বাংলাদেশ কোভিডকালীন সংকটের মধ্যে সবচাইতে সফল দেশ হিসেবে বিশ্বের বুকে প্রশংসা কুড়চ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশটি তার শত সমস্যা ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেছে বিগত বছরগুলোতে। সম্প্রতি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ভুক্তভোগী দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশ অন্যতম। কিন্তু তারপরও করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় সফল বাংলাদেশ। তার মূল কারণ, বাংলাদেশ সবার আগে হয়ে এসেছে 'জিরো কোভিড পলিসি' থেকে।
Advertisement
কিন্তু ‘জিরো কোভিড পলিসি’র কারণে মানুষের দুর্ভোগ বেড়েই চলেছে চীনে। সাধারণ মানুষের সেই দুর্ভোগে মোটেই টনক নড়ছেনা চীনা কমিউনিস্ট নেতাদের। দেশের অর্থনীতির বেহাল দশাতেও তারা মোটেই চিন্তিত নন। নিজেদের মর্জিতে চলেছেন সেখানকার কমিউনিস্ট নেতারা। সম্প্রতি বিবিসি সেখানকার জনদুর্ভোগের একটি ছবি তুলে ধরে। ঘটনাটি গত জুন মাসের। সাংহাই থেকে প্রচুর মানুষ দ্রুতগামী ট্রেনে চেপে বেইজিং যাচ্ছিলেন। কিন্তু মাঝপথে ট্রেন থামিয়ে যাত্রীদের সকলকে নেমে যেতে বাধ্য করা হয়। মাইকে ঘোষণা করা হয়, তারা যেহেতু কোভিডের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা থেকে আসছেন তাই সকলকেই কোয়ারেন্টাইনে যেতে হবে। তারপর বাসে চাপিয়ে একশো মাইলেরও বেশি দূরে নিভৃতবাসে নিয়ে যাওয়া হয় তাদের। মানুষের আপত্তিকে বিন্দুমাত্র আমল দেয়নি চীনা প্রশাসন।
চীনা প্রশাসনের গোপনীয়তার পর্দা ফাঁস করে এমনকিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য সামনে আসতে শুরু করেছে। যেমন গত আগস্ট মাসে চীনের জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র সানাইয়ায় কয়েকজনের মধ্যে করোনা সংক্রমণ দেখা দিতেই সেখানে হঠাৎ করে লকডাউন ঘোষণা করা হয়। ৮০ হাজারেরও বেশি পর্যটক আটকে পড়েন। পর্যটকদের দুর্ভোগের কথা বিবেচনা না করেই ট্রেন, বাস, বিমান সমস্ত কিছু বন্ধ করে দেওয়া হয়। পর্যটনকেন্দ্র বেইহাইতেও চীনা প্রশাসনের আকস্মিক লকডাউন ঘোষণায় ২ হাজারেরও বেশি পর্যটক আটকে পড়েছিলেন জুলাই মাসে। তাই সিএনএনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অন্তহীন ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা এবং লকডাউনের মাধ্যমে চীনের পর্যটন শিল্পকে ধ্বংস করা হচ্ছে।
কেউ করোনা সংক্রমিতের ধারে কাছে এসেছে বলে সন্দেহ হলেই তাকে কোয়ারেন্টাইন বা নিভৃতবাসে পাঠানোটাই হচ্ছে চীনের জিরো কোভিড নীতির মূলকথা। সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই সম্প্রচার সাংবাদিকতা পাঠের চীনের যোগাযোগ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসে দু-একজনের কোভিড হতেই শ-পাঁচেক শিক্ষার্থীকে কোয়ারেন্টাইনে পাঠানো হয়ে।
Advertisement
মেঠো হাসপাতাল, রূপান্তরিত স্টেডিয়াম অথবা প্রদর্শনী কেন্দ্রের মতো স্থানে গড়ে ওঠা অস্থায়ী কোয়ারেন্টাইন কেন্দ্রগুলি অতিরিক্ত ভিড়, দুর্বল নিকাশি ব্যবস্থা এবং অস্বাস্থ্যকর খাবারের জন্য মানুষের কাছে আতঙ্কের কারণ হয়ে উঠেছে। সেপ্টেম্বর মাসের তৃতীয় সপ্তাহে ১ হাজার ২৪৮ জন করোনায় সংক্রমিত হলেও চীনে সাড়ে ছয় কোটি মানুষকে লকডাউনের দুর্ভোগে নিক্ষেপ করা হয়েছে।
গত ৫ সেপ্টেম্বর সিচুয়ান প্রদেশে ৬.৮ ম্যাগনিচুড ভূমিকম্প হলেও কোভিড সংক্রমণের অজুহাত দেখিয়ে সেখানকার মানুষদের বাইরে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়নি। এমনকী উদ্ধারকারী ও স্বাস্থ্যকর্মীদেরও কোভিড পরীক্ষা করে তবে ভূমিকম্প বিধ্বস্ত এলাকায় যেতে দেওয়া হয়। ভূমিকম্প বিধ্বস্ত এলাকার মানুষ খাদ্য ও অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীর অভাবে ভুগলেও কোভিড বিধিনিষেধ কিছুতেই শিথিল করতে রাজি হয়নি প্রশাসন। ১০ সেপ্টেম্বর মধ্য-শরতের ছুটির সময়ও বেইজিং-এর নাগরিকদের ঘরবন্দি থাকা নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। একদিনে ২১ জন কোভিড রোগী শনাক্ত হওয়ার পর বেইজিংয়ের ২ কোটি ১৫ লাখ বাসিন্দাকে একদিন অন্তর কোভিড পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে। বেইজিংয়ের বাইরের অবস্থা আরও শোচনীয়। মিয়ানমার সীমান্তবর্তী এলাকায় লাগাতর লকডাউনের কারণে ব্যবসায়ীরা স্থান পরিত্যাগ করতে বাধ্য হচ্ছেন।
লাগাতর লকডাউন মানুষকে অনলাইনে বিক্ষোভ এবং স্বাস্থ্যকর্মী ও পুলিশের সাথে সংঘর্ষের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। বেইজিং কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদক কাই কুই ঘোষণা করেন, কোভিডের গণপরীক্ষা ও লকডাউন আরও পাঁচ বছর ধরে চলতে পারে। আর তারপরই সামাজিক গণমাধ্যমে তীব্র প্রতিবাদ শুরু হয় বলে জুন মাসের গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। চীনের জনপ্রিয় সামাজিক গণমাধ্যম ওয়েইবোতে একজন মন্তব্য করেছিলেন, 'চীন থেকে পালানোর কাউন্টডাউন শুরু'। আরেকজন মন্তব্য করেছিলেন, 'মহামারি থেকে সাধারণ জীবনে ফিরে আসার লড়াইটাই হচ্ছে আসল। অথচ এই বিষয়টিই সকলকে ভুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে'। আরেকজনের হতাশাজনক মন্তব্য, 'আরও ৫ বছর...! কী দরকার অতোদিন বেঁচে থাকার!'
চীনের এই জিরো কোভিড নীতিতে তিব্বতের লাসা শহরের মানুষ ব্যাপক সমস্যায় পড়েছেন। ১৬ সেপ্টেম্বর পাওয়া খবর অনুযায়ী মাত্র ৫৪০ জনের সংক্রমণ হওয়ায় সেখানকার ৮ লক্ষ ৬০ হাজার মানুষকে লকডাউনের কারণে চরম খাদ্যসঙ্কটের শিকার হতে হয়। লাসার বাসিন্দা সাম ওয়াং জানান, তাকে ৩৬ দিন ঘরবন্দি রাখা হয়েছিল। শহরের বাকিদেরও হয় ঘরে বন্দি, নয় হাসাপাতালে আশ্রয় নিতে বাধ্য করা হয়। তিনি শোনান তীব্র খাদ্যসঙ্কটের পাশাপাশি শিশুদের চিকিৎসাতেও অব্যবস্থার কথা।
Advertisement
চীনের জিরো কোভিড পলিসির কুপ্রভাব পড়ছে আন্তর্জাতিক স্তরেও। কৌশলগত এবং আন্তর্জাতিক অধ্যয়ন কেন্দ্রের ২৭ জুন প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে,'চীনের অর্থনীতি ২০০০ সালের গোড়ার দিকের তুলনায় আরও খারাপ হয়ে পড়েছে। তাদের অর্থনৈতিক স্থানচ্যুতি এখন আন্তর্জাতিকস্তরেও ছড়িয়ে পড়ছে। ত্বরান্বিত করছে মুদ্রাস্ফীতিকে। সরবরাহ চেইন ব্যাহত হওয়ায় চীন থেকে বিদেশী ব্যবসার পশ্চাদপসরণ শুরু হয়েছে। চীনের গভীর বিচ্ছিন্নতা নিয়ে আন্তর্জাতিক উদ্বেগ বাড়ছে।' প্রতিবেদনটিতে আরও বলা হয়েছে, 'অনেক পশ্চিমি বহুজাতিক সংস্থা আগামীদিনে চীনে তাদের কর্মসূচি পুনর্মূল্যায়ন করতে পারে। অনেকে চীনে নতুন বিনিয়োগ বন্ধ করে দিয়েছে। কেউ কেউ শুরু করে দিয়েছে উৎপাদন অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার কর্মকাণ্ডও'।
বৈদ্যুতীন সরঞ্জামের দুনিয়ার সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার শেনজেনের সমস্ত দোকানদারদের ২৯ আগস্ট চারদিনের জন্য বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়। ফলে অর্থনীতির ব্যাপক ক্ষতি হয়। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান বা ইওরোপের দেশগুলি অতিমারির পর দ্রুত নিজেদের অর্থনীতি চাঙ্গা করতে সচেষ্ট হলেও চীন এখনও সেই মহামারির যুগেই থমকে রয়েছে। শি জিনপিংয়ের আমলে প্রকাশ্যে সরকারের সমালোচনা করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। তবু চাপা গুঞ্জন শুরু হয়েছে ভাইরাস নিয়ন্ত্রনের নামে মানুষের দুর্ভোগ বাড়িয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে। অবাউন্ড রিসার্চ সেন্টারের মতে, লকডাউনের বদলে চীনের এখন সময় হয়েছে দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জরুরি পরিচালক মাইকেল রায়ান গত মে মাসে চীনের ভাইরাস নীতি প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন, 'ভাইরাস নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি সমাজ ও অর্থনীতিতে তার কুপ্রভাবের বিষয়েও সতর্ক থাকা জরুরি।'
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, কোভিড জিরো নীতির কারণেই চীনে আরও বাড়ছে সংক্রমণের ঝুঁকি। কারণ অতিরিক্ত সতর্কতা নিতে গিয়ে বহু মানুষের কাছে একটির বেশি টিকাই পৌঁছানো যায়নি। স্বাস্থ্যকর্মীদের ওপরও বিধিনিষেধের ফলে ৬০ বছরের বেশি বয়স্ক ১০ কোটিরও বেশি মানুষ একটির বেশি টিকাই পাননি। ফলে সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ছে।
সামনেই চীনা কমিউনিস্ট পার্টির পার্টি কংগ্রেস। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং নিজের ব্যর্থতা ঢাকতেই জিরো কোভিড নীতিকে আগলে ধরেছেন। ফের ক্ষমতা দখলের জন্য কোনওরকম ঝুঁকি নিতে চাননা তিনি। মানুষের দুর্ভোগ বাড়লেও তা নিয়ে কখনই বিচলিত নন চীনা কমিউনিস্ট নেতারা। সেন্টার ফর স্ট্রাটেজি অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়েছে, 'চীন বা তাদের দখলিকৃত তিব্বতের সাধারণ মানুষদের দুর্ভোগকে কবেই বা কমিউনিস্ট পার্টি আমল দিয়েছে'!
চীনকে বলা হয় গণপ্রজাতন্ত্রী। কিন্তু বাস্তবতা হলো, দেশটিতে সমাজতন্ত্রের মোড়কে চলছে পুঁজিবাদ এবং সেটাও মুষ্টিমেয় গোষ্ঠির নিয়ন্ত্রিত পুঁজিবাদ। যেখানে কারো বলার কিছু নেই, করারও কিছু নেই। সেখানে আন্দোলন করা নিষিদ্ধ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নিয়ন্ত্রিত। তিয়েনমেন স্কয়ারকে স্মরণ করে ট্যাঙ্কসদৃশ কেক নিয়ে লাইভে এলেও বন্ধ করে দেয়া হয় লাইভ স্ট্রিম। আটক করা হয় শিল্পীকে। এমন এক দেশের মানুষ দারুণ অর্থনৈতিক ঝুঁকিতে রয়েছে তাদের 'জিরো কোভিড নীতি' নিয়ে।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট।
এইচআর/এমএস