গ্রিক উপকথায় মশার উল্লেখ আছে অন্তত দুটি লেখায়: ‘হাতি ও মশা’ এবং ‘ষাঁড় ও মশা’। এ দুটি উপকথার নীতিবাক্য হচ্ছে: বড় প্রাণী সাধারণত ক্ষুদ্র প্রাণীকে খেয়ালই করে না; অথচ ক্ষুদ্র প্রাণী কখনও কখনও বিপজ্জনক হতে পারে।
Advertisement
সাইবেরিয়ার উপকথায় আছে মশার জন্মরহস্য। উপকথায় একজন মানুষখেকো দৈত্যের উল্লেখ আছে। এই দৈত্যের নাম ‘পুনেগুচ্ছা’। এক সাইবেরিয়ান বীর একসময় এই দৈত্যকে হত্যা করে পুড়িয়ে ফেলে। আর পুড়ে যাওয়া দৈত্যের ছাই থেকে সৃষ্টি হয় মশার। সেই থেকে মশা পৃথিবীতে একের পর এক মহামারি ছড়িয়ে যাচ্ছে।
দৈত্যের ছাই থেকে মশার উৎপত্তির উপকথা উত্তর আমেরিকার আদিবাসীদের মধ্যেও প্রচলিত আছে। তাতার (Tatars) ও আলতাই (Altai) উপকথায় ‘আনদালমা-মুস’ (Andalma-Muus) নামক এক দৈত্যের উল্লেখ আছে, যার মরদেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ থেকে মশাসহ বিভিন্ন পতঙ্গ সৃষ্টি হয়েছে।
ইংরেজি ভাষায় মশা হচ্ছে মসকিটো (mosquito)। স্প্যানিস ও পর্তুগিজ ভাষায় মসকিটো মানে ‘ছোট মাছি’। আসলেই মশা এক ধরনের মাছি। ৯ কোটি ৯০ লাখ বছর আগেও পৃথিবীতে মশার অস্তিত্ব ছিল বলে বিজ্ঞানীরা বলছেন। তখন অন্তত তিন প্রজাতির মশা ছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। এখন আছে সাড়ে তিন হাজারের বেশি প্রজাতি।
Advertisement
সাধারণভাবে পুরুষ মশা ৬ থেকে ৭ দিন বেঁচে থাকে। আর স্ত্রী মশা বেঁচে থাকে গড়ে ছয় সপ্তাহ। সব প্রজাতির মশা রক্তচোষা নয়। তবে যেসব প্রজাতি রক্তচোষা, সেসব প্রজাতির শুধু স্ত্রী মশা-ই রক্ত চোষে। এই স্ত্রী মশা-ই ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, ফাইলেরিয়া, পীতজ্বর, জিকা ইত্যাদির রোগজীবাণু ছড়ায়।
বিশ্বে আজ পর্যন্ত যত মানুষের জন্ম হয়েছে, তাদের প্রায় অর্ধেকের মৃত্যুর জন্য দায়ী মশাবাহিত রোগ। এটা আনুমানিক হিসাব। কেউ কেউ মনে করেন, অর্ধেক তথা ৫০ শতাংশ নয় বরং ৫ শতাংশ মানুষের মৃত্যুর জন্য এক অর্থে মশা দায়ী। এই আনুমানিক হিসাবের কোনটা ঠিক, বলা মুশকিল। তবে এখনও যে বছরে মশাবাহিত রোগে বিশ্বে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৭ লাখ লোকের মৃত্যু ঘটে, তা মোটামুটি সঠিক।
আর এই ৭ লাখের মধ্যে অধিকাংশের মৃত্যু ঘটে ম্যালেরিয়ায়। ‘ম্যালেরিয়া’ শব্দটি এসেছে মধ্যযুগীয় ইতালীয় শব্দ mala aria (দূষিত বায়ু) থেকে। কারণ, একসময় বিশ্বাস করা হতো যে, ম্যালেরিয়া হয় দূষিত বায়ুর কারণে। কিন্তু বাস্তবে ম্যালেরিয়া হয় প্লাজমোডিয়াম গোত্রের প্রোটিস্ট নামক একধরনের পরজীবীর কারণে। স্ত্রী অ্যানোফিলিস মশা এই রোগ ছড়ায়।
মশা যে ম্যালেরিয়া ছড়ায়, এটা প্রথম আবিষ্কার করেছিলেন ব্রিটিশ বিজ্ঞানী রোনাল্ড রস। সে কারণে তিনি ১৯০২ সালে নোবেল পান। আরও পরে ম্যালেরিয়ার মতো সংক্রামক রোগের জন্য দায়ী পরজীবী আবিষ্কার করে ১৯০৭ সালে নোবেল পান ফরাসি বিজ্ঞানী শাখলে লু আলফুন্স লেভখ। ১৯৭২ সালে চীনা বিজ্ঞানী থু ইয়োইয়ো আবিষ্কার করেন ম্যালেরিয়ার কার্যকর ওষুধ আরটেমেসিনিন এবং এজন্য ২০১৫ সালের ৫ অক্টোবর চিকিৎসা বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পান। তিনি চীনের প্রথম নারী যিনি এই পুরস্কার পেয়েছেন। চিকিৎসা বিজ্ঞানে নোবেল বিজয়ী প্রথম চীনাও তিনি।
Advertisement
তেতো স্বাদের ‘কুইনাইন’ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (হু) অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত। তবে ২০০৬ সাল থেকে হু আর কুইনাইনকে ম্যালেরিয়ার চিকিৎসায় প্রথম ওষুধ হিসেবে সুপারিশ করছে না। হু এখন ম্যালেরিয়ার চিকিৎসায় শুরুতে আরটেমেসিনিন ব্যবহার করতে বলে। তবে আরটেমেসিনিন পাওয়া না গেলে কুইনাইন ব্যবহার করা যেতে পারে। আরটেমেসিনিনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কুইনাইনের তুলনায় অনেক কম। এতে কুইনাইনের সেই কুখ্যাত তেতো স্বাদ তো নেই-ই!
ম্যালেরিয়ার বিরুদ্ধে কার্যকর ওষুধ আবিষ্কৃত হয়েছে, কিন্তু একটি কার্যকর ভ্যাকসিন এখনও আমরা হাতে পাইনি। অনেক প্রতিষ্ঠানই ম্যালেরিয়ার ভ্যাকসিন আবিষ্কারের চেষ্টা করে যাচ্ছে। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির একটি টিম তেমনি একটি ভ্যাকসিন নিয়ে কাজ করছে। বিবিসি’র খবর অনুসারে, এই ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা ৭৭ শতাংশ। এর মানে এই প্রথম ম্যালেরিয়ার একটি ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা স্বীকৃত মানে পৌঁছালো।
তবে এই ভ্যাকসিনের পরীক্ষা চালানো হয়েছে বুর্কিনা ফাসোর মাত্র ৪৫০টি শিশুর ওপর। অদূর ভবিষ্যতে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের প্রায় ৫ হাজার শিশুর ওপর এ ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা পরীক্ষা করা হবে। মোদ্দাকথা, এই আশা জাগানিয়া ভ্যাকসিনটিও পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর্যায়েই রয়েছে।
একটি কার্যকর ভ্যাকসিনের অভাবে ম্যালেরিয়া এখনও বিশ্বের বহু দেশের মানুষকে ভোগাচ্ছে, তাদের জীবন কেড়ে নিচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুসারে, ২০১৯ সালে বিশ্বব্যাপী ২২ কোটি ৯০ লাখ লোক ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয় এবং তাদের মধ্যে ৪ লাখ ৯ হাজার মৃত্যুবরণ করে। মৃতদের মধ্যে ৬৭ শতাংশই হচ্ছে ৫ বছরের কম বয়সী শিশু।
২০১৯ সালে বিশ্বে যত মানুষ ম্যালেরিয়ায় মারা গেছে, তাদের ৯৫ শতাংশই ৩১টি দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশের মানুষ। এই ৩১টি দেশের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় ছিল যথাক্রমে নাইজেরিয়া, গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র কঙ্গো, তাঞ্জানিয়া, মোজাম্বিক ও বুর্কিনা ফাসো। ২০১৯ সালে ম্যালেরিয়ায় বিশ্বের মোট মৃত্যুর ৫১ শতাংশই ঘটেছে এ কয়েকটি দেশে।
ম্যালেরিয়ার বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী লড়াইয়ের ফলাফল মিশ্র। এ কথা সত্য যে, ম্যালেরিয়ায় এখনও বহু মানুষ মারা যাচ্ছে এবং এই ব্যাধির নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বিশ্বের অর্থনীতির ওপরও। কিন্তু পাশাপাশি এ কথাও অস্বীকার করা যাবে না যে, থু ইয়োইয়োর মতো বিজ্ঞানীদের আপ্রাণ চেষ্টায়, বিশ্বব্যাপী ম্যালেরিয়ার প্রকোপ বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছে, বহু মানুষের জীবন বেঁচে যাচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক হিসাব অনুসারে, বিগত দুই দশকে ম্যালেরিয়ার চিকিৎসা ও প্রতিরোধমূলক কার্যক্রমের কারণে প্রায় ১৫০ কোটি মানুষ ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হওয়া থেকে বেঁচে গেছেন এবং আক্রান্তদের মধ্যে ৭৬ লাখ মানুষের জীবন রক্ষা পেয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) থু ইয়োইয়োর দেশ চীনকে ২০২১ সালের ৩০ জুন ম্যালেরিয়ামুক্ত ঘোষণা করে। প্রায় তিন দশক পর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের একটি দেশ হিসেবে চীন পায় হু’র ‘ম্যালেরিয়ামুক্ত সনদ’। এর আগে এতদঞ্চলের অস্ট্রেলিয়া (১৯৮১), সিঙ্গাপুর (১৯৮২) ও ব্রুনেই (১৯৮৭) এই সনদ পায়। অতি সাম্প্রতিক কালে হু’র ম্যালেরিয়ামুক্ত সনদ পেয়েছে এল সালভেদর (২০২১), আলজেরিয়া (২০১৯), আর্জেন্টিনা (২০১৯), প্যারাগুয়ে (২০১৮) ও উজবেকিস্তান (২০১৮)।
একসময় চীনে, বিশেষ করে দক্ষিণ চীনে ম্যালেরিয়ার ছিল ভয়ঙ্কর দাপট। তখন ফি বছর লাখ লাখ লোক ম্যালেরিয়ায় মারা যেতো; আক্রান্ত হতো প্রতি বছর গড়ে ৩ কোটি মানুষ। কিন্তু ৭০ বছরের সাধনা, পরিশ্রম ও প্রচেষ্টার ফলে আজ চীন ম্যালেরিয়ামুক্ত। কিন্তু বিপদ পুরোপুরি কাটেনি। ম্যালেরিয়ামুক্ত চীনে এখনও ম্যালেরিয়ার আনাগোনা আছে; বিদেশ থেকে ম্যালেরিয়ার জীবাণু শরীরে বহন করে নিয়ে আসছেন অনেক পর্যটক ও প্রবাসী চীনা। চীনকে এখন সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে।
সম্প্রতি চীনের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্রের পরজীবী রোগ জাতীয় ইনস্টিটিউটের পরিচালক চৌ সিয়াওনুং জানান, ২০১৯ সালের শেষ দিকে কোভিড মহামারি দেখা দেওয়ার আগে, চীনে বছরে গড়ে ৩ হাজার বিদেশফেরত ম্যালেরিয়া রোগী শনাক্ত হতো। মাঝখানে কোভিডের কারণে পর্যটকদের আনাগোনা হ্রাস পাওয়ায়, ওই সংখ্যাটাও অনেক কমে গিয়েছিল। কিন্তু মহামারি নিয়ন্ত্রণে আসার প্রেক্ষাপটে চীনে বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা আবার বাড়ছে, বাড়ছে প্রবাসী চীনাদের আসা-যাওয়াও। ফলে বিদেশফেরত ম্যালেরিয়া রোগীর সংখ্যা আবারও বাড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
বস্তুত এ আশঙ্কা অমূলক নয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুসারে, ২০২০ সালে বিশ্বব্যাপী ৮৫টি দেশে ২৪ কোটিরও বেশি ম্যালেরিয়া রোগী শনাক্ত হয়, যা ২০১৯ সালের চেয়ে ৬ শতাংশ বেশি। ২০২০ সালে বিশ্বে ম্যালেরিয়ায় মারা গেছেন আনুমানিক ৬ লাখ ২৭ হাজার মানুষ, যা ২০১৯ সালের চেয়ে ১২ শতাংশ বেশি। ম্যালেরিয়া-আক্রান্তদের বড় অংশ আফ্রিকা ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মানুষ। এ দুটি অঞ্চলের সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য ও পর্যটন খাতে চীনের যোগাযোগ ক্রমশ বাড়ছে। ফলে বাড়ছে বিদেশফেরত ম্যালেরিয়া রোগী বৃদ্ধির ঝুঁকিও।
এই ঝুঁকি মোকাবিলায় চীন ইতোমধ্যে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। বিদেশ থেকে যে সব প্রবাসী চীনা বা বিদেশি আসছেন, তাদের সবাইকে কোভিড টেস্টের পাশাপাশি মাঙ্কিপক্স ও ম্যালেরিয়ার টেস্টও করা হচ্ছে কড়াকড়িভাবে। রোগ শনাক্ত হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে আইসোলেশনে রাখা হচ্ছে, চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে; নিশ্চিত করা হচ্ছে যেন, রোগ জনারণ্যে ছড়িয়ে পড়তে না পারে।
বাংলাদেশের ১৩টি জেলা ম্যালেরিয়াপ্রবণ। আক্রান্তদের ৯০ শতাংশই আবার তিনটি পার্বত্য জেলার বাসিন্দা। এদিকে চলতি বছরের (২০২২) ১০ আগস্ট ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালিক বলেন, বাংলাদেশ থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে ম্যালেরিয়া নির্মূল হয়ে যাবে বলে তিনি আশা করেন। এদিকে, গোটা বিশ্বকে ২০৫০ সালের মধ্যে ম্যালেরিয়ামুক্ত করতে চায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রীর আশা ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার লক্ষ্য পূরণ হবে কি না, তা সময়ই বলে দেবে। এদিকে, চীন ও চীনের মতো আরও কিছু দেশ আনুষ্ঠানিকভাবে ম্যালেরিয়ামুক্ত হলেও, পুরোপুরি ঝুঁকিমুক্ত হতে পারেনি। যতদিন গোটা বিশ্ব থেকে ম্যালেরিয়া গুটিবসন্তের মতো নির্মূল না হবে, ততদিন এই ঝুঁকি থাকবে। কারণ, আমাদের পৃথিবী এখন বিশ্বগ্রামে পরিণত হয়েছে। এখানে কোথাও সংক্রামক ব্যাধির উপস্থিতি থাকার অর্থ, তা যে কোনো সময় যে কোনো স্থানে ছড়িয়ে পড়া।
চীন ম্যালেরিয়ামুক্ত হলেও মশামুক্ত হতে পারেনি। বর্তমানে আমাদের হাতে যে প্রযুক্তি রয়েছে, তা দিয়ে কোটি কোটি বছর ধরে টিকে থাকা মশার বংশ ধ্বংস করা সম্ভব নয়। তাই, হু ঘোষিত যে কোনো ম্যালেরিয়ামুক্ত দেশে নতুন করে ম্যালেরিয়া ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা আছে। এ অবস্থায় সতর্ক থাকার কোনো বিকল্প নেই। আশার কথা, ১৪০ কোটি মানুষের দেশ চীনের সরকার বিষয়টির ওপর সতর্ক দৃষ্টি রেখেছে।
লেখক: বার্তা সম্পাদক, চায়না মিডিয়া গ্রুপ (সিএমজি)।alimulh@yahoo.com
এইচআর/ফারুক/জেআইএম