পঞ্চগড়ে করতোয়া নদীর আউলিয়ার ঘাটে নৌকাডুবির ঘটনায় বোদা ও দেবীগঞ্জ উপজেলার অনেক পরিবারেই এখনো শোকের মাতম চলছে। অনেকের ঘরেই এখনো ঠিকমতো চুলা জ্বলছে না। মর্মান্তিক এই দুর্ঘটনায় অনেক শিশু তার বাবা-মাকে হারিয়েছে, নববধূ হারিয়েছেন স্বামীকে, অনেকে স্ত্রী-সন্তান হারিয়ে দিশেহারা।
Advertisement
কেউ আবার পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে জীবন চলার পথ হারিয়েছেন। তাই পরিবারগুলোর মধ্যে এবছর নেই দুর্গোৎসবের কোনো আয়োজন। তাদের সর্ববৃহৎ ধর্মীয় উৎসব যেন এবার ভেসে গেছে করতোয়ার জলে।
মাড়েয়া বটতলী এলাকার ষাটোর্ধ্ব ননী বালা বলেন, মহালয়ার পূজা দিতে গিয়ে আমার উপার্জনক্ষম একমাত্র ছেলে জগদিশ চন্দ্রকে হারিয়েছি। জগদিশের দুই অবুঝ শিশু স্বন্দীপ আর প্রিয়াংকা অনাথ হয়েছে। নৌকাডুবিতে জগদিশের সঙ্গে থাকা ভাতিজা সেন্টু চন্দ্রও (২৬) মারা গেছে। আমাদের পরিবারে এখনো শোকের মাতম চলছে। আমাদের আর কিসের দুর্গোৎসব। এখন পরিবার নিয়ে বাঁচবো কীভাবে এটা চিন্তা করেই কূল-কিনারা পাই না।
একই এলাকার বাসুদেব চন্দ্র রায়ের (৩২) দুই সন্তান অরণ্য রায় (৩) এবং নন্দিনী রায় (৬) মর্মান্তিক এই নৌকাডুবিতে তাদের মা রুপালী রানীকে (২৬) হারিয়েছে। শিশু অরণ্য বাবার সঙ্গে বাড়িতেই ছিল। তবে মায়ের সঙ্গে ওই নৌকায় নন্দিনীও ছিল। ভাগ্যের জোরে প্রাণে বেঁচে যায় সে। তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়ার পর সুস্থ হয়। তবে দুর্ঘটনার পরদিন তার মায়ের মরদেহ উদ্ধার করেন উদ্ধারকর্মীরা। মাকে হারিয়ে এখন বাবার হাত ধরেই থাকে শিশু নন্দিনী।
Advertisement
বাসুদেব বলেন, আমার ছয় বছরের শিশুকন্যাসহ স্ত্রী রুপালী রানী বদ্বেশ্বরী মন্দিরে মহালয়া উৎসবে পূজা দিতে যায়। নৌকাডুবির ঘটনায় মেয়েকে ফিরে পেলেও তার মা রুপালী রানীর মরদেহ পেয়েছি। এখন আমি কোলের দুই শিশুকে নিয়ে দিশেহারা। মেয়ের আতঙ্ক এখনো কাটেনি। সারাক্ষণ আমার হাত ধরে থাকে। কী আর দুর্গোৎসব পালন করবো!
এদিকে, মহালয়ার পুণ্য তিথিতে করতোয়া নদীতে পুণ্যার্থীদের নিয়ে নৌকাডুবির ঘটনায় নিহতদের প্রতি সম্মান জানিয়ে কোনো উৎসব করছে না জেলা হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ এবং জেলা পূজা উদযাপন কমিটি। দুই সংগঠনের পক্ষ থেকে পৃথক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, পূজা চলাকালে কালোব্যাজ ধারণ, সপ্তমী তিথিতে প্রত্যেক পূজামণ্ডপে প্রয়াত ব্যক্তিদের আত্মার শান্তি ও মঙ্গল কামনায় বিশেষ প্রার্থনা, বিভিন্ন পূজামণ্ডপ থেকে আদায় করা অর্থ দিয়ে প্রয়াতদের প্রতি সমবেদনা ও তাদের পরিবারকে আর্থিক সহায়তার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে গত শুক্রবার এক সভায় প্রয়াত ব্যক্তিদের নামে ঘটনাস্থলে স্মৃতিসৌধ নির্মাণের দাবি জানান হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ এবং জেলা পূজা উদযাপন কমিটির নেতারা।
এদিকে, নৌদুর্ঘটনায় প্রয়াতদের স্মরণে ৫১ পীঠ শ্রী শ্রী ত্রিস্রোতা শক্তিপীঠ বদ্বেশ্বরী মন্দির কমিটির পক্ষ থেকে আওলিয়ার ঘাটে একটি স্মৃতি মন্দির নির্মাণের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। কমিটির পক্ষ থেকে মন্দিরের নিজস্ব অর্থ দিয়ে এই মন্দির নির্মাণ করা হবে বলে জানা গেছে।
বদ্বেশ্বরী মন্দির কমিটির সদস্য সুশীল চন্দ্র বর্মণ বলেন, এবার শুধু মায়ের পূজা দেওয়া হবে। কোনো আরতী বা গানবাজনা হবে না। আমাদের বোদা ও দেবীগঞ্জ উপজেলায় কোনো উৎসব হবে না। তবে যেহেতু পূজা আরাধনা করতে গিয়ে প্রয়াতদের প্রাণ বিসর্জন হয়েছে, তাই আমরা মনে করি তারা সবাই স্বর্গবাসী। তাদের জন্য নিয়মিত প্রার্থনায় আমরা দুর্ঘটনাস্থল আওলিয়ার ঘাটে একটি স্মৃতি মন্দির করবো। কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মন্দিরে দুর্ঘটনায় প্রয়াত সবার নাম লেখা থাকবে এবং যতদিন পৃথিবী থাকবে, ততদিন সেই মন্দিরে তাদের জন্য পূজা অর্চনা করা হবে।
Advertisement
জেলা পূজা উদযাপন কমিটির সাধারণ সম্পাদক বিপেন চন্দ্র রায় বলেন, মহালয়ার পূণ্য তিথিতে করতোয়া নদীতে পূণ্যার্থীদের নিয়ে নৌকাডুবির ঘটনায় নিহতদের প্রতি সম্মান জানিয়ে আমরা পূজা চলাকালে কালোব্যাজ ধারণ, সপ্তমী তিথিতে প্রত্যেক পূজামণ্ডপে প্রয়াত ব্যক্তিদের আত্মার শান্তি ও মঙ্গল কামনায় বিশেষ প্রার্থনা করা হবে। পূজায় আদায় করা অর্থ দিয়ে প্রয়াতদের প্রতি সমবেদনা ও তাদের পরিবারকে আর্থিক সহায়তা করা হবে।
গত ২৫ সেপ্টেম্বর দুপুরে মহালয়া পূজা উৎযাপন করতে শতাধিক সনাতন ধর্মাবলম্বী বোদা উপজেলার করতোয়া নদীর মাড়েয়া পাড় আওলিয়ার ঘাট থেকে বড়শশী পাড়ের শ্রী শ্রী শক্তিপীঠ বদ্বেশ্বরী মন্দিরে যাচ্ছিলেন। ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রীর কারণে নদীর মাঝপথে আওলিয়ার ঘাটে নৌকাটি ডুবে যায়। এরপর উদ্ধার অভিযানের প্রথম চারদিনে ৬৯ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। রোববার (২ অক্টোবর) সকাল থেকে নৌকাডুবি অষ্টম দিনেও উদ্ধার অভিযান চলছে। ফায়ার সার্ভিসের ১২ ইউনিট ও ১২ জনের একটি ডুবুরিদল করতোয়ার আউলিয়ার ঘাট থেকে ১০০ কিলোমিটার এলাকায় অভিযানে রয়েছেন। তবে গত চারদিনে কোনো মরদেহ উদ্ধার করা যায়নি। এ ঘটনায় এখনো এক শিশুসহ তিনজন নিখোঁজ রয়েছেন।
সফিকুল আলম/এমআরআর/জেআইএম