# কর্মঘণ্টার ৫-৬ ঘণ্টাই বিদ্যুৎ পাচ্ছে না শিল্প-কারখানা# কারখানাভেদে উৎপাদন কমেছে ৩০-৫০ শতাংশ# ডিজেলচালিত জেনারেটরে সচল কারখানা, বাড়ছে ব্যয়# বিদেশি ক্রেতাদের অর্ডার অনুযায়ী পণ্য দিতে হিমশিম# সেপ্টেম্বরে রপ্তানি কমেছে ৬ দশমিক ২৫ শতাংশ# আন্তর্জাতিক বাজারে ‘সুনাম’ খোয়াচ্ছে বাংলাদেশি ব্র্যান্ড# সংকট নিরসনে নেই সরকারের কোনো ‘প্রতিশ্রুতি’
Advertisement
করোনাভাইরাস মহামারির ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা। ঠিক সেই সময়ে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। মহামারি ও যুদ্ধের নেতিবাচক প্রভাব বিশ্ব অর্থনীতিতে। আন্তর্জাতিক বাজারে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ে জ্বালানি তেলের দাম। এর প্রভাব পড়ে বাংলাদেশেও। সঙ্গে বিষফোড়া হয়ে দেখা দেয় মার্কিন ডলারের সংকট। দেশেও রেকর্ড দাম বাড়ানো হয় জ্বালানির। গ্যাস ও বিদ্যুৎ উৎপাদনেও ভাটা পড়ে। এলাকাভিত্তিক লোডশেডিং শুরু করে সরকার। এমন বহুমুখী সংকটে রীতিমতো ধুঁকছে দেশের ভারী শিল্প। ফলে একদিকে কমেছে উৎপাদন, অন্যদিকে বেড়েছে খরচ। এতে বিপাকে পড়েছেন রপ্তানিমুখী উদ্যোক্তারা।
রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠানসংশ্লিষ্টরা বলছেন, তৈরি পোশাক, সার, সিমেন্ট, সিরামিক ও ইলেকট্রনিক্স পণ্য প্রস্তুতকারকদের উৎপাদন কমেছে ৩০-৫০ শতাংশ। গ্যাস সংকট ও লোডশেডিংয়ের সময়ও ডিজেলচালিত জেনারেটরে কারখানা সচল রাখতে হচ্ছে। ফলে উৎপাদন খরচ বেড়েছে ৫০-৬০ শতাংশ। অপর্যাপ্ত জ্বালানিতে উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় অর্ডার থাকলেও সময়মতো পণ্য রপ্তানি করতে পারছেন না তারা। দ্বারে দ্বারে ঘুরেও তারা আশার কথা শুনতে পারছেন না। এতে আন্তর্জাতিক বাজারে ভাবমূর্তি হারাতে বসেছেন বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা।
পেট্রোবাংলা সূত্র জানিয়েছে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম এখনো চড়া। সেই সঙ্গে দেশে মার্কিন ডলারের সংকট। এ কারণে সরকার খোলাবাজার থেকে তরল প্রাকৃতিক গ্যাস বা এলএনজি আমদানি বন্ধ রেখেছে। এতে গ্যাসের সরবরাহ ৭-৮ শতাংশ কমেছে। জ্বালানি সংকটে বিদ্যুতের উৎপাদন কমেছে। ফলে দেশজুড়ে বেড়েছে লোডশেডিং।
Advertisement
গ্যাস সংকট ও লোডশেডিংয়ে শিল্প কারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। বিকল্প উপায়ে কারখানা চালু রাখাও কঠিন হয়ে পড়েছে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায়। এজন্য তেলের দাম কমানোর অনুরোধ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ)। চিঠিতে বলা হয়, ‘পোশাক কারখানাগুলোতে চরম বিদ্যুৎ সংকট চলছে। সাপ্তাহিক ছুটি দুদিন করা হয়েছে। কর্মঘণ্টা এক ঘণ্টা কমিয়ে আনা হয়েছে। লোডশেডিং চলাকালে উৎপাদন অব্যাহত রাখতে উচ্চমূল্যের ডিজেলে জেনারেটর ব্যবহারে বাধ্য হচ্ছেন মালিকরা।’
এতে আরও বলা হয়, গত বছরের ৮০ টাকা লিটারে কেনা ডিজেল এখন ১০৯ টাকায় কিনতে হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে ডিজেলের দাম সমন্বয় করে পুনর্নির্ধারণ করা হলে পোশাক শিল্পসহ সংশ্লিষ্ট সবাই উপকৃত হবেন। কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন অব্যাহত রাখার স্বার্থে ডিজেলের মূল্য সমন্বয় ও সরবরাহ ঠিক রাখার অনুরোধ জানাচ্ছি।
নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা অ্যাপারেলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলে শামীম এহসান। তিনি বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সহ-সভাপতি। জ্বালানি সংকটে তার কারখানার উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। তার মতো আরও অনেক কারখানার মালিক লোডশেডিংয়ে বিপর্যস্ত। ব্যক্তিপর্যায় ও সংগঠনকেন্দ্রিক যোগাযোগ করেছেন সরকারের উচ্চমহলের সঙ্গে। তবে চলমান সংকট সমাধানে তিনি কোনো প্রতিশ্রুতি পাননি।
আরও পড়ুন: অর্ডার বাতিল করছে ওয়ালমার্ট, বড় ক্ষতির মুখে পোশাকশিল্প
Advertisement
ফজলে শামীম এহসান জাগো নিউজকে বলেন, ‘পোশাক কারখানায় গ্যাসের চাপ ১৫ পিএসএ থাকতে হয়। এটা আমার এখানে থাকতো শূন্য বা এক থেকে দুই পিএসএ। কিছুদিন হলো এটার অবস্থা একটু ভালো হয়েছে। কিন্তু সেটাও বলার মতো নয়। মাসে আমার গ্যাস বিল আসে ৭০ লাখ টাকার মতো। আবার লোডশেডিংয়ের জন্য প্রতিদিন ছয়-সাত লাখ টাকার ডিজেল কিনতে হচ্ছে। গত মাসে প্রায় দুই কোটি টাকার ডিজেল কিনতে হয়েছে। অথচ কারখানায় উৎপাদন হয়েছে আগের চেয়ে অর্ধেকেরও কম।’
সময়মতো অর্ডার অনুযায়ী পণ্য রপ্তানি করতে পারছেন না উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ইউরোপে এখন চরম মূল্যস্ফীতি। ফলে অর্ডার আগের চেয়ে অনেক কম। যেটুকু অর্ডার হচ্ছে, সেই অর্ডার অনুযায়ীও ক্রেতাদের (বায়ার) পণ্য সরবরাহ করতে পারছি না। ফলে তাদের (বিদেশি বায়ার) কাছে আমাদের সম্পর্কে ভুল বার্তা যাচ্ছে, প্রতিষ্ঠানের সুনাম ক্ষুণ্ন হচ্ছে।’
ফজলে শামীম বলেন, ‘সরকারকে বলেছি, বিকল্প উপায়ে সমস্যার সমাধান নিয়ে আমাদের সঙ্গে বসুন। অনেক বিকল্প আছে। যেমন- ডিজেল কিংবা ফার্নেস ওয়েলে ভ্যাট, ট্যাক্স মওকুফ করা যেতে পারে। সরকারের অনেক ফান্ড রয়েছে। এক্সপোর্টের অনেক ফান্ড আছে, যেগুলো ব্যবহারই হচ্ছে না। সেগুলো জ্বালানি আমদানিতে ডাইভার্ট (স্থানান্তর) করা যেতে পারে। সরকার আমাদের সফট (স্বল্প সুদে) লোন দিতে পারে। কিছু একটা করা যেতেই পারে। এজন্য সমস্যাটা আগে অনুধাবন করতে হবে।’
উৎপাদনে অনাগ্রহ, বন্ধ অনেক কারখানা
জ্বালানি সংকট ও খরচ বাড়ায় অনেক কারখানা বন্ধ রেখেছেন মালিকরা। অর্ডার থাকলেও তারা পণ্য উৎপাদনে অনাগ্রহী। এসব কারখানায় রপ্তানিমুখী পণ্য তৈরি হতো।
আরও পড়ুন: গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধান করতে পারলে জ্বালানি সংকট থাকবে না
উৎপাদন বন্ধ রাখা একাধিক কারখানার মালিকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বেশি দামে জ্বালানি কিনে পণ্য উৎপাদনে তাদের আগ্রহ নেই। জ্বালানি না থাকায় কাঁচামালের অপচয় বাড়ছে। বিকল্প উপায়ে জ্বালানির ব্যবস্থা করতে গেলে উৎপাদন খরচ অন্তত ৫০-৬০ শতাংশ বেড়ে যাবে। এতে বড় লোকসান গুনতে হচ্ছে। সার্বিক দিক বিবেচনায় তারা উৎপাদন বন্ধ রাখাই শ্রেয় মনে করছেন।
অর্ধেকে নেমেছে টাইলস-সিরামিক পণ্যের উৎপাদন
গ্যাস সংকটে অর্ধেকে নেমেছে টাইলস ও সিরামিক পণ্যের উৎপাদন। রাজধানীর মিরপুর, বাংলামোটর, নদ্দার একাধিক টাইলস ও সিরামিকের দোকানে গিয়ে দেখা গেছে, ক্রেতাদের পর্যাপ্ত পণ্য ডেলিভারি দিতে পারছেন না বিক্রেতারা।
মিরপুর-১০ নম্বরের এবিসি টাইলসের স্বত্বাধিকারী পারভেজ মাসুদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘ফ্রেশ কোম্পানিকে দুই সপ্তাহ আগে বেশকিছু অর্ডার দিয়েছিলাম। তারা পণ্য দিতে পারেননি। অন্য কোম্পানিও অর্ডারের পণ্য দিতে গড়িমসি করছে। পণ্য দিতে না পারলে তো ক্রেতাদের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হবেই, হচ্ছেও তাই।’
এক্সিলেন্ট সিরামিক আইএনডি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল হাকিম সুমন। তিনি বাংলাদেশ সিরামিক ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিএমইএ) পরিচালক পদেও রয়েছেন।
আরও পড়ুন: ৯ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন রপ্তানি
আবদুল হাকিম সুমন জাগো নিউজকে বলেন, গ্যাস সংকট কাটছেই না। এর প্রভাবে কারখানায় উৎপাদন কমে গেছে। আগে যে পরিমাণ উৎপাদন হতো, এখন তার অর্ধেক হয়। গ্যাসের যে চাহিদা, তার ৫০ শতাংশও সরকার দিতে পারছে না। এজন্য উৎপাদনও ৫০ শতাংশ কমে গেছে। এটা গ্যাসনির্ভর কারখানা, এখানে অন্য জ্বালানি দিয়ে পোষানো সম্ভব নয়।
তিনি বলেন, ‘আমরা জ্বালানি উপদেষ্টা, মন্ত্রী, তিতাস, পেট্রোবাংলাসহ সবার সঙ্গে কথা বলেছি। কেউই কোনো আশ্বাস দিতে পারেননি। বরং ক্রাইসিস আগামীতে আরও বাড়তে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। গ্যাস নেই, তারা (সরকার) কোথা থেকে দেবে? ইন্ডাস্ট্রিটা কীভাবে যে চালাবো, সেটা নিয়ে কোনো গাইডলাইনও আমরা পাইনি। এভাবে চলতে থাকলে কারখানা বন্ধ করে দিতে হবে। তখন কর্মী ছাঁটাই ছাড়া বিকল্প থাকবে না।’
আরও পড়ুন: গ্যাস উত্তোলন বাড়ানোই সমাধানের একমাত্র উপায়
এই ব্যবসায়ী নেতা বলেন, ‘দিন দিন আমরা ঋণগ্রস্ত হচ্ছি। ব্যাংকে মাসে মাসে ইনস্টলমেন্ট দিতে হচ্ছে। সেটা দিতে গিয়ে হিমশিম অবস্থা। অনেকে দিতেও পারছে না। প্রতিদিন লোকসান গুনছি। এভাবে চললে দেউলিয়া হতে খুব বেশি সময় লাগবে না।’
‘প্রবৃদ্ধি’র রপ্তানি খাতে এখন ‘মন্দাভাব’
গ্যাস সংকট, লোডশেডিং ও ডিজেলের দাম বাড়ায় কারখানায় উৎপাদন কমেছে। এর প্রভাব পড়েছে রপ্তানিতেও। একবছর ধরে রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি দেখা গেলেও গত জুলাই থেকে মন্দাভাব।
কারখানার মালিকরা বলছেন, দিনে কর্মঘণ্টার মধ্যে ৫-৬ ঘণ্টা লোডশেডিং থাকছে। ফলে বাড়তি দামে কেনা ডিজেল দিয়ে জেনারেটর চালাতে হচ্ছে। এতে উৎপাদন খরচ দ্বিগুণ হচ্ছে। অথচ ইউরোপ ও আমেরিকায় রপ্তানি কমেছে।
আরও পড়ুন: ওয়ালমার্টের অর্ডার বাতিল: আপাতত ‘অবজারভেশনে’ পোশাক উৎপাদকরা
জানা গেছে, সর্বশেষ সেপ্টেম্বরে ৩৯০ কোটি ৫০ লাখ বা ৩ দশমিক ৯০ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করা হয়েছে। গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় যা ৬ দশমিক ২৫ শতাংশ কম। ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে আগের বছরের (২০২১-২২) জুলাইয়ের চেয়ে রপ্তানি আয় কমেছে ৬ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ।
২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর- এ তিনমাসের চেয়ে চলতি অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে অনেক পণ্যের রপ্তানি আয় কমেছে। এর মধ্যে কৃষিপণ্যে ১৭ দশমিক ৯৮ শতাংশ, কেমিক্যালের পণ্যে ২৩ দশমিক ২৮ ও কাচজাতীয় পণ্যে ৫২ দশমিক ৭৯ শতাংশ রপ্তানি কম হয়েছে। একই সময়ে তৈরি পোশাক, প্লাস্টিকসহ অনেক পণ্যের প্রবৃদ্ধি হয়েছে। তবে তা খুব বেশি আশাব্যঞ্জক নয় বলছেন সংশ্লিষ্টরা।
আরও পড়ুন: অর্থনীতিতে বিদ্যমান চাপ ‘সাময়িক’, বললেন বিশ্লেষকেরা
রপ্তানি খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, রপ্তানির প্রধান বাজার ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যম্ফীতির কারণে ভোক্তাপর্যায়ে চাহিদা কিছুটা কম। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বিএম ডিপোতে অগ্নিকাণ্ডের পর পাঁচমাস ধরে কয়েকটি পণ্যের রপ্তানি স্থগিত আছে। সবমিলিয়ে রপ্তানিতেও এমন নিম্নমুখী ধারা আরও কয়েক মাস অব্যাহত থাকতে পারে।
এসএম/এএএইচ/এসএইচএস/এমএস