ভ্রমণ

কুয়াকাটার বিখ্যাত লাল কাঁকড়ার চরে গিয়ে যা দেখবেন

টানা মাইলকে মাইল সমুদ্র সৈকতের কখনো পাড়, কখনো প্রায় ঢেউ ছুঁয়ে বাইকে ছুটছি পূর্বদিকে। সৈকতের জিরো পয়েন্ট থেকে পূর্বপ্রান্তের প্রায় শেষাংশের মাইলখানেক আগে গিয়ে কিছুটা হকচকিত হলাম। সমুদ্রের বালুকাবেলার বেশ বিস্তীর্ণ চরজুড়ে জায়গাটা ছিদ্রময় ও লালচে ধরনের।

Advertisement

তখন ভোরের আলো ফুটলেও সূর্যোদয়ের কিছুটা সময় বাকি। কিনারাহীন সমুদ্রের অথৈ জলরাশি থেকে সূর্যের উদয় দেখব বলেই আধো আঁধার আধো আলোময় ভোরে কুয়াকাটা সৈকতের ঢেঊভেজানো বালুকাবেলা ধরে তুমুল বেগে ছুটছিলো আমাদের বাইক।

এই ভোরের আঁধারিতে সৈকতের ঢেউ ছুঁয়ে বাইক রাইড, সমুদ্রতট ছুঁয়ে থাকা প্রতিটি জায়গা ঘিরেই এক মায়াবী অপার্থিক সৌন্দর্যের ক্যানভাস নিয়ে বড়সড় মুগ্ধতার গল্প লেখা সম্ভব। কিন্তু সেসবে আমাদের অতো আগ্রহ নেই বুঝেই বাইক চালকও সোজা ছুটছিলেন গঙ্গামতি চর বা গজমতি খালের পাড়ে।

পথে ডিঙি নৌকায় মোটরসাইকেল সমেত পাড় হলাম ছোট্ট নদীর এক মোহনা। মোহনা লাগোয়া নিবিড় বন। সেখানে মিনিটকয়েক দাঁড়িয়ে প্রকৃতি উপভোগ শেষে ফের ছুট গঙ্গামতি চরের উদ্দেশ্যে।

Advertisement

গঙ্গামতি চরের কিলোমিটার খানেক আগের এই লাঙলচষা মতো লালচে সৈকতে চকিতে তাকিয়ে এতো আগ্রহ দেখে চালক নিজ থেকে জানালেন এটাই কুয়াকাটার সাগরকন্যার বালুকাবেলার বিখ্যাত লাল কাকড়ার চর। কথাটা শোনামাত্রই শিহরিত হয়ে উঠলাম। কুয়াকাটার পরিষ্কার সৈকত নয়, এর বিস্তীর্ণ বালুকাবেলায় হাঁটা নয় কিংবা ফুলে-ফেঁপে ওঠা জলে উম্মাতাল লম্ফ-ঝম্পও নয়। কুয়াকাটায় আসার যে উদগ্রীব বাসনা তার প্রধান দুই কারণ কুয়াকাটার কুয়া আর লাল কাঁকড়ার চর স্বচক্ষে দর্শন।

বাইক চালকের কথায় চমক ভাঙতে না ভাঙতেই বাইক গিয়ে পৌঁছালো সৈকতের প্রায় শেষ অংশে, গঙ্গামতি খালের মূল পয়েন্টে। বাইক চালককে জানিয়ে রাখলাম ফেরার পথে থামতে হবে লাল কাঁকড়ার চরে।

দলবেঁধে ৫০ জনের মতো সহকর্মীরা দুইদিনের সফরে (২৬-২৭ আগস্ট, ২০২২) এসেছি কুয়াকাটা। প্রথমদিনের ঘোরাঘুরি শেষে রাতে হোটেলে ফিরে সবাইকে বলা ছিলো ভোরে সদলে বের হতে হবে গঙ্গামতি চরের সৈকতে দাঁড়িয়ে সূর্যোদয়, লাল কাঁকড়ার চরসহ অন্যান্য স্পট দেখতে।

কুয়াকাটা সৈকতের সবচেয়ে পূর্ব অংশ এই গঙ্গামতি খাল। সূর্যোদয় দেখার জন্য দেশের সবচেয়ে বিখ্যাত জায়গা এটা। ভোর ৫.৪০ মিনিটে সূর্য ওঠার কথা। লাল কাঁকড়ার চর পেরিয়ে বাইকযোগে কয়েকমিনিট আগেই পৌঁছে গেছি গঙ্গামতি।

Advertisement

দীর্ঘ ১৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের সৈকতের সর্বপূর্বে গঙ্গামতি খাল, কুয়াকাটা জিরো পয়েন্ট থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে। এরপর থেকে মূলত সৈকত শেষে গঙ্গামতি বা গজমতির সংরক্ষিত বনাঞ্চল শুরু।

ভেবেছিলাম এতে ভোরে হয়তো আমরা ভিন্ন আর কোনো দলকে পাব না এখানে। কিন্তু আমাদের আগেও কয়েকজনকে এসে অপেক্ষা করতে দেখলাম। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে গঙ্গামতির খালে প্রায় শতাধিক পর্যটকের সমাগম হলো। কিন্তু বিধি বাম।

আকাশ মেঘলা থাকায় সূর্যোদয়ের বেশ সময় পেরিয়ে গেলেও আর সূর্য দেখা হলো না আমাদের। অনেক কল্পনা ও ছবি তোলার প্ল্যান বলতে গেলে মাঠে মারা গেলো। তবে গঙ্গামতি খাল নামে পরিচিত সৈকতের এই শেষাংশের বালুচরের সৌন্দর্যও অতুলীয়, মোহিত করার মতো।

এই শুভ্র সকালে গঙ্গামতি বালুকাবেলায় পায়ের ওপর যখন আছড়ে পড়ছে সাগরের ঢেউ তখন গুনগুনিয়ে গাইতে মন চাইছিলো রবীন্দ্রনাথের ‘শরৎ তোমার’ কবিতার এই চরণগুলো-

‘শরৎ তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলিছাড়িয়ে গেল ছাপিয়ে মোহন অঙ্গুলিশরৎ তোমার শিশির ধোওয়া কুন্তলেবনের পথে লুটিয়ে পড়া অঞ্চলেআজ প্রভাতের হৃদয় ওঠে চঞ্চলি।’

মেঘলা আকাশের কারণে দেশের সবচেয়ে বিখ্যাত সূর্যোদয় স্পটে এসে সূর্যোদয় না দেখতে পারা বেশ আপেক্ষের কারণ অবশ্যই। সফরসাথীদের বেশিরভাগেরই মুখে তার প্রকাশ দেখা গেলো। তবে সত্যিকার অর্থে এ নিয়ে আমার তেমন দুঃখবোধ ছিলো না।

সমুদ্রের লোনা জলে পা ভিজিয়ে, উত্তাল ঢেউ ছুয়ে হেঁটে, বালিয়ারিতে নাম লিখে, পেছনের ক্যানভাসে গঙ্গামতির জঙ্গল রেখে ছবির পর ছবি তোলা, ভিডিও ধারণ চলছিলো। তখনো আমার মন পড়ে ছিলে এখান থেকে অদূরে সাগরকন্যার বিখ্যাত লাল কাঁকচার চরে। কারণ জনশ্রুতি আছে বেশিরভাগ সময়ই কাঁকড়ার দেখা পাওয়া ভার।

ফিরতি পথ ধরলাম। বাইকারের সাথে চুক্তি অনুযায়ী তখনো আরো কয়েকটা স্পট দেখার বাকি। ফেরার পথে আবার থামলাম লাল কাঁকড়ার চড়ে। পুরো চরজুড়ে হাজারো ছিদ্র, কিছুটা খড়কুটোর মতো আবর্জনা ছড়ানো। তার মধ্যেই বিশাল বালুকাবেলাজুড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে শত শত লাল কাঁকড়া।

নেমে পা টিপে টিপে কাছে যেতেই নিমিষে ভোজবাতির মতো গর্তে লুকাচ্ছে, আবার কিছু পরেই গর্ত থেকে বের হয়ে পড়ছে। এ যেন এক দারুণ লুকোচুরি খেলা। অপেক্ষা করেও তাই স্থির কাঁকড়ার ছবি তোলা বা ধরা বেশ কষ্টসাধ্য। মাথার উপরে শুভ্রনীল আকাশে তখনো শরতের পেজোতুলোর মেঘের ওড়াওড়ি, কিছুটা দূরেই এসে আছড়ে পড়ছে উত্তাল ঊর্মিমালা।

কানে বাজছে তার শোঁ শোঁ তীব্র সুর। আর চরজুড়ে লাল কাঁকড়ার গর্ত হতে উঁকি ও ছুটোছুটি; এ যেন তুলির আঁচড়ে তৈরি এক নৈসর্গিক সৌন্দর্য। দীর্ঘ কল্পনার, প্রতীক্ষার লাল কাঁকড়ার চরে কয়েক মিনিটের অবস্থানই যেন কুয়াকাটা সফরের প্রাপ্তিকে পূর্ণতা দিলো।

ততক্ষণে সৈকতের বেশিরভাগ অংশে জোয়ারের পানি আসতে শুরু করেছে। কিছুটা তাড়াও ছিলো। ফলে লাল কাঁকড়ার চর দর্শন শেষে ফিরতি পথ ধরলাম সৈকত লাগোয়া বসতির দুর্গম কাঁচাপাকা পথ পাড়িয়ে। ভোরে যে সৈকত ধরে এসেছি তার প্রায় সবটাই ধীরে নিমজ্জিত হচ্ছে জোয়ারের ঢেউয়ে।

প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে এবার গন্তব্য কুয়াকাটার বর্তমান রাখাইন পল্লী ও মিশ্রিপাড়া। এখানেই নির্মিত দেশের সবচেয়ে বড় বুদ্ধমূর্তি। ১০ টাকা জনপ্রতি টিকেট কেটে বৌদ্ধ মূর্তি দর্শন হলো। পাশেই মিষ্টি পানির এক কুয়া (এটি কুয়াকাটার আদি কুয়া নয়)।

কুয়া দেখা শেষ না হতেই সহকর্মীদের বেশিরভাগই রাখাইন পল্লীর দোকানগুলোতে ধুম কেনাকাটা শুরু করে দিয়েছেন। এখানকার প্রায় শতাধিক দোকানের বেশিরভাগেই রাখাইনদের তৈরি পোশাক, স্থানীয় জেলেদের তৈরি শুটকি, মিয়ানমারের প্রসাধনী ও চকোলেটসহ হরেক পণ্যের সম্ভার। এখানকার পণ্যের মান মোটামুটি সন্তোষজনক ও দাম পর্যটকের সাধ্যের মধ্যেই মনে হলো।

খুব ভোরে বের হওয়ায় ততক্ষণে পেটে ছুঁচোর কেত্তন শুরু হয়েছে। তাছাড়া হোটেলেও খাবারের সময় নির্ধারণ করা। বাধ্য হয়েই বাকিদের তাগাদা দিতে হলো। তাছাড়া ঢাকায়ও ফিরতে হবে দুপুরেই। দফায় দফায় তাগাদা শেষে একে একে বাইকে ফিরে যখন হোটেলে ফিরে এলাম ততক্ষণে সূর্য যেন আগুন ঢালতে শুরু করেছে।

লেখক: কবি ও ব্যাংকার

জেএমএস/জিকেএস