ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) আবদুল কাদির। হারানো মোবাইল খুঁজে বের করা তার অন্যতম নেশা। গত আট বছরে ছিনতাই অথবা হারিয়ে যাওয়া প্রায় সাড়ে চার হাজারের বেশি মোবাইল খুঁজে দিয়েছেন তিনি। শুধু গুলশান থানায় সাধারণ ডায়েরির (জিডি) বিপরীতে উদ্ধার করেছেন ১ হাজার ২শ মোবাইল ফোন। মোবাইল ফোন হারানোর বিষয়ে জিডি হলেই ডাক পড়ে তার। এরপর তা উদ্ধারে মাঠে নেমে পড়েন তিনি। বর্তমানে তিনি কর্মরত বনানী থানায়।
Advertisement
প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পাঁচ শতাধিক অভিযোগ আসে কাদিরের কাছে। নিজের থানা তো বটেই, অন্য যে কোনো স্থানে মোবাইল হারালেও ভুক্তভোগীরা আসেন তার কাছে। এরই মধ্যে পুলিশ বিভাগ থেকে ২২ বার পুরস্কৃত হয়েছেন তিনি। ২০১৯ সালে পেয়েছেন বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘আইজিপি ব্যাচ’।
হারানো মোবাইল ফোন উদ্ধার, না হারানোর কৌশল, পুরোনো মোবাইল ফোন কেনাবেচা সংক্রান্ত তথ্য ও হারিয়ে গেলে করণীয়সহ একাধিক বিষয়ে কথা বলেছেন জাগো নিউজের সঙ্গে। এএসআই আবদুল কাদিরের সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন নিজস্ব প্রতিবেদক তৌহিদুজ্জামান তন্ময়।
জাগো নিউজ: মোবাইল ফোন উদ্ধারের পেছনের গল্প ও প্রথম উদ্ধারের অভিজ্ঞতা জানতে চাই।
Advertisement
এএসআই আবদুল কাদির: ঘটনাটি ২০১৫ সালের কোনো এক রাতের। তখন তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় দায়িত্বরত কর্মকর্তার সহকারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলাম। এমন সময় এক নারী কাঁদতে কাঁদতে থানায় প্রবেশ করেন। কর্তব্যরত পুলিশ কর্মকর্তাকে তিনি জানান, মহাখালী এলাকা থেকে ফেরার সময় সিএনজিচালিত অটোরিকশায় তার মোবাইল ফোনটি হারিয়েছে। যেভাবেই হোক তার মোবাইল ফোনটি যেন পুলিশ উদ্ধার করে দেয়।
আরও পড়ুন >> ১১ মাসে ২৩০টি হারানো মোবাইল উদ্ধার করেছেন এএসআই মাসুদ
শুধু একটি মোবাইল ফোনের জন্য ওই নারীর এমন কান্না দেখে মনে কৌতূহল জাগে। ওই নারীর কাছে জানতে চাই মোবাইলে কী এমন আছে, যার জন্য তিনি এত কান্না করছেন? জবাবে ওই নারী জানান, হারিয়ে যাওয়া মোবাইল ফোনটি তার বাবার শেষ স্মৃতি। তার বাবা ওই ফোনটি কিনে দিয়েছিলেন। বাবার সঙ্গে অনেক ছবিও রয়েছে তার। কিন্তু কিছুদিন আগে তার বাবা মারা গেছেন। তাই বাবার শেষ স্মৃতিগুলো মোবাইলে বারবার দেখতেন ওই নারী। চরম মমতায় আগলিয়ে রাখতেন মোবাইল ফোনটিও। বলেই আবারও হু হু করে কান্না করতে থাকেন।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) আবদুল কাদির/জাগো নিউজ
Advertisement
ওই নারীর কান্না দেখে মনে দাগ কাটে। মনে মনে ঠিক করি, যেভাবেই হোক তার মোবাইল ফোনটি উদ্ধার করবোই। নিজ উদ্যোগেই যোগাযোগ করি ডিবি পুলিশের সঙ্গে। জিডির কপিসহ অন্যান্য ডকুমেন্ট পাঠিয়ে দেই ডিবি কার্যালয়ে। তথ্য-প্রযুক্তির সহায়তায় প্রায় তিন মাস পরে ওই নারীর মোবাইল ফোনটি উদ্ধার হয় বরিশাল থেকে। হারিয়ে যাওয়া মোবাইল ফোনটি হাতে পেয়ে সেদিনও খুশিতে কেঁদেছিলেন তিনি।
আরও পড়ুন >> অবৈধ মোবাইল শনাক্ত শুরু, নিষ্ক্রিয় করা যাবে হারানো ফোন
জাগো নিউজ: হারানোর পর ভুক্তভোগীর করণীয় কী?
এএসআই কাদির: মোবাইল ফোন হারিয়ে গেলে প্রথমে নিকটস্থ থানায় গিয়ে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করতে হবে। হারানো মোবাইলটি ফিরে পেতেই শুধু জিডি করবেন তেমনটি নয়, নিজের নিরাপত্তার জন্যও জিডি জরুরি। মোবাইল ফোন কেনার পর বক্স ও ক্যাশমেমো যত্ন সহকারে রাখতে হবে। কারণ মোবাইল হারানো, ছিনতাই অথবা চুরি হয়ে যেতে পারে কিন্তু আইএমইআই নম্বর থাকলে সেই মোবাইল খুঁজে পেতে সহজ হয়।
খোয়ানো মোবাইল ফোন ভুক্তভোগীর হাতে তুলে দিচ্ছেন কাদির
আরও পড়ুন >> চুরি হওয়া মোবাইল যার কাছে পাওয়া যাবে তারও হতে পারে সাজা
জাগো নিউজ: মোবাইল ফোন হারানোর পরে জিডি করেও সব উদ্ধার হয় না কেন?
এএসআই কাদির: হারানোর পরে প্রতিটি মোবাইল ফোন আমরা সমানভাবে দেখি। আইফোন ও ওয়ানপ্লাস মোবাইলগুলো উদ্ধারে কিছুটা বেগ পেতে হয়। অন্যান্য মোবাইল উদ্ধার দ্রুতই সম্ভব। প্রযুক্তির সহায়তায় ৬০-৭০ শতাংশ হারানো মোবাইল উদ্ধার করা যায়।
জাগো নিউজ: মোবাইল ফোন উদ্ধার পেশার পাশাপাশি নেশা হিসেবে নিয়েছেন কেন?
এএসআই কাদির: কারও মোবাইল ফোন যদি হারিয়ে যায় সেটি তার আবেগ এবং স্মৃতি। যখন কোনো মানুষের স্মৃতি হারিয়ে যায় তখন সেই মানুষটির কষ্টের শেষ থাকে না। মোবাইল ফোন হারিয়ে যখন মানুষটি থানায় আসেন তখন চেহারা দেখেই বোঝা যায় তার গুরুত্বপূর্ণ কিছু হারিয়ে গেছে। এই জায়গা থেকে আমি চিন্তা করি, মানুষের হারানো শখের মোবাইলটি যদি আমি ফিরিয়ে দিতে পারি তাহলে ভুক্তভোগীও উপকৃত হবে, আমারও ভালো লাগবে।
জাগো নিউজ: মোবাইল হারানোর পর ভুক্তভোগীরা মোবাইলে থাকা ছবি-ভিডিওর জন্য বেশি চিন্তা করেন কেন?
আরও পড়ুন >> ল্যাপটপ-মোবাইল হারিয়ে বিপাকে ভুক্তভোগীরা, উদ্ধারে ধীরগতি
এএসআই কাদির: শখের বশে অনেক সময় পারসোনাল কিংবা অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি/ভিডিও সংরক্ষণ করেন অনেকে। কিন্তু মোবাইল ফোন যখন হারিয়ে যায় তখন ওই ভুক্তভোগী মোবাইলের চেয়ে বেশি চিন্তা করেন অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি/ভিডিও নিয়ে। এক্ষেত্রে পরামর্শ হলো, কখনো পারসোনাল কিংবা অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি/ভিডিও মোবাইলে সংরক্ষণ করা উচিত নয়।
‘আইজিপি ব্যাচ’ নেওয়ার মুহূর্তে
জাগো নিউজ: বিদেশি দূতাবাসের কর্মকর্তাদের মোবাইল উদ্ধারের গল্প শুনতে চাই…
এএসআই কাদির: এখন পর্যন্ত প্রায় সাড়ে চার হাজার মোবাইল ফোন উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছি। বিশেষ করে গুলশান অভিজাত এলাকা হওয়ায় অনেক বিদেশি ও বিদেশি দূতাবাসের কর্মকর্তাদের মোবাইল ফোন উদ্ধার করেছি। শ্রীলঙ্কান একজন নাগরিকের একটি দামি মোবাইল ফোন উদ্ধার করে দেওয়ার পরে তিনি বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ পুলিশ এমন গুড সার্ভিস দেয়, এটি অবিস্মরণীয়।’ বিদেশিদের হারানো মোবাইল উদ্ধারের পর তারা অনেকেই তাদের নিজস্ব ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন। বাংলাদেশ পুলিশের একজন সদস্য হিসেবে নিজে গর্ববোধ করি।
জাগো নিউজ: মোবাইল ফোন উদ্ধারের জন্য প্রতিদিন কত সংখ্যক ভুক্তভোগী যোগাযোগ করেন?
এএসআই কাদির: ভোরে যখন ঘুম থেকে উঠি এরপর রাত ১০টা পর্যন্ত প্রায় পাঁচ থেকে ছয়শ ফোনকল অনবরত আসতেই থাকে। মানুষের বিশ্বাস, আমার কাছে ফোন দিলেই তার হারানো মোবাইলটি ফিরে পাবে। এছাড়া হারানোর পর অনেকেই পরামর্শের জন্য ফোন করেন। তবে এত ফোনকলেও আমি বিন্দুমাত্র বিরক্ত হই না। যদি সুস্থ থাকি শতভাগ ফোন রিসিভ করে পরামর্শ দেওয়ার চেষ্টা করি।
জাগো নিউজ: পুরস্কারের আশায় মোবাইল উদ্ধারের কথা বলে কেউ কেউ...
এএসআই কাদির: এ পর্যন্ত ২২ বার ডিএমপি কমিশনার মহোদয় আমাকে পুরস্কৃত করেছেন। কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১৯ সালে ‘আইজিপি ব্যাচ’ পদক অর্জন করেছি। পুরস্কারের আশায় নয়, মানুষের উপকারের জন্য হারানো মোবাইল উদ্ধারে কাজ করি।
টিটি/এএসএ/জেআইএম