মো. মেহেদী হাসান ১৯৯৬ সালের ১ অক্টোবর বরিশাল সদরে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা মো. আলী আশরাফ আকন ব্যবসায়ী, মা মোরশেদা আশরাফ গৃহিণী। দুই ভাই-বোনের মধ্যে মেহেদী সবার ছোট। তিনি ২০১১ সালে বরিশাল জিলা স্কুল থেকে মাধ্যমিক ও ২০১৩ সালে সরকারি সৈয়দ হাতেম আলী কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। এরপর ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেন। বর্তমানে ৪২তম বিসিএসের (স্বাস্থ্য) মাধ্যমে বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মেডিকেল অফিসার হিসেবে কর্মরত।
Advertisement
সম্প্রতি তার বিসিএস জয়, ভবিষ্যৎ স্বপ্ন ও সফলতার গল্প শুনিয়েছেন জাগো নিউজকে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ফিচার লেখক সাজেদুর আবেদীন শান্ত—
জাগো নিউজ: আপনার শৈশবের গল্প শুনতে চাই—মেহেদী হাসান: শৈশবের পুরো সময়টা কেটেছে গ্রামে। গ্রামের বাচ্চারা যেভাবে বেড়ে ওঠে; আমিও তার ব্যতিক্রম ছিলাম না। তবে আমি শান্ত স্বভাবের ছিলাম। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত গ্রামেই পড়াশোনা করেছি। ছোটবেলায় হারিকেনের আলোয় পড়াশোনা করেছি। রুটিন ছিল সকালে উঠে পড়তে বসতে হবে, তারপর স্কুল, বিকেলে এসে আবার ঘুমাতে হবে। মাগরিবের আজান দিলেই পড়তে বসতে হবে। বিকেলে কতদিন যে ঘুম ফাঁকি দিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে বের হয়ে গেছি, তার হিসেব নেই। ছোটবেলার জীবনটা অনেক সুন্দর ছিল।
জাগো নিউজ: পড়াশোনায় কোনো প্রতিবন্ধকতা ছিল কি?মেহেদী হাসান: পড়াশোনায় স্ট্রাগল ছিল অনেক। ক্লাস সিক্সে বরিশাল জিলা স্কুলে ভর্তি হই। তখন থেকেই সিঙ্গেল লাইফ শুরু।জ্ঞান হওয়ার আগেই ফ্যামিলি থেকে দূরে থাকা খুব কষ্টের ছিল। শহরের টপ স্কুলে মানিয়ে নিতেও বেশ কষ্ট হয়েছে। আমি যখন ক্লাসে এসে ফার্স্ট বেঞ্চে বসতাম; তখন কেউ আমার ব্যাগটা পেছনের বেঞ্চে রেখে দিত কিংবা লুকিয়ে রাখতো। শার্টের পেছনে কলম দিয়ে দাগ দিত। বিভিন্নভাবে টিটকারি করত। গ্রামের একটা সাদাসিধে ছেলে কেন ফার্স্ট বেঞ্চে বসবে? তবে এক বছরের মাথায়ই যখন ক্লাসে ফার্স্ট হয়ে যাই; তখন চিত্র সম্পূর্ণ পাল্টে যায়। এরপরের স্কুল লাইফটা ছিল খুবই সুন্দর। আমি যত স্কুল বা কলেজে পড়েছি, সব জায়গায়ই শিক্ষকরা আমাকে খুব পছন্দ করতেন।
Advertisement
ইন্টারমিডিয়েট লাইফটাও ছিল ঘটনাবহুল। প্রথমে ঢাকার একটি কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম। পরে অবশ্য পারিবারিক কারণে বরিশালে চলে আসি। এরপর আসে মেডিকেলে ভর্তির সময়। খুব নিরিবিলি বা মনমতো পরিবেশ না পেলে আমি পড়াশোনা করতে পারি না। যেহেতু সময়টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, তাই নিরিবিলি পড়াশোনার জন্য কোচিংয়ের একটা মেসে উঠলাম। ফ্লোরিং করে এক রুমে দুজন থাকতাম। এক খালা এসে খাবার দিয়ে যেতেন। অনেক সময় খালার খাবার খেতে পারতাম না। রুটি-বিস্কুট খেয়ে থাকতাম। কিন্তু পড়াশোনা করেছিলাম নিজের সাধ্যমত। কারণ আমি যতটা না পরিশ্রম করেছি; তারচেয়ে বেশি পরিশ্রম ও কষ্ট করেছেন আমার মা-বাবা।
জাগো নিউজ: বিসিএসের স্বপ্ন দেখেছিলেন কবে থেকে?মেহেদী হাসান: বিসিএস নিয়ে আমার তেমন কোনো ভাবনা ছিল না প্রথমদিকে। যেহেতু মেডিকেলে পড়াশোনা করেছি। তাই আমার প্রথম টার্গেট ছিল পোস্ট গ্রাজুয়েশন এক্সাম দেওয়া। তারপর বিসিএস। কিন্তু যখন ইন্টার্নশিপ শেষ করি ২০২০ সালে; তখন থেকেই দেশে করোনার প্রকোপ শুরু হয়। লকডাউন শুরু হয়। সব পরীক্ষা স্থগিত হয়ে যায়। প্রথম ধাপে লকডাউন শেষে যখন পোস্ট গ্রাজুয়েশন এক্সামের জন্য পড়া শুরু করি; তখনই আমার বাবা হার্ট অ্যাটাক করেন। আমার মনে আছে, ওইদিন ছিল বাবা দিবস। সবাই যখন বাবাকে নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট দিচ্ছিল; আমি তখন বাবাকে নিয়ে ডায়াগনস্টিক সেন্টার আর ডাক্তারের কাছে দৌড়াচ্ছিলাম। আমার পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গেল। বাবা ধীরে ধীরে কিছুটা সুস্থ হলেন। এক মাস পর আবার ঢাকায় নিয়ে গেলাম। হৃৎপিণ্ডে ৫টি রিং পরানো হলো। এরমধ্যে পড়াশোনা করা হয়নি। কিছুদিন পরই ৪২তম বিসিএসের সার্কুলার দেওয়া হলো। যেহেতু পোস্ট গ্রাজুয়েশনের জন্য পড়তে পারিনি এবং ৪২তম বিসিএসের সুযোগটা সামনে এলো; তখন ঠিক করলাম বিসিএসটাই আগে দেব। মূলত তখন থেকেই বিসিএসের চিন্তা।
জাগো নিউজ: বিসিএসের প্রস্তুতি কীভাবে নিয়েছেন?মেহেদী হাসান: আগে থেকে বিসিএসের প্রিপারেশন বা টার্গেট ছিল না। এটাই ছিল আমার প্রথম বিসিএস। তাই প্রস্তুতি শুরুর সময় বেশ ঝামেলায় পড়তে হয়েছে। তখন সময়ও ছিল না বেশি। হাতে মাত্র দুই থেকে আড়াই মাস। এর মধ্যে সপ্তাহে ২ দিন আবার ডিউটি করতাম। সার্কুলার দেওয়ার পরে যখন বই-খাতা কিনে পড়া শুরু করলাম; তখন অথই সাগরে কূল-কিনারা পাচ্ছিলাম না। যেহেতু আমার কোনো ধারণাই নেই এ সম্পর্কে। তাই ধরেই নিয়েছিলাম, এ যাত্রায় বিসিএস হচ্ছে না। তবে কিছু মানুষের জন্য আমার জার্নিটা বা প্রস্তুতি নেওয়াটা অনেক সহজ হয়ে গিয়েছিল। তারা আগে থেকেই প্রস্তুতি নিয়েছিল। কয়েকজনের নাম বলতে চাই, আমার মেডিকেলের বড় ভাই ডা. সাবেতুল, বন্ধু ডা. স্বাগত, ডা. রাকিব, ডা. তোহিদ, ডা. মোজাম্মেল ও ডা.শাহেদ।
তারা না থাকলে আমার জন্য অল্প সময়ে প্রস্তুতি নেওয়াটা অনেক কঠিন হতো। তারা অনেক হেল্প করেছে। কিছু না বুঝলে তাদের থেকে বুঝে নিতাম আগে, তারপর পড়তাম। তাই কোনো কোচিংও করতে হয়নি। তারাই ভালোভাবে বলে দিতেন কীভাবে পড়ব, কতটুকু পড়ব। তারপরও এ অল্প সময়ে সিলেবাস কমপ্লিট করা অনেক টাফ ছিল। আপনারা জানেন যে, ৪২তম বিসিএস শুধু ডাক্তারদের জন্য ছিল। এ বিসিএসে প্রিলির সিলেবাস কিন্তু জেনারেল বিসিএসের থেকেও বেশি। কারণ এখানে জেনারেলের পাশাপাশি মেডিকেলের বিষয়ও ইনক্লুডেড ছিল। যা হোক, সবাই লাইব্রেরিতে পড়া শুরু করলাম। দৈনিক প্রায় ১৪-১৫ ঘণ্টা করে পড়েছি এ দুই মাস। অনেক পরিশ্রম করেছি। সারাদিন লাইব্রেরিতেই থাকতাম। শুধু ঘুমানোর সময় বাসায় যেতাম। এভাবে দুই থেকে আড়াই মাসের মধ্যে টানা পড়াশোনা করে মোটামুটিভাবে প্রিপারেশনটা গুছিয়ে নিয়েছিলাম।
Advertisement
জাগো নিউজ: আড়াল থেকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন কে?মেহেদী হাসান: আমার অনুপ্রেরণা ছিল আমার মা-বাবা। ছোটবেলা থেকেই দেখতাম, যখন কোনো ভালো রেজাল্ট করতাম কিংবা এক্সামে ফার্স্ট হতাম; তখন তারা খুব খুশি হতেন। তা ছাড়া আমার জন্য তাদের যে পরিশ্রম বা ত্যাগ দেখেছি; এগুলোই আমাকে সব কাজে অনুপ্রেরণা জোগায়।
জাগো নিউজ: নতুনরা বিসিএস প্রিলির প্রস্তুতি কীভাবে নেবেন?মেহেদী হাসান: বিসিএস বা অন্য যে কোনো পরীক্ষাই হোক, আগে ডিটারমাইন্ড থাকতে হবে, লক্ষ্য স্থির করতে হবে। বিসিএস একটা দীর্ঘ জার্নির প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা। তাই প্রথমেই ধৈর্যশীল হতে হবে। লেগে থাকার মানসিকতা থাকতে হবে। পরিশ্রম করলে সফল হবেনই। একবারে না হলে দ্বিতীয়বারে, দ্বিতীয়বারে না হলে তৃতীয়বারে, হাল ছেড়ে দেওয়া যাবে না। যারা নতুনভাবে বিসিএস প্রিলিমিনারির প্রস্তুতি নেবেন, তাদের প্রতি পরামর্শ হচ্ছে—সবার প্রথমে যাদের বিসিএস হয়ে গেছে; তাদের থেকে পরামর্শ নিয়ে এক সেট বই কিনে ফেলুন। বিসিএস সম্পর্কে ওভারঅল ধারণা নিয়ে নিন।
যখন পড়া শুরু করবেন, প্রথমেই প্রশ্নব্যাংক থেকে বিগত বছরের প্রশ্নগুলো দেখবেন। প্রয়োজনে এক সপ্তাহ শুধু প্রশ্ন নিয়েই ঘাটাঘাটি করুন। এটার সুফল যখন বিস্তারিত পড়তে যাবেন, তখন বুঝবেন। পড়াশোনা করতে হবে স্ট্র্যাটেজি অনুযায়ী। শুধু পড়ে গেলেই হবে না। অনেকে বেশি পড়াশোনা করেন ঠিকই কিন্তু আশানুরূপ ফল পান না। তাই যতটুকুই পড়েন না কেন, সেটা হতে হবে ইফেক্টফুল। কিছু টিপস অ্যান্ড ট্রিক্স অবশ্যই ফলো করতে হবে। হাতে কয় মাস আছে, সেটা হিসেব করে ছক তৈরি করে পড়া শুরু করুন। অনেক সময় আছে ভেবে হেলাফেলা করবেন না। আপনার থেকে একজন যদি এক ঘণ্টা বেশি পরিশ্রম করে এগিয়ে যান, তাহলেই পেছনে পড়ে যাবেন। তাই সাধ্যমতো চেষ্টা করে যেতে হবে, বাকিটা সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছা।
জাগো নিউজ: প্রিলি পাস করার পরে লিখিতর ব্যাপারে পরামর্শ কী?মেহেদী হাসান: লিখিত পরীক্ষার সিলেবাস বিশাল। তাই প্রিলি দিয়েই লিখিতর জন্য পড়াশোনা শুরু করে দেওয়া উচিত। প্রিলি পাস করব কি না, রেজাল্ট দিলে পড়া শুরু করব—এ ধারণা থেকে বের হয়ে এক্সাম শেষ হওয়ার সাথে সাথেই পড়াশোনা শুরু করা উচিত। অল্প অল্প করেই না হয় শুরু করুন। মনে রাখবেন, পড়াশোনা বা জ্ঞান কখনো বিফলে যায় না।
জাগো নিউজ: বিসিএস ভাইভার প্রস্তুতি কেমন হতে হয়?মেহেদী হাসান: ভাইভার প্রস্তুতির ক্ষেত্রে একটা কথা প্রথমেই বলতে চাই—বিসিএস ভাইভা শুধু মেধা যাচাইয়ের পরীক্ষা নয়। ভাইভায় মেধা যাচাইয়ের পাশাপাশি উপস্থিত বুদ্ধি, ইমার্জেন্সি হ্যান্ডেল করার সক্ষমতা, সাধারণ জ্ঞান, আচার-ব্যবহার, চাল-চলন সবকিছুই খেয়াল করা হয়। কয়টা প্রশ্নের জবাব সঠিক দিতে পারলেন, সেটা জরুরি নয়। যদি স্মার্টলি ভাইভা ফেস করতে পারেন, তাহলে সব প্রশ্ন না পারলেও হয়তো সিলেক্টেড হবেন। তাই ভাইভার জন্য বইপড়ার পাশাপাশি সাম্প্রতিক বিষয়াবলি সম্পর্কে ধারণা থাকতে হবে। দৈনিক খবরের কাগজ পড়ার অভ্যাস করতে হবে। দেশ ও আন্তর্জাতিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াবলি সম্পর্কে ধারণা থাকতে হবে। মার্জিত ও শোভনীয় পোশাক পরে ভাইভা দিতে যেতে হবে। এককথায় কনফিডেন্ট থাকতে হবে।
জাগো নিউজ: আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?মেহেদী হাসান: কেউ যখন এ প্রশ্ন করেন; তখন আমি উত্তর খুঁজে পাই না। প্রকৃতপক্ষে, আমি কখনোই সুদূরপ্রসারী কোনো চিন্তা বা পরিকল্পনা করে কিছু করিনি। যখন যে জিনিসটি সামনে এসেছে; সে কাজটাই ঠিকভাবে করার চেষ্টা করেছি। একজন ডাক্তার ও সরকারের কর্মচারী হিসেবে অর্পিত দায়িত্বটুকু ঠিকভাবে পালন করে যেতে চাই। তবে হ্যাঁ, আমারও কিছু ছোট ছোট ইচ্ছা আছে। যদি সময় ও সুযোগ আসে; সেগুলো বাস্তবায়ন করেই জানাবো সবাইকে।
এসইউ/এএসএম