ভ্রমণ

ষাট গম্বুজ মসজিদসহ বাগেরহাটে ঘুরে দেখুন আরও ৩ স্পট

ইসতিয়াক আহমেদ

Advertisement

ঘুরাঘুরি করতে করতে মাথায় চেপে বসলো হঠাৎ ম্যানগ্রোভ এর ভূত। আর সেই ভূত নামাতেই অনেকটা হঠাৎ করেই দলবল পাকিয়ে এক বৃহস্পতিবার রাতে চেপে বসলাম বাগেরহাটের বাসে। খ্যাতির বিড়ম্বনার মতো অতি উন্নয়ন এরও এক মধুর বিড়ম্বনা আছে!

পদ্মা সেতু হওয়ায় এখন দক্ষিণের যোগাযোগ ব্যবস্থা এতটাই সহজ যে, সায়েদাবাদ থেকে রাত ১২টার বাস আমাদেরকে নামিয়ে দিলো যখন বাগেরহাট তখন তার কেবল রাত ৩টা পার।

যদিও যাব আমরা ভিন্ন পথে সুন্দরবন কিন্তু তবুও বাগেরহাট না ঘুরেই সুন্দরবন যেতে ঠিক মন সায় দিচ্ছিল না। ফজরের আজানের পর ভোরের আলো ফুটতেই আমরা পথ ধরলাম বিখ্যাত ষাট গম্বুজ মসজিদের।

Advertisement

ষাট গম্বুজ মসজিদ বাংলাদেশের বাগেরহাট শহর থেকে মাত্র ৭ কিলোকিটার দুরে খুলনা-বাগেরহাট মহাসড়কের উত্তরে সুন্দরঘোনা গ্রামে অবস্থিত। ২০ টাকা টিকিটেই ঢুকতে পারবেন মসজিদ কমপ্লেক্সে। মসজিদের গায়ে কোনো শিলালিপি নেই। তাই এটি কে কিংবা কোন সময় নির্মাণ নির্মাণ করা হয়েছিল সে সম্পর্কে সঠিক কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।

তবে মসজিদটির স্থাপত্যশৈলী দেখলে এটি যে খান ই জাহান নির্মাণ করেছিলেন সে সম্পর্কে কারো কোনো সন্দেহ নেই। ধারণা করা হয়, তিনি ১৫শত শতাব্দীতে এটি নির্মাণ করেছিলেন। এই মসজিদ বহু বছর ধরে ও ব্যাপক অর্থ খরচে নির্মাণ করা হয়েছিল। এর পাথরগুলো আনা হয়েছিলো রাজমহল থেকে। এটি বাংলাদেশের তিনটি বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের মধ্যে একটি।

মসজিদটি উত্তর দক্ষিণে বাইরের দিকে প্রায় ১৬০ ফুট ও ভেতরে প্রায় ১৪৩ ফুট লম্বা আর পূর্ব পশ্চিমে বাইরের দিকে প্রায় ১০৪ ফুট ও ভেতরের দিকে প্রায় ৮৮ ফুট চওড়া। দেওয়ালগুলো প্রায় ৮.৫ ফুট। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত প্রাচীন এ মসজিদটিকে ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে মর্যাদা দেয়।

মসজিদটি বাগেরহাট শহরকে বাংলাদেশের তিনটি বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী শহরের মধ্যে স্থান করে দিয়েছে। মসজিদের পূর্বদিকের দেওয়ালে ১১টি বিরাট আকারের খিলানযুক্ত দরজা আছে। মাঝের দরজাটি অন্যগুলোর তুলনায় বেশ বড়। উত্তর ও দক্ষিণ দেওয়ালে আছে ৭টি করে দরজা। আর মসজিদের চারকোণে ৪টি মিনারও আছে।

Advertisement

এগুলোর নকশা গোলাকার ও উপরের দিকে সরু হয়ে গেছে। এদের কার্ণিশের কাছে বলয়াকার ব্যান্ড ও চূঁড়ায় গোলাকার গম্বুজ আছে। মিনারগুলোর উচ্চতা ছাদের কার্নিশের চেয়ে বেশি। সামনের দুটি মিনারে প্যাঁচানো সিঁড়ি আছে। এখান থেকে নাকি আজান দেওয়ার ব্যবস্থাও ছিলো।

এদের একটির নাম রওশন কোঠা, অপরটি আন্ধার কোঠা। মসজিদের ভেতরে ৬০টি স্তম্ভ বা পিলার আছে। এগুলো উত্তর থেকে দক্ষিণে ৬ সারিতে অবস্থিত ও প্রত্যেক সারিতে ১০টি করে স্তম্ভ আছে। প্রতিটি স্তম্ভই পাথর কেটে বানানো শুধু ৫টি স্তম্ভ বাইরে থেকে ইট দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। এই ৬০টি স্তম্ভ ও চারপাশের দেওয়ালের ওপর তৈরি করা হয়েছে গম্বুজ।

মসজিদের নাম ৬০ গম্বুজ হলেও এখানে গম্বুজ মোটেও ৬০টি নয় বরং গম্বুজ সংখ্যা ৭৭টি । ৭৭টি গম্বুজের মধ্যে ৭০ টির উপরিভাগ গোলাকার। পূর্ব দেওয়ালের মাঝের দরজা ও পশ্চিম দেয়ালের মাঝের মিহরাবের মাঝের সারির ৭ গম্বুজ দেখতে অনেকটা বাংলাদেশের চৌচালা ঘরের চালের মতো।

মিনারে গম্বুজের সংখ্যা ৪টি এ হিসেবে গম্বুজের সংখ্যা দাঁড়ায় মোট ৮১ তে। তবুও এর নাম হয়েছে ষাটগম্বুজ। ঐতিহাসিকরা ধারণা করেন, সাতটি সারিবদ্ধ গম্বুজ সারি আছে বলে এ মসজিদের সাত গম্বুজ ও তার থেকে মানুষের মুখে মুখে ষাট গম্বুজ নাম হয়েছে। আবার অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন গম্বুজগুলো ৬০টি প্রস্তরনির্মিত স্তম্ভের ওপর অবস্থিত বলেই নাম ষাটগম্বুজ হয়েছে।

সিংগাইর মসজিদ

ষাট গম্বুজ মসজিদের প্রায় ৩০০ গজ দক্ষিণ-পূর্ব দিকে সিংগাইর মসজিদের অবস্থান। এই মসজিদের একটিমাত্র গম্বুজ আছে। খান জাহান আলির নিজস্ব স্থাপত্যশৈলী অনুযায়ী, গম্বুজটি পুরু দেওয়ালের উপর দণ্ডায়মান ও এর র্শীষে আছে বাঁকানো কার্নিশ।

মসজিদের প্রত্যেক বাহু বাইরের দিকে ৩৯ ফুট ও ভেতরের দিকে ২৫ ফুট লম্বা। ইট নির্মিত মসজিদটির প্রাচীরগুলো প্রায় ৭ ফুট প্রশস্ত। মসজিদের পূর্ব দেওয়ালে আছে প্রবেশের পথ। প্রবেশপথ বরাবর পশ্চিম দেয়ালে আছে তিনটি অলংকৃত মিহরাব।

তবে কেন্দ্রীয় মিহরাবটি অপেক্ষাকৃত বড় ও সুসজ্জিত। ঐতিহাসিকগণ মনে করেন সিংগাইর বা সিংড়া মসজিদের নির্মাণকাল আনুমানিক পঞ্চদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি। সিংগাইর মসজিদ ঘুরেই এবার আমরা ধরলাম হযরত খান জাহান আলীর মাজারের পথ।

খান জাহান আলীর মাজার

যে ক’জন বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মাধ্যমে বাংলাদেশে বাগেরহাট জেলা সুপরিচিতি লাভ করেছে হযরত খান জাহান আলী (রহঃ) তাদের মধ্যে অন্যতম। ভারতে জন্মগ্রহন করলেও তিনি বাংলাদেশের যশোর, বাগেরহাট অঞ্চলে আসেন ধর্ম প্রচার করতে। বাগেরহাটে নির্মাণ করেন স্বরণকালের বিখ্যাত মসজিদ ষাট গম্বুজ মসজিদ।

খাঞ্জেলী দীঘির উত্তর পাড়ে এক উচ্চ ভূমিতে তাঁর সমাধি সৌধ নির্মিত। সমাধি সৌধটি বর্গাকৃতি। এর আয়তন ৪২ফুট X ৪২ ফুট ও প্রাচীরের উচ্চতা ২৫ ফুট। এর ছাদে একটি গম্বুজ আছে। সমাধি সৌধের ভিতর একটি প্রস্তর নির্মিত বেদিতে হযরত খানজাহান (রঃ) এর মাজার অবস্থিত।

দরগাহ বা সমাধি সৌধের স্থাপত্য শিল্প অনেকটা ষাট গম্বুজের ন্যায়। শিলালিপিতে মৃত্যু তারিখ, দাফন তারিখ ছাড়াও আল্লাহর নাম, কোরআন শরিফের কয়েকটি সূরা ও তার উপর আল্লার শান্তি বর্ষিত হোক ইত্যাদি লিপিবদ্ধ আছে।

প্রতিদিন দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে জাতি ধর্ম নির্বিশেষে হাজার হাজার ভক্ত তার রুহানী দোয়া লাভের আশায় মাজার জিয়ারত করতে আসেন। এছাড়া প্রতিবছর ২৫ অগ্রহায়ণ এ মহান সাধকের মাজার প্রাঙ্গনে বার্ষিক ওরশ মোবারক ও চৈত্র মাসের প্রথম পূর্ণিমায় বার্ষিক সম্মেলন উপলক্ষে এক বিরাট মেলা অনুষ্ঠিত হয়।

খাঞ্জেলী দীঘি

হযরত খান জাহান আলী (রহঃ) মাজারের দক্ষিণ দিকে আয়তনে প্রায় ২০০ বিঘা জমি জুড়ে খাঞ্জেলী দীঘি অবস্থিত। হজরত খান জাহান আলী (রহঃ) কালাপাহাড় ও ধলাপাহাড় নামে কয়েকটি কুমির এই দিঘীতে ছেড়েছিলেন । ‘কালা পাহাড়’ ও ‘ধলা পাহাড়’ নামে দুটি বিশাল সাইজের কুমির, যেগুলো পরে মারা যায়। পরর্বতী সময়ে কিছু মিঠা পানির কুমির দীঘিতে ছাড়া হয়। মাজার জিয়ারতের উদ্দেশ্যে আগত লোক জন দীঘির এ কুমিরগুলোকে হাঁস, মুরগি, ভেড়া,খাসিসহ নানা ধরনের মানতের পশু উৎর্সগ করেন।

কালা পাহাড় মারা যাওয়ায় ষাটগম্বুজ মসজিদের জাদুঘরে মমি করে রাখা হয়েছে। দীঘির প্রধান ঘাটটি প্রশস্ত ও সুন্দর। নারীদের জন্য আলাদা ঘাট আছে। এ দীঘির পানি সুপেয়। এই দিঘিকে ঠাকুর দিঘি বলে ডাকা হয়।

খাঞ্জেলী দীঘির নামকরণ সম্পর্কে বিভিন্ন কিংবদন্তি প্রচলিত আছে। কেউ কেউ বলেন বুদ্ধ ঠাকুরের মুর্তি প্রাপ্তির জন্য এর নাম হয় ‘ঠাকুর দীঘি’। অন্যমতে, খানজাহানকে দেশীয় হিন্দুগণ ভক্তিভরে ‘ঠাকুর ’ বলতেন ও তারই বিশেষ তত্ত্বাবধানে এ দীঘি খনন করা হয় বলে তাদের ভক্তিভাজন ঠাকুরের নামানুসারে ঠাকুর দীঘি বলা হত।

আবার কেউ কেউ বলেন, পীর আলী মোহাম্মদ তাহের খাজাহানের প্রিয়তম বন্ধু ছিলেন। তিনি পূর্বে ব্রাক্ষ্মণ ছিলেন ও তার নাম ছিল শ্রী গোবিন্দ লাল রায়। খানজাহান তাকে আদর করে ‘ঠাকুর ’ বলে সম্বোধন করতেন। তারই স্মৃতি রক্ষার্থে তিনি এ দীঘির নাম ‘ঠাকুর দীঘি’ রেখেছিলেন। তার মাজার খানজাহান (রহঃ) মাজার সংলগ্ন পশ্চিমে অবস্থিত।

সব ঘুরে এবার পেট পূজা করতে বসে পড়লাম মাজারের পাশেই গড়ে ওঠা হোটেলে। চিংড়ির শহরে এসে চিংড়ি না খেলে কি হয়। তাই বসে পড়লাম গরম ভাত দিয়েই চিংড়ি গিলতে।

খাওয়া শেষে চড়ে বসলাম রিজার্ভ অটোতে, ২৫০ টাকা ভাড়ায় এই অটো আমাদেরকে নিয়ে যাবে আপাতত ফয়লা। কারণ বাগেরহাট থেকে মংলা সরাসরি যোগাযোগ ব্যবস্থা তেমন ভালো নেই। কয়েকবার ভেঙে ভেঙেই মূলত যেতে হয় মংলায় বাগেরহাট থেকে।

প্রায় ৪০ মিনিটের পথ পাড়িয়ে পৌঁছালাম ফয়লায়। তারপর ফয়লা থেকে সরাসরি বাস একদম মংলা ফেরি ঘাটে। ফয়লা থেকে মংলা এর পথেই দেখা পাবেন সেই বিখ্যাত রামপাল তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের একি সঙ্গে দেখা পাবেন, মংলা বন্দরের। ফয়লা থেকে জন প্রতি ৪০ টাকা বাস ভাড়া মংলা ফেরিঘাট পর্যন্ত। এবার পালা পশুর নদীর পার হওয়ার। চলবে. . . .

জেএমএস/এএসএম