স্বাধীন বাংলাদেশ প্রাপ্তির পেছনে যাদের সক্রিয় অবদান আছে; তাদের অনেকের নাম বর্তমান প্রজন্মের কাছে অজানাই রয়ে গেছে। একইভাবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক অবস্থান দৃঢ় করতে যাদের পরিশ্রম আছে; তাদের অনেকের নাম আজ উচ্চারিত হয় না সগৌরবে। ঘাতকের বুলেটে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে শহীদ হলে তৎকালীন আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতা আত্মগোপনে চলে যান, অনেকে দল পাল্টে ক্ষমতার লোভে নিজেকে বিকিয়ে দেন। তবে এর মধ্যে ব্যতিক্রম ছিলেন যারা, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণ করে বিচারের দাবিতে সোচ্চার ছিলেন রাজপথে। তেমনই একজন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট সালাহ্উদ্দিন ইউসুফ।
Advertisement
পারিবারিক সম্পর্কে তিনি আমার নিকটতম আত্মীয়। সালাহ্উদ্দিন ইউসুফ আমার দাদি রিজিয়া বেগমের চাচা। আমার দাদা ডা. আব্দুস সাত্তার মোড়ল মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হওয়ায় সালাহ্উদ্দিন ইউসুফের রাজনৈতিক জীবন ও আদর্শ সম্পর্কে যথেষ্ট জানার সুযোগ হয়েছে। তিনি আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ছায়ায় থেকেছেন আজীবন।
বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠতম সহচর সালাহ্উদ্দিন ইউসুফ ১৯৩১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি খুলনা জেলার ফুলতলা উপজেলার বিল ডাকাতিয়া পাড়ের ধোপাখোলা নামক এক ছোট্ট গ্রামে সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা সাহামত উল্লাহ ও মা করিমুন্নেসার ১০ সন্তানের মধ্যে সালাহ্উদ্দিন ইউসুফ ছিলেন তৃতীয়। তার বাবাও আইন পেশায় যুক্ত ছিলেন। সালাহ্উদ্দিন ইউসুফ খুলনা ভিক্টোরিয়া ইনফ্যান্ট স্কুল থেকে ১৯৩৭ সালে শিক্ষাজীবন শুরু করেন। খুলনা জিলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক ও খুলনা ব্রজলাল কলেজ (বিএল কলেজ) থেকে আইএ পাস করেন। ১৯৫৩ সালে একই কলেজ থেকে বিএ এবং ১৯৬০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি পাস করেন। এরপর যোগ দেন আইন পেশায়।
১৯৪৯ সালে ছাত্রলীগের মাধ্যমে প্রত্যক্ষ রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হন সালাহ্উদ্দিন ইউসুফ। ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত তিনি ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। ১৯৪৮ সালের শুরুতে গড়ে ওঠা ভাষা আন্দোলনই সালাহ্উদ্দিন ইউসুফের রাজনৈতিক প্রেরণা। বাঙালি জাতীয়তাবাদ, বাঙালির স্বাধীনতাসহ অর্থনৈতিক মুক্তিই তার রাজনীতির আদর্শ ও লক্ষ্য ছিল। তিনি ৬ দফা আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণসহ তৎকালীন সব রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন। তিনি নয় নম্বর সেক্টরে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন।
Advertisement
দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে স্বৈরশাসকদের দমন-পীড়নের শিকার হয়ে অনেকবার কারাবরণ করেন। ১৯৪৮ সালে কারাবন্দি থাকাকালে তার সঙ্গী ছিলেন সাবেক এমএলএ মরহুম আব্দুল গফুর ও সাবেক স্পিকার মরহুম শেখ রাজ্জাক আলী। ১৯৫২ সালে কারাসঙ্গী ছিলেন আব্দুল গফুর, ফেরদৌস আহমেদ, আব্দুল হালিম প্রমুখ। এ ছাড়া ১৯৬৭, ১৯৬৯ ও ১৯৭৭ সালে কারাবন্দি থাকাকালে সঙ্গী ছিলেন আওয়ামী লীগের শীর্ষনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, মতিয়া চৌধুরী, আব্দুল মালেক উকিল, মতিয়ার রহমান, আবদুল মমিন তালুকদার, রফিকউদ্দিন ভূইয়া, মোজাফফর হোসেন পল্টু প্রমুখ। তিনি আওয়ামী লীগের স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে বহু গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৬৪-৬৬ সাল পর্যন্ত তিনি খুলনা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তিনি ১৯৬৭-৭১ সালে খুলনা নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও একই সময় নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। এরপর ১৯৭২-৭৫ সালে খুলনা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৭২-৭৮ সাল পর্যন্ত ছিলেন দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য। ১৯৭৮ সালে তিনি কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৮০ সাল থেকে তিনি দলের কেন্দ্রীয় কমিটির প্রেসিডিয়াম সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত আস্থাভাজন ছিলেন।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রণীত বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ ছয় দফা আন্দোলনের সময় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির পর আইয়ুব খান আহূত ১৯৬৯ সালে রাওয়ালপিন্ডির বৈঠকে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন সালাহ্উদ্দিন ইউসুফ। আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে নৌকা মার্কার প্রার্থী হিসেবে ১৯৭০ সালে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে ডুমুরিয়া-ফুলতলা, তালা ও কলারোয়া উপজেলা নিয়ে গঠিত আসনে এমএলএ নির্বাচিত হন। এরপর ১৯৭৩ সালে তালা-কলারোয়া আসনে এবং ১৯৭৯ সাল, ১৯৯১ সাল ও ১৯৯৬ সালে ডুমুরিয়া-ফুলতলা আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। সারাজীবন তিনি আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবেই নির্বাচিত হন। ১৯৭৯ সালে তিনি বিরোধী দলীয় হুইপের দায়িত্ব পালন করেন। সদ্য স্বাধীন দেশের প্রথম জাতীয় সংসদের সংসদীয় দলের উপনেতা হিসেবে জাপান ও হংকং ভ্রমণ করেন। ১৯৭৪ সালে একই বছর তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি দলের নেতা হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়ন, রোমানিয়া ও ব্রিটেন সফর করেন। ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদে তিনি অনুমিত হিসাব সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি এবং পরিকল্পনাবিষয়ক স্থায়ী কমিটির সদস্য ছিলেন। এ ছাড়া দায়িত্ব পালন করেছেন ১৯৭২-৭৫ সাল পর্যন্ত খুলনা জেলা ক্রীড়া সমিতির সভাপতি হিসেবে। ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
১৯৭৫ পরবর্তী রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যার বিচার চাওয়া এবং তার প্রতিবাদী ভূমিকার জন্য তাকে দীর্ঘদিন কারাবাস করতে হয়। জেল থেকে মুক্তি পেয়েই তিনি দলকে সুসংগঠিত করার জন্য জোহরা তাজউদ্দিনের সঙ্গে সারাদেশ ভ্রমণ করেন। একুশ বছরের জুলুম নির্যাতনের শেষে ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে খুলনা-৫ (ডুমুরিয়া-ফুলতলা) আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। সালাহ্উদ্দিন ইউসুফ নবগঠিত সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। ১৯৯৬ সালের ২৩ জুন শপথগ্রহণের পর ২৯ জুন তিনি মন্ত্রণালয়ের দপ্তরে যোগদান করেন। দায়িত্বে থাকাকালে তিনি অবহেলিত খুলনাসহ সমগ্র দক্ষিণ বাংলার বিভিন্ন সেক্টরের উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধে তার দক্ষতার পুরস্কার হিসেবে বাংলাদেশ সরকার সম্মানজনক ‘লেফটেন্যান্ট জেনারেল’ পদ বা উপাধি দেয় মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম এ সংগঠককে। ২০০০ সালের ৬ অক্টোবর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারের মন্ত্রী ছিলেন।
দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে আওয়ামী লীগকে সুসংগঠিত করা, দীর্ঘ ৯ মাস মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রাপ্তি ও পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগের দুঃসময়ে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট সালাহ্উদ্দিন ইউসুফের অবদান অবিস্মরণীয়। তিনি ব্যক্তিজীবনে ছিলেন স্বাধীনচেতা ও সংগঠনের জন্য নিবেদিতপ্রাণ। এই মহান ব্যক্তিত্বের স্মৃতি সংরক্ষণে সরকারের সংশ্লিষ্টদের সময়োপযোগী পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। ফুলতলা উপজেলায় সড়ক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভবনের নামকরণ তার নামে করা হয়েছে, তবে তা যথেষ্ট নয়। সুতরাং তার জন্মভূমি খুলনা জেলার ফুলতলা উপজেলার ধোপাখোলা নামক গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম এ সংগঠকের স্মৃতি সংরক্ষণে একটি জাদুঘর ও লাইব্রেরি নির্মাণ করার জোর দাবি রাখছি।
Advertisement
ফুলতলা উপজেলার পাশাপাশি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় বা খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের হলের নামকরণ তার নামে করা যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে ব্যক্তি অ্যাডভোকেট সালাহ্উদ্দিন ইউসুফের রাজনৈতিক আদর্শ ও দর্শন সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের জানার আগ্রহ থাকবে। ফলে তার রাজনৈতিক দর্শনের প্রতিফলন তরুণ প্রজন্মের মধ্যে প্রভাব ফেলবে বলে বিশ্বাস করি। উল্লেখিত পদক্ষেপ নিলে তার স্মৃতি সংরক্ষণের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধ ও আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ইতিহাস তুলে ধরতে তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। একই সঙ্গে বর্তমান প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানার পাশাপাশি এই মহান ব্যক্তির জীবনী জেনে অনুপ্রাণিত হবে।
সুতরাং মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম এ সংগঠকের স্মৃতিসমূহ সংরক্ষণে একটি জাদুঘর ও লাইব্রেরি নির্মাণ সময়ের দাবি। এর মাধ্যমে ইতিহাস সংরক্ষণ করা সম্ভব হলে তা দক্ষিণাঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। জাদুঘরে স্মৃতি সংরক্ষণের মাধ্যমে ইতিহাসে তিনি যেমন বেঁচে থাকবেন; তেমনই বেঁচে থাকবে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস। এর মাধ্যমে অনুপ্রাণিত হবে বর্তমান প্রজন্ম।
লেখক: সাবেক সহ-সম্পাদক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় সাংস্কৃতিক কেন্দ্র।
এসইউ/এএসএম