ভ্রমণ

কুয়ায় স্বপ্নভঙ্গের পর কুয়াকাটা সৈকতে কাটালাম মন্ত্রমুগ্ধ সন্ধ্যা

সই পাতাল কি শরতে আজিকে স্নিগ্ধ আকাশ ধরনি?/ নীলিমা বাহিয়া সওগাত নিয়া নামিছে মেঘের তরণি!/ অলকার পানে বলাকা ছুটিতে মেঘ-দূত মন মোহিয়া/ চঞ্চুতে রাঙা কলমির কুঁড়ি-মরতের ভেট বহিয়া।

Advertisement

তখনো সূর্যের তেজ ততটা কমেনি। তবে আলো কমে এসেছে বেশ। কুয়াকাটা সৈকতজুড়ে বলতে গেলে সুনশান নীরবতা। ভাটায় বিশালাকার সৈকতে বিক্ষিপ্তভাবে অল্পসংখ্যক পর্যটকের ঘোরাঘুরি চলছে। এমনই পড়ন্ত বিকেলে সৈকতে পৌঁছে প্রকৃতি দেখে কাজী নজরুল ইসলামের ‘রাখি-বন্ধন’ কবিতার এই চরণগুলো মনে পড়লো।

একটু আগেই এক ‘বৃহৎ স্বপ্নভঙ্গ’র কারণে যে তীব্র হতাশার উদ্রেক হয়েছিলো, সৈকতের বালুকাবেলায় শরতের প্রকৃতি শুরুতেই তার অনেকখানি পুষিয়ে দিলো। কুয়াকাটা এসেছি সহকর্মীদের এক বৃহৎ বহরে আজ সকালেই, দু’দিনের সফরে (২৬-২৭ আগস্ট, ২০২২)।

এই ভ্রমণে আসার অন্যতম কারণ ছিলো কিংবদন্তীর এই কুয়া দেখার। পুরোটা সকাল সৈকতের জলে ঝাপিয়ে-লাফিয়ে কাটিয়ে হোটেলে ফিরে বিশ্রাম শেষে পড়ন্ত বিকেলে ফের বের হলাম কুয়াকাটার অন্যান্য স্পট দর্শনে।

Advertisement

কুয়াকাটা জিরো পয়েন্ট লাগোয়া ঐতিহাসিক কুয়া, যার থেকে কুয়াকাটা নামের উৎপত্তি-এই বিখ্যাত জনপদের পরিচিতি। কুয়াকাটার সেই বিখ্যাত কুয়া দেখতে আমার ২০ জনের এক বহর হাজির হলাম মাথার উপর আগুন ঢালা সূর্য উপেক্ষা করে।

তার আগে কুয়াকটার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস জানা যাক, কুয়াকাটা বাংলাদেশের পরিস্কারতম সমুদ্র সৈকত। দৈর্ঘ্যে ১৮ কিলোমিটার এটি একমাত্র সৈকত যেখান থেকে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দুটোই দেখা যায়। পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার লতাচাপলি ইউনিয়নের সর্বদক্ষিণে অবস্থিত সমুদ্রের বুকে চর জেগে এ সৈকতের উৎপত্তি।

উপজেলা শহর থেকে দক্ষিণে ২২ কিলোমিটার কুয়াকাটা। এর পশ্চিমে আন্ধারমানিক নদের মোহনা, ফাতরার বন, সখিনার সি-বিচ, পূর্বে গঙ্গামতির বা গজমতির খাল ও আগুনমুখা নদীর মোহনা। সুলতানি বা মুঘল আমলে এ অঞ্চলে মানববসতির শুরু।

তৎকালীন বর্মি রাজার নির্যাতনে অতিষ্ঠ আরাকান রাজ্যের মেঘবতী অঞ্চল থেকে ১৭৮৪ সালে এই উপকূলীয় এলাকায় ক্ষুদ্র জাতিসত্তা রাখাইনদের আগমন ঘটে। ১৫০টি রাখাইন পরিবার ৫০টি বড় নৌকায় চড়ে গলাচিপা উপজেলার জনমানবশূন্য রাঙ্গাবালীতে এসে আশ্রয় নেয়।

Advertisement

পরে তারা আশপাশে ছড়িয়ে স্থায়ী বসতি গড়ে তোলে। সে সময় এখানকার জনপদে সুপেয় পানির তীব্র অভাবের কারণে রাখাইনরা একটি কুয়া খনন করে, যার থেকে এই জনপদের নাম হয়ে ওঠে কুয়াকাটা।

এবার কুয়াকাটার সেই প্রায় ২৫০ বছরের প্রাচীন কুয়া দর্শনের গল্পে ফেরা যাক। কুয়াকাটার শ্রীমঙ্গল বৌদ্ধ বিহারের ছাত্রদের তত্তাবধানে আদি কুয়া হিসেবে এখনো টিকে থাকা কুয়াটিকে একটি টিনের বৃত্তাকার চালাঘরে লোহার শিকের বেষ্টনী দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে।

কুয়া সংস্কার ও সংরক্ষণের নামে পুরোটাই বর্ণিল টাইলস বাঁধাই করায় এর সৌন্দর্যবর্ধনের চেয়ে সৌন্দর্যহানিই ঘটেছে বলে মনে হলো। এর চেয়ে আদি কুয়ার অবয়ব যতটা সম্ভব সংরক্ষণ করা গেলেই তা পর্যটকদের পিপাসা মেটাতো।

মানসচক্ষে কুয়ার যে ছবি ছিলো তার সঙ্গে এই সুপ্রাচীন কুয়ার সাদৃশ্য পেলাম না। ফলে আশাহত মন নিয়েই ঢুঁ মারলাম পাশের রাখাইন মহিলা মার্কেটে। সেখান থেকে বাঁধ পেরিয়ে ওপারে সৈকতের বালুকাবেলায়।

সকালে সৈকতে গোসল করতে এসে যে উম্মাতাল তরঙ্গমালা আর তার সাথে পর্যটকদের ‘মাছ বাজার’র ভিড় দেখেছিলাম তার কোনো রেশই এখন নেই। ভাটায় সৈকতের পানি নেমে গেছে কোথাও কোথাও তীর হতে প্রায় অর্ধ কিলোমিটার নিচে।

ফলে সকালে জোয়ারের কারণে পুরো সৈকত নিমজ্জিত থাকলেও এখন অবারিত বালুকাবেলা। পানি নেমে যাওয়ায় ও বিকেলের শুরু হওয়ায় পর্যটকদেরও তেমন ভিড় নেই।

ক্রমে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসায় সৈকতজুড়ে প্রকৃতি কেবলই মুগ্ধতা বাড়াতে শুরু করলো। নীলাভ আকাশে শরতের মেঘবালিকার কারণে শঙ্কায় ছিলাম সকালের সূর্যোদয় দেখতে না পারার মতো সূর্যাস্তও মিস করা নিয়ে। ক্রমে সূর্য রক্তিমাকার ধারণ করতেই সে সম্ভাবনা পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকলো।

বিশাল সৈকতের বেলাভূমিতে বিভিন্ন পয়েন্টে মনের সুখে ফুটবল খেলতে শুরু করেছেন অনেকেই। ছোট ছোট দল বেঁধে হেঁটে বেড়াচ্ছে নগণসংখ্যক পর্যটক। হাঁটতে হাঁটতে সুমদ্রের পানি যেখানে নেমে গেছে সেখানে গিয়ে পৌছুলাম।

ভয়ংকর ও উত্তাল ঢেউয়ের গর্জন আর সমুদ্রজল ভেজা বাতাস মূহুর্তে শরীর- মন জুড়িয়ে দিলো। সন্ধ্যা যত ঘনিয়ে আসছে ততই পানি ফুলে-ফেঁপে উঠতে শুরু করছে। জোয়ার আসন্ন বোঝা গেলো।

সমুদ্রতট ধরে ঘুরছি আর অপেক্ষা করছি সূর্যাস্ত দেখব। কিন্তু সময় পার হয়ে গেলেও মেঘের কারণে কুয়াকাটার সাগরে সূর্যের ডুবে যাওয়াটা আর দেখা হলো না। তবে পশ্চিমাকাশে যে আবির লেগেছে তা পুরো সৈকত জুড়ে এক দারুণ মন্ত্রমুগ্ধ সৌন্দর্যের প্রতিচ্ছবি তৈরি করেছে। প্রকৃতিপিয়াসী মাত্র সমুদ্রের এই রূপ দেখে মুগ্ধ হতে বাধ্য।

আদতে সকাল-দুপুর বা জোয়ারের সময়ে পর্যটকঠাসা সৈকতের চেয়ে গোধুলিবেলার কুয়াকাটার এই কিছুটা চাঞ্চল্যহীন, সুনশান সৈকত, জোয়ার-ভাটার এই সন্ধিক্ষণের রূপই কুয়াকাটার প্রকৃত সৌন্দর্যের বাহক।

সূর্যাস্ত দেখতে না পারলেও সন্ধ্যার এই রূপ উপভোগ করছিলাম। শরতের মেঘময় আকাশে গোধুলির রঙ লাগতেই না লাগতেই জোয়ারের প্রভাব দেখা গেলো। ক্রমেই ঢেউয়ে ঢেউয়ে সমুদ্রের জল সৈকত মাড়িয়ে তীরের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। শুকনো বালুকাবেলায় ছবি তুলছিলাম শেষ না হতেই দেখি সে জায়গা নিমিজ্জত।

ঘটনাটি সবার কাছে বেশ উপভোগ্য মনে হলো। পানি যতই পারের দিকে এগুচ্ছে আমরাও সমানতালে ডাঙার দিকে পিছু হটতে শুরু করলাম। খেয়াল করলাম মাছ ধরা কিছু নৌকাও তীরে ফিরে অপেক্ষা করছে। ক্রমান্বয়ে ট্রাক্টরসদৃশ বড় চাকার গাড়ির সঙ্গে মোটা রশি বেঁধে দ্রুতগতিতে তীরের দিকে টেনে নৌকাগুলোকে বেশ দূরে ডাঙায় নিয়ে রাখছে একদল লোক।

সমুদ্রের উপচেপড়া ঢেউ হতে গাড়ির টানে মাছ ধরা ট্রলার তীরে আনার এ দৃশ্যও বেশ মনোহর। পারে ফিরলাম। পুরো সৈকতই এখন নিমজ্জিত পানিতে। মিনিট কয়েক আগেও যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম সেখানে এখন ফুলে-ফেঁপে ওঠা ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে, সাগরপাড়ে দাঁড়িয়ে যেন গায়ে এসে লাগছে তার শীতল স্পর্শ।

গোধুলির সৈকত দেখতে যারা সঙ্গী হয়েছিলো তাদের অনেকেই ততক্ষণে হাওয়া। কেউ কেউ ঢুঁ মারছে সৈকতের জিরো পয়েন্ট এলাকার মার্কেটে। কেউ আবার জিরো পয়েন্টের পশ্চিম ঢালে সন্ধ্যার পর হতেই জমজমাট হয়ে ওঠা ‘ফিশ ফ্রাই’র বাজারে।

গোধুলি পেরিয়ে নিকষকালো রাত নামতে শুরু করলেও সৈকতে নেই কোনো আলোর ব্যবস্থা। অগত্যা পা বাড়ালাম ফিশ ফ্রাইয়ের স্বাদ নিতে। লেখক: কবি ও ব্যাংকার

জেএমএস/এএসএম