ভ্রমণ

সুন্দরবনের চাঁদপাঁই রেঞ্জে যা দেখবেন ও যেখানে থাকবেন

ইসতিয়াক আহমেদ

Advertisement

ষাট গম্বুজ মসজিদসহ বাগেরহাটে বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান ঘুরে সুন্দরবনের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম আমরা ৬ জন। গন্তব্য সুন্দরবনের চাঁদপাঁই রেঞ্জের দক্ষিণ চিলা গ্রামে। মংলা পৌঁছেই আমাদের প্রথম কাজ পশুর নদী পাড়ি দেওয়া।

এক্ষেত্রে জনপ্রতি ৫ টাকা নৌকা ভাড়া আর ১ টাকা ঘাটের টোল প্রদান করতে হলো নদী পার হতে। যেতে হবে আরও পথ। গন্তব্য সুন্দরবনের চাঁদপাঁই রেঞ্জের দক্ষিণ চিলা গ্রামের ‘বাদাবন ইকো কটেজে’।

তাই দামাদামি করে ২২০ টাকায় একটি অটো রিজার্ভ নিলাম। প্রায় ১২ কিলো পথ পাড়ি দিয়ে এবার আমাদের বৈদ্যমারী যাবার পালা, সেখানেই আছে বাদাবন এর ধার ঘেষা আমাদের কটেজ।

Advertisement

সুন্দরবনকে স্থানীয়রা মূলত বাদাবন বলেই ডাকেন। চিংড়ির ঘের ঘেরা গ্রামীণ ব্যাপক ন্যাচারাল বিউটি গিলতে গিলতে আমাদের ছুটে চলা দক্ষিণ চিলা পথে।

প্রায় ৩০ মিনিট পথ চলার পর অতঃপর আমরা এসে পৌঁছালাম দক্ষিণ চিলায়। বেশ গহীনে এই গ্রাম হলেও আধুনিক জীবন যাত্রায় অনেক কিছুর ছোঁয়া পাবেন। সেখানে আছে বিদ্যুৎ, আছে মোবাইলের ফোরজি নেটওয়ার্ক।

ঘরে বসে সুন্দরবনের পাক-পাখালির ডাক, পায়ে হেঁটে সুন্দরবনের অপার সৌন্দর্য উপভোগ, নিরাপত্তার সঙ্গে নিশিযাপন, মানসম্মত খাবার গ্রহণ, একই সঙ্গে স্বল্প খরচে লোকালয় থেকে খুব কাছেই সুন্দরবন উপভোগের সুযোগ মিলবে এই গ্রামে।

স্থানীয় গ্রামীণ পিছিয়ে পড়া জনগনের আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও পর্যটন বিকাশের স্বার্থে স্থানীয় কিছু এনজিও এর সহায়তায় কমিউনিটি ইকো ট্যুরিজম এর অংশ হিসেবে ২০১৮ সালে চাঁদপাঁই ফরেস্ট রেঞ্জের আওয়ায় গড়ে তোলা হয় অসাধারণ ‘বাদাবন ইকো কটেজ’।

Advertisement

কটেজে প্রবেশ পথের শুরুতেই পড়বে পুকুর আর তার পাড়ে রিসিপশন ও ডাইনিং এরিয়া। পুকুরের উপরেও আছে বসে আড্ডা দেবার মতো সুন্দর ব্যবস্থা। যদি চান তবে মাছ ও মারার সুযোগ আছে পুকুরে কিংবা চিংড়ি ঘেরে।

প্রথমে ওয়েলকাম ড্রিংক্স হিসেবে লেবুর শরবত প্রদান করা হলো আমাদের। কটেজের গাছের টাটকা লেবু দিয়ে তৈরি সাথে সুন্দর উপস্থাপনা। শুরুতেই মন ভালো করে দেবে আপনাদের।

এদের রিসিপশন ও ডাইনিং রুমটির ও কিছু বিশেষত্ব আছে। এখানে প্রায় ২০০ বছরের পুরনো সুন্দরী গাছের কংকাল দিয়েই তৈরি তাদের বসার সোফা। একই সঙ্গে প্রায় শতবর্ষী কিছু টালি ব্যবহার করা হয়েছে ছাদ তৈরিতে।

এবার পালা আমাদের রুম বুঝে নেওয়ার। চিংড়ি ঘেরের উপর, সম্পূর্ণ ইকো ফ্রেন্ডলি ইকুইপমেন্ট দিয়েই বানানো দুটো কটেজ। যার একটির নাম শুশুক, আরেকটা ইরাবতী। মূলত দুটো কটেজের নামই ডলফিনের দুটি প্রজাতীর নামে। উপরে গোলপাতার ছাদ।

তার ভেতরে বাঁশ, বেত আর কাঠ দিয়ে তৈরি এই অসাধারণ স্থাপনা। প্রতিটি কটেজেই আছে দুটো করে ডাবল ফ্লোরিং বেড। আর পর্যাপ্ত ফ্যান। একই সঙ্গে আছে পর্যাপ্ত চার্জিং এত ব্যবস্থা। একই সঙ্গে আছে হাই কমোড ও লো কমোড উভয় ব্যবস্থা যুক্ত দুটো ওয়াশরুম।

ফ্রেশ হতেই চলে আসলো আমাদের জন্য দেশি স্থানীয় ফল। কটেজের গাছের আমড়া মাখানো। যার পরিবেশনাও আপনাকে মুগ্ধ করবেই। সবচেয়ে আকর্ষণীয় এই কটেজের রুমের বাইরের বারান্দায় থাকা আড্ডা দেওয়ার সিটিং এরিয়াটি।

ফ্রেন্ডস বা ফ্যামিলি নিয়ে বসে ঘেরের সৌন্দর্য, কিংবা বিকালের সূর্যাস্ত অথবা রাতের তারাভরা আকাশ সব কিছুই উপভোগ করতে পাবেন সেখানে বসে। আবার কটেজের সঙ্গেই বাঁধা থাকে একটি নৌকা। ইচ্ছে হলেই বেরিয়ে পড়তে পারেন ঘেরে। চালাতে পারেন আনলিমিটেড নৌকা।

এ কটেজে এলে যেমন বনের আশপাশের সহজ-সরল মানুষের জীবন-যাত্রা সম্পর্কে জানতে পারবেন, তেমনই তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি, বিশ্বাস, ধর্ম, প্রথা জানতে পারবেন। কীভাবে সহ-ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে তারা বনরক্ষায় কাজ করছে তা দেখার পাশাপাশি রাতে স্থানীয়দের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও উপভোগ করতে পারবেন এখানে।

এরই মধ্যে আমাদের দুপুরের খাবারের ডাক পড়েছে, এ যাত্রায় দুপুরের খাবারের আয়োজন হিসেবে আছে ঘেরের চিংড়ি, আছে দেশি মুরগির মাংস, আলু ভর্তা, ঘন ডাল, অর্গানিক সবজি ও অসাধারণ স্বাদের মিষ্টি দই।

খাবার খেয়ে এবার খানিক বিশ্রাম নেওয়ার পালা। এখানে ঘেরের সঙ্গে লাগোয়া আছে হ্যামক, আছে বিচ চেয়ার। সেগুলোতে বসে বা শুইয়ে কাটিয়ে দেয়া সম্ভব পুরো একটা বেলা। তবে আমাদের হাতে সময় কম। কারণ বিকেল হলেই বেড়িয়ে পড়বো ক্যানেল ক্রুজিংয়ে।

বিকেল ৫টায় বেড়িয়ে পরলাম লিটন ভাইয়ের সঙ্গে। মো: লিটন জমাদ্দার ভাইয়ের মূলত স্বপ্নের প্রজেক্ট এই বাদাবন ইকো কটেজ। তিনি একজন প্রশিক্ষিত ট্যুর গাইডও। মাত্র ৫ মিনিট এর পথ হেঁটেই আমরা ঢুকে পরলাম সুন্দরবন এর চাঁদপাঁই রেঞ্জের বৈদ্যমারী বন বিট অফিসে।

এখান থেকেই মূলত সংরক্ষিত বন এর শুরু। আমাদের ভাগ্য কিছুটা খারাপ কারণ এখন চলছে ভাটা। জোয়ার আসবে গভীর রাতে। আর তাই নৌকা নিয়ে ক্যানেল ক্রুজিং আর কপালে নেই এই যাত্রায়। তাই পায়ে হেঁটেই ঢুকে পড়লাম আমরা সুন্দরবনের ভেতরে। আর লিটন ভাইয়ের কাছ থেকে শুনছিলাম বাঘ নিয়ে তাদের নানান বাস্তব অভিজ্ঞতা ও সম্প্রতি ঘটে যাওয়া নানা ঘটনা।

বন এর খানিক ভেতরে ঢুকতেই প্রথমেই দেখা পেলাম এক বন বিড়ালের পায়ের ছাপ। সেটি পেরিয়ে একটু সামনেই একটি বট গাছ, এই গাছের গোড়ায় মুসলিম মৌয়াল বা বাউয়ালরা কালু গাজীর নামে সিন্নি মানত করেন স্থানীয়রা।

আধ্যাত্মিক কালু গাজী সম্পর্কে সুন্দরবনের মানুষ জানায়, তারা কালু গাজীকে সাধক ও দরবেশ মনে করেন। তিনি নাকি বনে হারিয়ে যাওয়া মানুষকে পথ দেখিয়ে লোকালয়ে ফিরে আসতে, বাঘের মুখ থেকে বাঁচাতেন, বন্য শুকরের কবল থেকে উদ্ধার করতেন। তারা আরও জানান, তাকে চাইলেই দেখা যায় না। তার ঘর-বাড়ি কেউ দেখেননি, তবে বিপদে পড়া মানুষকে তিনি উদ্ধার করেন।

কালু গাজীর মতোই হিন্দু সম্প্রদায় আরেকজনের পূজা করেন তিনি হলেন বন বিবি। কালু গাজীর মানতের গাছ পেরিয়ে দল বল ছেড়ে কাঁদা মারিয়ে আমি আরো গহীনে ঢুকে পরলাম বন বিবির পূজা হবার গাছের সন্ধানে। খানিক ভেতরে মৃত প্রায় আরেক বট গাছ। আর সেই গাছের গোড়াতেই হয় মূলত বন বিবির পূজা।

বনবিবি হলেন বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্গত সুন্দরবন অঞ্চলে মৎস্যজীবী, মধু-সংগ্রহকারী ও কাঠুরিয়া জনগোষ্ঠীর দ্বারা পূজিত এক লৌকিক দেবী তথা পিরানি। উক্ত জনগোষ্ঠীর মানুষেরা বাঘের আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে বনবিবির পূজা করে। বনবিবি, বনদেবী, বনদুর্গা, ব্যাঘ্রদেবী বা বণচণ্ডী নামেও পরিচিত। ভারত ও বাংলাদেশ উভয় দেশের সুন্দরবন অঞ্চলেই হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে বাঘের হাত থেকে রক্ষা পেতে বনবিবির পূজা করেন।

চাঁদপাঁই রেঞ্জের এই এরিয়াতে বাঘের আনাগোনা একটু বেশিই। কাঁদা মারিয়ে আমরা পথ চলছি এমন সময় জানা গেল বৈদ্যমারীর টহল ফাঁড়ির দক্ষিণে তাজা বাঘের পায়ের ছাপ দেখা গেছে। পথ ঘুরে সাঁকো পেরিয়ে বনের কোল ঘেষা পথ ধরে ছুটলাম আমরা। খাল পেরিয়ে খানিক গহীনে ঢুকতেই বাঘের পায়ের ছাপ।

অভিজ্ঞরা জানান, বাঘের পায়ের ছাপ কয়েক ঘণ্টা আগের। কারণ এখনো জোয়ার আসেনি। জোয়ার আসলে ছাপ মুছে যেত কিংবা একটা পলি অন্তত পড়তো ছাপের উপরে। তবে এই ছাপে কোনো পলি নেই। পায়ের ছাপ ধরে আরেকটু আগাতেই দেখি ছাপ চলে গেছে বনের আরো গহীনে। এই পথে প্রবেশ একদমই নিষেধ।

এবার ফিরতি পথ ধরলাম। লিটন ভাইয়ের সঙ্গে গল্প করতে করতে শুনছিলাম তার অভিজ্ঞতার কথা, নিজ চোখে বাঘ দেখা কিংবা বাঘে ধরা মানুষ এর বিভৎস লাশ উদ্ধারের কথা। বৈদ্যমারির এই স্থানের পূর্বে সেই শরনখোলা রেঞ্জ আর দক্ষিণে চাঁদপাই রেঞ্জ সুন্দরবনের। ঘুরে ফিরে সন্ধ্যা হতে চললো যখন তখন ফিরলাম আমরা কটেজে।

ফ্রেশ হয়েই দেখি সন্ধ্যার স্ন্যাকস হিসেবে হাজির গরম গরম পিঁয়াজু আর ধোঁয়া ওঠা গরম চা। সন্ধ্যার অসাধারণ নীলচে লাল আকাশের নিচে ঘেরের ধারে সিটিং এরিয়াতে বসে চা খেতে খেতে হারিয়ে যাবেন কল্পনার জগতে।

সন্ধ্যার পর আমরা আড্ডা-গল্প-গানে পার করলাম সময়। মাছ ধরার বৃথা চেষ্টাও করলাম। কেউ কেউ আবার রাতের আধারেই নৌকা নিয়ে নেমে পড়লেন ঘেরে। অসাধারণ এক রাত কাটালাম সবাই মিলে।

এদিকে শুরু হয়ে গেছে আমাদের বার-বি-কিউয়ের আয়োজন। চিকেনের সঙ্গে স্থানীয় কাঁকড়া, পরাটা আর কোল্ড ড্রিংক্স য়ে আয়োজন ছিল ডিনারে। ডিনার করে পুকুরের উপর বসে চললো আমাদের আড্ডা।

কখনো পুকুরের উপর কখনো হ্যামকে ঝুলে গান, কখনো বা কটেজের বারান্দায় বসে টিম ঘুরুঞ্চি আগের ট্রিপ গুলোর মজার মজার স্মৃতিচারণ ও দুষ্টুমি। আর তাই করতে করতে হয়ে এলো গভীর রাত।

এবার যে ঘুমাতে যাবার পালা। কারণ উঠতে হবে অনেক সকালে, বেড়িয়ে পড়তে হবে সুন্দরবন এর আরো গহীনে হারিয়ে যাবার জন্য। চলবে...

জেএমএস/এএসএম