মতামত

হুমকি-ধমকি লাঠি বন্দুক : বড় সংকটের পূর্বাভাস কি?

রাজনৈতিক সংঘাত দেখে আশঙ্কা হচ্ছে,২০১৪ সাল কি আবারও আসছে? নির্বাচনের আরও প্রায় ১৫ মাস বাকি।এরমধ্যেই হতাহতের ঘটনাও ঘটিয়েছে আমাদের রাজনীতিবিদগণ।সবাই মুখে বলেন শান্তিপূর্ণ রাজনীতি চান তারা। কিন্তু কথা ও কাজে ফারাক কমছে না তারপরও।জুলাই থেকে এই পর্যন্ত শতাধিক আহত এবং ৪জন নিহত হওয়ার পর স্বাভাবিক কারণেই আশঙ্কা হচ্ছে ২০১৪ সালের নৃশংস রাজনীতি কি আমাদের আবারও দেখতে হবে?

Advertisement

এরমধ্যে উস্কানিমূলক মন্তব্য করতেও কমতি নেই নেতাদের।কর্মীরা যেন নেতাদের নির্দেশ পালন করতে গিয়েই একের পর এক সংঘাত সৃষ্টি করে চলেছে।শুধু তাই নয় তাদের এই সংঘাত শুধু প্রতিপক্ষ দলের বিরুদ্ধেই চলে না,চলে নিজ দলের অভ্যন্তরেও।

এমন ঘটনা মুন্সীগঞ্জে যেমন ঘটেছে,চট্টগ্রামে ঘটেছে,ঢাকায় ঘটেছে এসবের কেন্দ্রবিন্দুতে বিএনপিকেই দেখা গেছে।সর্বশেষ ইডেন কলেজে ছাত্রলীগের চুলোচুলির ঘটনায় কমিটি বাতিল ঘোষণা করতে হয়েছে ওখানকার। কিন্তু তারও আগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েও ছাত্রলীগ পদ না পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দিয়ে ক্ষোভ প্রকাশের নামে শিক্ষা কার্যক্রমই বন্ধ করে দিয়েছিলো।

বিএনপি দলীয় কেন্দ্রীয় নেতাদের মুখ থেকে আমাদের শুনতে হয়েছে-লাঠি নিয়ে মাঠে আসার আহ্বান। সঙ্গত কারণেই এই নির্দেশনার পর যখন পুলিশের প্রতি লাঠি হামলা হয় তখন দায়টা কি উস্কানিদাতা হিসেবে দলীয় নেতাদের ওপর বর্তায় না? সর্বশেষ দেখা গেলো তারা পতাকাসহ মিছিলে অংশ নিচ্ছে। আর সেই পতাকাদণ্ড হিসেবে ব্যবহার করেছে গজারির লাঠি কিংবা মোটা বাঁশের লাঠি। আর সেই লাঠির ব্যবহারই করেছে সংঘাতে। বিএনপি নেতা গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের লাঠি নিয়ে মিছিল করার নির্দেশ পালন করতে গিয়ে ওরা জাতীয় পতাকাকে ব্যবহার করেছে।টেলিভিশন চ্যানেলে দেখা মারামারির দৃশ্য দেখে স্পষ্ট বোঝা গেছে তারা মারামারির কাজে জাতীয় পতাকাকে ব্যবহার করেছে।এরপরই আওয়ামী সাধারণ সম্পাদক অভিযোগ করেছেন বিএনপি জাতীয় পতাকাকে অবমাননা করেছে।

Advertisement

বিএনপি নেতা মির্জা আব্বাস বলেছেন বৈধ বন্দুকের ব্যবহারের কথা। এমন বক্তব্য কোনো নেতার কাছ থেকে শোনা যাবে এটা সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত।ঢাকায় বিএনপি আওয়ামী লীগের সংঘর্ষ হলো ধানমন্ডি এলাকায়।তিনি বলেছেন আমরাও বন্দুক দিয়ে বন্দুক মোকাবিলা করবো। তিনি বন্দুকের লাইসেন্স দিতে আহ্বান জানিয়েছেন একইসঙ্গে।

দায়িত্বশীল কোনো নেতা কি এমন কথা বলতে পারেন? এতে কি এমন মনে হয় না দেশটাকে বন্দুকযুদ্ধের দিকে নিয়ে যেতে চাইছেন তারা? ভাগ্য ভালো সেদিন কোনো মৃত্যুসংবাদ শুনতে হয়নি।মির্জা আব্বাসের বৈধ বন্দুক ব্যবহারের আকাঙ্ক্ষা কি কর্মী পর্যায়ে অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহারে উস্কে দেওয়া হয় না? নেতাদের নির্দেশ পালন হলে হয়তো তাই শুনতে হতো মানুষকে।

বিএনপির সমাবেশে পুলিশি হামলার অভিযোগ বিএনপি নিয়মিত করে।কোথাও কোথাও পুলিশকে ধৈর্যহারা হতেও দেখা যায়।সেখানে আমাদের চোখ পড়ে আওয়ামী লীগের বক্তব্যে। ভোলায় পুলিশি অ্যাকসনের পর আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক বলেছিলেন,পুলিশের প্রতি আক্রমণ হলে পুলিশ কি আঙ্গুল চুষবে? আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে রাজপথে মোকাবিলা করার কথা একাধিকবারই বলেছে। সেপ্টেম্বরে আওয়ামী লীগ মাঠে নামবে এমন ঘোষণা আওয়ামী লীগ নেতা হাছান মাহমুদ দেওয়ার পর যেন প্রতিপক্ষ আরও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে।

এরমধ্যে বিএনপি মহাসচিব বিভাগীয় শহরগুলোতে প্রতিবাদ সমাবেশ করার ঘোষণা দিয়েছে ২৮ সেপ্টেম্বর।কিন্তু নেতাদের বক্তব্যগুলো প্রত্যাহার হয়নি এখনও। স্বাভাবিকভাবেই আতঙ্কিত হওয়ার যুক্তি রয়েছে। আাগমী দিনগুলোতে কি ভোলার মতো-মুন্সীগঞ্জের মতো আমাদের মৃত্যু সংবাদ শুনতে হবে?

Advertisement

আওয়ামী লীগ বিএনপি কর্মীদের আক্রমণ করছে,সরকার বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে হামলা-মামলা করছে এমন অভিযোগ বিএনপি নেতাদের পক্ষ থেকে করা হচ্ছে।একইসঙ্গে দেখা যায় বিএনপি নেতা দম্ভসহ বলেন,এগুলো ওয়ার্মআপ মাত্র।তার মানে ওয়ার্মআপ-এ হতাহতের ঘটনা ঘটে গেছে আর সাসপেন্স এ আমাদের কী দেখতে হবে।

আপতাদৃষ্টে বিএনপিকে একা আন্দোলনে থাকতে দেখা গেলেও,জামায়াত প্রশ্নে তারা এখনও রহস্য তৈরি করে রেখেছে।জামায়াত বিএনপি জোট সম্পর্কে নিস্কৃয়তার অভিযোগ করলেও তারা স্পষ্ট করে বলেনি তারা জোটে নেই। কিংবা বিএনপিও বলেনি জোট বাতিল হয়ে গেছে কিংবা জোট থেকে জামায়াতকে বাদ দেওয়া হয়েছে। সুতরাং এমতাবস্থায় সন্ত্রাসী এই দলটি যদি তলে তলে বিএনপির ঘাড়ে চেপে দেশকে আবার অস্থিতিশীল পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যায় তাহলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

দীর্ঘদিন পর বিএনপি সভাসমাবেশ করতে শুরু করেছে। এতদিন তাদের বিরুদ্ধে বলা হতো তারা অক্ষম দল। তাদের সাংগঠনিক শক্তি নেই।সাংগঠনিক কাঠামোগতভাবে বিএনপি কিছুটা দুর্বল,এটা ঠিক।দলের সম্মেলন কিংবা নতুন কমিটি না করার অভিযোগও পুরনো। কিন্তু তাদের কর্মীরা সব দল ছেড়ে দিয়েছে এমন ভাবার কারণ নেই।

সুতরাং আওয়ামী লীগকে সেই হিসাব করেই এগিয়ে যেতে হবে।কিন্তু তাদের রাজপথে মোকাবিলা করা হবে এমন ঘোষণা দেওয়া এবং সেই ঘোষণা কার্যকর করতে গিয়ে তাদের ওপর লাঠিচার্জ ও পুলিশী অ্যাকসন নেয়া শান্তিপূর্ণ রাজনীতি প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় না। এদিকে বিএনপি নেতাদের কথা-বার্তায় সংযত হওয়াও গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করতে জরুরি।

বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের পথচলায় সাংবিধানিক ব্যাখ্যা করলে দেখা যাবে,একটি দল আইন সংবিধান এবং আদালতের রায়কে সরাসরি উপেক্ষা করছে। আরেকটি দল সংবিধানের কথা বলে তাদের অবস্থানে অনড়। শুধু তাই নয়,তারা বিএনপিকে লক্ষ্য করে এমনও বলছে,সরকার সংবিধানের বাইরে যাবে না। আর বিএনপির এমন ক্ষমতা নেই যে তারা আন্দোলন মাধ্যমে সরকারকে সংবিধান পরিবর্তনে বাধ্য করতে পারে।প্রকারান্তরে বিএনপিকে কি এই বারতা দেওয়া হয় না যে,আমরা তোমাদের দাবি মানবো না,পারলে আন্দোলন মাধ্যমে তোমরা দাবি আদায় করে নাও।বিএনপিও কি তাহলে সেই পথেই হাঁটছে।

বিএনপি বলছে তারা যা করছে তা সাংবিধানিক অধিকার বলেই করছে তারা। অবশ্যই রাজনৈতিক দল হিসেবে তাদের প্রতিবাদ, সমাবেশ করার সাংবিধানিক অধিকার রয়েছে। কিন্তু বর্ম হিসেবে জাতীয় পতাকাকে ব্যবহার যে, সাংবিধানিক অধিকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তা কি তারা বুঝতে অক্ষম?

রাজনৈতিক দলগুলো আন্দোলন করবে এটা হতেই পারে। কিন্তু দেশকে ২০১৪ সালের দিকে নিয়ে যাওয়ার অধিকার কি তাদের আছে? গত কয়েকবছর রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ফল বাংলাদেশ পেয়েছে। মানুষ যতই বিএনপির সক্ষমতা নিয়ে সমালোচনা করুক না কেন। বিএনপি এতদিন পারেনি বলে এখন ঘরে বসে থাকবে এটাও ঠিক নয়। নামুক সবাই। কিন্তু সংঘাত নয়। বাংলাদেশের মানুষ আগুনে সন্ত্রাস দেখতে চায় না।

একটু শান্তিপূর্ণ পরিবেশ থাকলে দেশের জন্য ভালো। অন্তত বিশ্বকে কাঁপিয়ে দেওয়ার করোনার আঘাত সামাল দিয়েও বাংলাদেশের অবস্থান শক্তিশালী করতে পারে সেটা প্রমাণিত। বাংলাদেশ এগিয়ে গিয়েছে ঈর্ষণীয়ভাবে। এই এগিয়ে যাওয়াটা যেন বন্ধ না হয় সেদিকে নজর দিতে হবে সবাইকে।

লেখক: সাংবাদিক,শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক।

এইচআর/এমএস