সময় সেতু দেখতে আসা উৎসুক জনতার কাছে। তারা বলছেন, এই সেতু তাদের দীর্ঘদিনের ফেরি পারাপার ও অপেক্ষার ভোগান্তি লাঘব করবে। রাজধানী ঢাকা ও প্রতিবেশী দেশ কলকাতার সঙ্গে যাতায়াত সহজ হবে। এখানকার ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসারেও ভূমিকা পালন করবে।
পরিবারের সঙ্গে সেতু দেখতে এসেছিল লোহাগড়া গার্লস স্কুলের শিক্ষার্থী ইশরাত রহমান বৈশাখী। তার কাছে প্রশ্ন ছিল- এই সেতুর ফলে তোমার লাভ কী? জবাবে এই শিক্ষার্থী বলে, ‘আমি ঢাকায় খুব সহজে যাতায়াত করতে পারবো। আগে অনেকবার ঢাকা গেছি, ফেরি পার হয়ে যেতে অনেক সময় লেগে যেত। সকালে রওয়ানা দিলে রাত হয়ে যেত। এখন দুই-আড়াই ঘণ্টায় যেতে পারবো।’
লোহাগড়া পৌর এলাকার পুত্রবধূ শর্মি আক্তার মীমও এসেছিলেন সেতু দেখতে। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, সেতুর ফলে এই অঞ্চলের মানুষের অনেক উপকার হবে। কালনা ফেরিঘাটের জন্য অনেকের অনেক ভোগান্তি হতো। এখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গাড়ি জ্যামে দাঁড়িয়ে থাকতো, মানুষের ভোগান্তি হতো। এই সেতু হওয়ার কারণে সবারই সুবিধা হচ্ছে। মধুমতি সেতুর ফলে পদ্মা সেতুর পুরো সুফল ভোগ করবে পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ।
Advertisement
লোহাগড়ার পাঁচুড়িয়া গ্রামের বাসিন্দা ও রাজধানীর তিতুমীর কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী শরীফ শফিকুল ইসলাম বলেন, মধুমতি সেতুর ফলে আমাদের ঢাকা যাওয়া-আসায় ফেরি পারাপারের দুর্ভোগ লাঘব হবে। সময় ও অর্থ বাঁচবে। রাজধানী ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ সহজ হবে।
শঙ্করপাশা গ্রামের কৃষক সাখাওয়াত হোসেন বলেন, আগে ঢাকায় যেতে একদিন লাগত। এখন দুই থেকে আড়াই ঘণ্টার মধ্যে ঢাকা যাওয়া যাবে।
২২ সেপ্টেম্বর সেতু পরিদর্শন করেন সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের
সেতু হওয়ায় আপনার লাভ কী, জানতে চাইলে এই কৃষক বলেন, ফেরিতে আসলে পরে একটা ভোগান্তি, দেরি- এটা আর থাকলো না। যাতায়াত সহজ হয়ে গেলো।
Advertisement
আশপাশে শিল্প কলকারখানা হবে, এমন আভাস পাওয়া যাচ্ছে। অনেকে জমিজমা কিনছেন। জমির দামও বেড়ে গেছে- যোগ করেন নড়াইলের এই কৃষক।
স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা শেখ সাজ্জাদ হোসেন মুন্না বলেন, মধুমতি সেতু উদ্বোধনের ফলে মূলত এখন আমরা পদ্মা সেতুর পূর্ণাঙ্গ সুফল ভোগ করতে পারবো। ঢাকা থেকে নড়াইলে আসতে সর্বোচ্চ দুই ঘণ্টা সময় লাগবে। ৪৫ মিনিটে জাতির পিতার সমাধিতে যেতে পারবো। ঢাকা থেকে কলকাতার দূরত্বও কমে যাবে। একদিকে যেমন সময় বাঁচবে অন্যদিকে এই এলাকার মানুষের ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্কটাও বাড়বে।
জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) অর্থায়নে ৯৬০ কোটি টাকা ব্যয়ে মধুমতি নদীর ওপর মধুমতি সেতু নির্মিত হয়েছে, যা স্থানীয়ভাবে কালনা সেতু নামে পরিচিত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মধুমতি নদীর নামে এটির নামকরণ করেছেন। এটি নড়াইল, গোপালগঞ্জ, খুলনা, মাগুরা, সাতক্ষীরা, চুয়াডাঙ্গা, যশোর এবং ঝিনাইদহ জেলাকে সংযুক্ত করেছে।
প্রকল্প কর্মকর্তাদের মতে, সেতুটি চালু হওয়ার মাধ্যমে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ দ্রুত সড়ক যোগাযোগ সুবিধা পাবে। ফলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অন্তত ১০টি জেলার মানুষ কম সময়ে বিভিন্ন এলাকায় যাতায়াত করতে পারবেন। এটি দেশের বৃহত্তম স্থলবন্দর বেনাপোল, যশোর থেকে ঢাকা পর্যন্ত ভ্রমণের সময়ও কমিয়ে দেবে।
২৭.১ মিটার চওড়া সেতুটিতে চারটি উচ্চগতির লেন, ৪.৩০ কিলোমিটার অ্যাপ্রোচ রোড এবং দুটি সার্ভিস লেনসহ ছয়টি লেন রয়েছে।
যশোর চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সাবেক সভাপতি মো. শহিদুল ইসলাম মিলন বলেন, সেতুটি এ অঞ্চলের অর্থনীতিকে চাঙা করবে এবং সড়ক যোগাযোগ ব্যাপকভাবে সহজ করবে।
বেনাপোল স্থলবন্দর, মোংলা সমুদ্রবন্দর ও নোয়াপাড়া নদীবন্দরের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বহুগুণ বাড়বে উল্লেখ করে এ ব্যবসায়ী নেতা বলেন, এ অঞ্চলের বাসিন্দারা একদিনের মধ্যে ঢাকায় তাদের কাজ শেষ করে ঘরে ফিরতে পারবেন। সেতুটি চালু হওয়ায় কালনা ফেরিঘাট হয়ে যেতে তাদের দীর্ঘদিনের যে ভোগান্তি, তার অবসান হবে।
নড়াইল জেলা প্রশাসক মো. হাবিবুর রহমান বলেন, প্রধানমন্ত্রী ২০০৮ সালে নড়াইলের সুলতান মঞ্চে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, কালনা পয়েন্টে একটি সেতু হবে। প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি পূরণ হয়েছে। সেজন্য নড়াইলবাসী তথা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সব জেলার মানুষ শুভেচ্ছা ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছেন।
সওজের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী ও প্রকল্পের পরিচালক শ্যামল ভট্টচার্য বলেন, ক্রস বর্ডার রোড নেটওয়ার্কে ১৭টি সেতু নেওয়া হয়েছিল। এ সেতু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। স্বপ্নের পদ্মা সেতুর সুফল এরই মধ্যে পেয়েছি। কিন্তু সেই সুফল পুরোপুরি পেতে নড়াইল, যশোরসহ এ অঞ্চলের যেসব স্থলবন্দর রয়েছে বা অন্যান্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আছে, তাদের জন্য এ মধুমতি সেতুর কানেকশন জরুরি ছিল। সেই স্বপ্ন পূরণ হলো।
এটা কেন ক্রস বর্ডার রোড নেটওয়ার্ক সে সম্পর্কে প্রকল্প পরিচালক বলেন, এ অঞ্চলের সাব-রিজিনিওয়াল কানেক্টিভিটি মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে।
এসইউজে/এমএইচআর/এমএস