পেট্রোলিয়াম রপ্তানিকারক দেশগুলোর সংগঠন ওপেককে কখনো কখনো আন্তর্জাতিক তেল বাজারের কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলা হয়। ওপেক ও তার মিত্রদের (একসঙ্গে বলা হয় ওপেক প্লাস) মিলিয়ে প্রায় ২৩টি দেশে বিশ্বের ৪০ শতাংশ জ্বালানি তেল উৎপাদন হয়। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণের জন্য প্রতি মাসেই বৈঠকে বসে ওপেক প্লাসের সদস্যরা। তাদের মূল লক্ষ্য, দাম চড়া ও স্থিতিশীল রাখা। কিন্তু সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো সুদের হার বাড়ানোর প্রেক্ষাপটে উৎপাদনে কী প্রভাব পড়বে তা নিয়ে জোট সদস্যদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দিয়েছে।
Advertisement
গত ৫ অক্টোবর অনুষ্ঠিত ওপেক প্লাসের বৈঠক সংক্ষিপ্ত হলেও তা থেকে বেরিয়ে আসা সিদ্ধান্তটি ছিল বিতর্কিত। করোনাভাইরাস মহামারি শুরুর পর থেকে এই প্রথমবার সশরীরে বৈঠকে বসেছিলেন সদস্য দেশগুলোর প্রতিনিধিরা। ভিয়েনায় অনুষ্ঠিত বৈঠক শেষে তারা নিশ্চিত করেছেন, দৈনিক ২০ লাখ ব্যারেল তেল উৎপাদন কমাবে ওপেক প্লাস, যা বিশ্বের মোট উৎপাদনের প্রায় দুই শতাংশের সমান। কয়েক মাস ধরে তেলবাজারে অস্থিরতা ও উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা হাতছাড়া হওয়ার পর নিজেদের বিশ্বাসযোগ্যতা পুনরুদ্ধার এবং তেলের দামে নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধার করতে বদ্ধপরিকর এই জোট।
তেলের চাহিদা কমে যাওয়ায় উদ্বেগ বেড়েছে রপ্তানিকারকদের। অপরিশোধিত তেলের আন্তর্জাতিক বেঞ্চমার্ক ব্রেন্টের দাম গত জুন মাসের ব্যারেলপ্রতি ১২৫ মার্কিন ডলার থেকে এখন মাত্র ৯৩ ডলারে নেমে এসেছে। পেট্রলের দাম বাড়ায় ব্যবহারও কমেছে। ইউরোপের গ্যাস সংকট, চীনের কোভিড নীতি ও সম্পত্তি সংকট এবং ক্রমবর্ধমান সুদের হার বিশ্বব্যাপী মন্দার আশঙ্কা তৈরি করেছে। তেলের দাম নির্ধারণে ব্যবহৃত মার্কিন ডলারের মূল্যবৃদ্ধি আমেরিকার বাইরে জ্বালানি কেনা আরও ব্যয়বহুল করে তুলেছে।
এমন পরিস্থিতিতে তেলের মূল্য নির্ধারণে প্রভাব বিস্তারের যে বিশাল সুযোগ পেয়েছে ওপেক প্লাস, তা কালেভদ্রেই দেখা যায়। এর বৃহত্তম সদস্যদের বাইরে কোনো দেশেরই দ্রুত উৎপাদন বাড়ানোর সক্ষমতা নেই এবং বিশ্বব্যাপী মজুতও কমে আসছে। বেশিরভাগ ধনী দেশগুলোর জোট ওইসিডি’তে অপরিশোধিত তেল উৎপাদন গত পাঁচ বছরের গড়ের তুলনায় কমে গেছে; চীন তার শোধনাগারগুলোর চাহিদা মেটাতে মজুত কমিয়ে দিচ্ছে। সমুদ্রে ভাসমান তেলের পরিমাণ হয়তো বাড়ছে, কিন্তু এর পেছনে কেবল ট্যাংকার সংকটেরই অবদান রয়েছে বলে মনে করেন ডাচ প্রতিষ্ঠান ভিটলের জিওভানি সেরিও।
Advertisement
ওপেক প্লানের বড় সমস্যা হলো, এর বিশ্বাসযোগ্যতা কমে গেছে। এমনকি, গত ৫ অক্টোবর উৎপাদন কমানোর যে ঘোষণা হয়েছে, সেটিও বাস্তবিক মনে হচ্ছে না। এর সদস্যরা উৎপাদনে বিনিয়োগ করতে ব্যর্থ হয়েছে, যার ফলে লক্ষ্য ও প্রকৃত উৎপাদনের মধ্যে ব্যবধান দেখা দিয়েছে। বাস্তবে এই কর্তনটি শুধু সেই সদস্যদের জন্য প্রযোজ্য হবে, যারা তাদের লক্ষ্য পূরণ করেছে বা এর কাছাকাছি রয়েছে। এমইউএফজি ব্যাংকের এহসান খোমানের ধারণা, সবশেষ ঘোষণার পরে প্রকৃতপক্ষে দৈনিক ১১ লাখ ব্যারেল তেল উৎপাদন কমতে পারে।
ওপেক প্লাসের এই কৌশল অবশ্য কাজ করছে, অন্তত আপাতত। গত ২৬ সেপ্টেম্বরের পর থেকে তেলের দাম ১১ শতাংশ বেড়েছে। রিস্টাড এনার্জির সাবেক বিশ্লেষক জর্জ লিওন মনে করেন, বছরের শেষ নাগাদ ব্রেন্টের দাম ব্যারেলপ্রতি ১০০ ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে। গত বৈঠকের পর সৌদি জ্বালানি মন্ত্রী বলেছেন, বাজার পরিবর্তন না হলে ২০২৩ সালের শেষ পর্যন্ত সরবরাহ নিয়ন্ত্রিত থাকবে।
তবে এই সিদ্ধান্তও ঝুঁকিমুক্ত নয়। চাহিদা কমে যাওয়ায় ২০২০ সালে উৎপাদন কমানোর ধাক্কা এখনো পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারেনি ওপেক প্লাস। এর মধ্যে আবারও উৎপাদন কমানোর সিদ্ধান্ত তেলের বাজারে এই জোটের অংশ আরও কমিয়ে দিতে পারে।
এছাড়া সিদ্ধান্তটি মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের জন্যেও অপমানজনক। আগামী মাসের কঠিন মধ্যবর্তী নির্বাচন সামনে রেখে সম্প্রতি সৌদি আরব সফরে গিয়েছিলেন তিনি। এসময় তেল সরবরাহ বাড়াতে সৌদি কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ জানান বাইডেন। তবে তাতে খুব একটা ফল হয়েছে বলে দেখা যাচ্ছে না।
Advertisement
ওপেক প্লাসকে ‘রাশিয়ার সঙ্গে জোটবদ্ধ’ বলে অভিযুক্ত করেছে যুক্তরাষ্ট্র। হোয়াইট হাউজ ঘোষণা দিয়েছে, আগামী মাসে নিজেদের কৌশলগত রিজার্ভ থেকে আরও এক কোটি ব্যারেল তেল বাজারে ছাড়বে তারা।
ওপেক প্লাস আবারও উৎপাদন বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিলে তেলের বাজারে এর অংশ হারানোর ক্ষতি হয়তো কিছুটা পুষিয়ে যাবে। কিন্তু চাহিদার ওপর এই সিদ্ধান্তের প্রভাব থাকবেই। উচ্চমূল্যের কারণে ভোক্তাদের ক্ষুধা আরও কমার আশঙ্কা রয়েছে, যা ওপেক প্লাসের অবস্থানের আরও ক্ষতি করতে পারে। একটি চাপে থাকা বাজারে উৎপাদন কমালে অস্থিরতা বাড়বে বৈ কমবে না। তাতে বাড়তি অনিশ্চয়তা বিনিয়োগকারী ও ঋণদাতাদের নিরুৎসাহিত করবে এবং তেলের বাজার তারল্য হারাবে।
সূত্র: দ্য ইকোনমিস্টকেএএ/