যেন মরুভূমিতে সুই খোঁজার চ্যালেঞ্জ নিয়ে মাঠে নেমে পড়েন উপ-পরিদর্শক (এসআই) মিলটন কুমার দেবদাস। ২০১৩ সালে চাকরি শুরুর পর এ পর্যন্ত ৫ হাজার ২০০’র বেশি হারানো মোবাইল ফোন উদ্ধার করে ভুক্তভোগীদের কাছে ফিরিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ একাধিকবার পুরস্কৃতও হয়েছেন। বর্তমানে এসআই মিল্টন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) খিলগাঁও থানায় কর্মরত।
Advertisement
তিনি বলেন, অনেক দামি জিনিস হারানোর চেয়ে মোবাইল হারানোর কষ্ট অনেক বেশি। কেননা মোবাইলে প্রয়োজনীয় নম্বর থেকে শুরু করে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য থাকে। জিডি করার পর ফোন উদ্ধার করে ভুক্তভোগীকে ফিরিয়ে দিলে অনেকে বিশ্বাসই করতে চান না। মোবাইল নেওয়ার সময় অনেকে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন।
আরও পড়ুন: চোরাই মোবাইল না কেনার পরামর্শ ডিবির
হারানো মোবাইল উদ্ধার, মোবাইল না হারানোর কৌশল, পুরোনো মোবাইল কেনাবেচা সংক্রান্ত তথ্য ও হারিয়ে গেলে করণীয়সহ একাধিক বিষয়ে খোলাখুলি জাগো নিউজের সঙ্গে কথা বলেছেন এসআই মিল্টন কুমার দেবদাস। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন নিজস্ব প্রতিবেদক তৌহিদুজ্জামান তন্ময়।
Advertisement
জাগো নিউজ: হারানো মোবাইল উদ্ধারে পেছনের গল্প শুনতে চাই।
এসআই মিলটন কুমার: ছাত্র জীবনে আমার একটি মোবাইল হারিয়ে যায়। অনেক খোঁজাখুঁজির পরও শখের মোবাইলটি ফেরত পাইনি। সেখান থেকে মানুষের হারানো মোবাইল উদ্ধার করে দেওয়া এক ধরনের আবেগ কাজ করা শুরু করে। যাদের মোবাইল হারিয়ে যায় চেষ্টা করি তাদের মোবাইল উদ্ধার করে ফিরিয়ে দিতে। হারানো মোবাইল খুঁজে পেতে বাংলাদেশ পুলিশের অত্যাধুনিক প্রযুক্তি রয়েছে, যা ব্যবহার করে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। এছাড়া প্রযুক্তিগত সমস্যা সমাধান করা সম্ভব। চাকরির পর এ পর্যন্ত ৫ হাজার ২০০’র বেশি হারানো মোবাইল উদ্ধার করে ভুক্তভোগীদের ফিরিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছি।
উদ্ধার মোবাইল প্রকৃত মালিকের কাছে ফেরত দেওয়ার দৃশ্য-সংগৃহীত ছবি
আরও পড়ুন: আগস্টে হারানো ৪০ মোবাইল উদ্ধার, খুশি মালিকরা
Advertisement
হারানো মোবাইল ফিরে পেয়ে মানুষ যে অনুভূতি, দোয়া ও ভালোবাসা প্রকাশ করে সেটিই আমার জন্য আনন্দের। পুলিশ হিসেবে সাধারণ মানুষের কাছাকাছি যেতে পারা যেমন আমার জন্য গর্বের বিষয় তেমনি বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর জন্য গর্বের।
জাগো নিউজ: হারানো সব মোবাইল উদ্ধার করা সম্ভব?
এসআই মিলটন কুমার: হারানো মোবাইল শতভাগ উদ্ধার হবে এমনটা সম্ভব নয়। মোবাইল কেনাবেচার ক্ষেত্রে মোবাইলের বক্স অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মোবাইলের বক্সের আইএমইআই নম্বরের সঙ্গে মোবাইলে দেওয়া আইএমইআই নম্বর মিলিয়ে মোবাইল কিনলে তা প্রতারিত হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। মোবাইল হারিয়ে বা চুরি হলে অবশ্যই আইএমইআই নম্বর ও মোবাইলে থাকা সিমের নম্বর জিডিতে উল্লেখ করতে হবে।
জাগো নিউজ: পুরোনো মোবাইল কেনা কতটা ঝুঁকিপূর্ণ?
এসআই মিলটন কুমার: বর্তমান সময়ে মোবাইলের ছবি দিয়ে আকর্ষণীয়ভাবে বিক্রয়ডট কম অথবা অনলাইনে মোবাইল কেনাবেচা হয়। যেখানে দামি মোবাইলের ছবি দিয়ে কম দামে বিক্রির বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। এসব মোবাইল কেনার জন্য শিক্ষার্থী ও কম আয়ের মানুষ আকৃষ্ট হয়। কোনো কিছু যাচাই-বাছাই না করেই তারা মোবাইল কিনে নেয়। যার কারণে তারা অনেক সময় আইনের আওতায় এসে যায়। কারণ ক্রয়কৃত মোবাইলটি চোরাই, ছিনতাই কিংবা বড় কোনো ক্রাইমের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারে। যে মোবাইলটি ব্যবহার করে অপরাধ করেছে এবং পরে ওই মোবাইলটি যার কাছে পাওয়া যাবে দুজনের একই সাজা হবে। এ কারণে চোরাই কিংবা পুরোনো মোবাইল কেনা থেকে বিরত থাকাই উত্তম। যদি পুরোনো মোবাইল কিনতেই হয় অবশ্যই তা ভালোভাবে যাচাই-বাছাই করে মোবাইলের বক্সসহ কিনতে হবে।
জাগো নিউজ: মোবাইল হারিয়ে গেলে করণীয় কী?
এসআই মিলটন কুমার: মোবাইল হারিয়ে গেলে সর্বপ্রথম নিকটস্থ থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করতে হবে। জিডির মধ্যে মোবাইলের আইএমইআই নম্বর অবশ্যই উল্লেখ করতে হবে। মোবাইলে থাকা সিমের নম্বর উল্লেখ করতে হবে। চেষ্টা করবেন যত দ্রুত সম্ভব মোবাইলে থাকা সিম রিপ্লেস করে নিতে। মোবাইল হারানোর সঙ্গে সঙ্গে উদ্ধার করা সম্ভব নয়। যেকোনো মোবাইল হারিয়ে গেলে অবশ্যই আপনাকে ধৈর্য ধরতে হবে। দুই মাস, চার মাস কিংবা অনেক সময় এক বছরেরও বেশি সময় লেগে যায় হারানো মোবাইল উদ্ধার করতে।
উদ্ধার মোবাইল ফেরতের সংগৃহীত ছবি
জাগো নিউজ: একান্ত মুহূর্তের ছবি-ভিডিও মোবাইলে রাখা উচিত কি না?
এসআই মিলটন কুমার: মোবাইলে স্পর্শকাতর, একান্ত মুহূর্তের ছবি-ভিডিও অথবা অতি প্রয়োজনীয় তথ্য না রাখাই ভালো। ভিড়ের মধ্যে সবসময় মোবাইল সাবধানে রাখা উচিত। রিকশায় যাওয়ার সময় সেলফি তোলা থেকে বিরত থাকতে হবে। অনেকটা মর্মান্তিক বিষয়, ইদানীং নামাজ পড়ার সময় মসজিদ থেকে মোবাইল হারিয়ে যায়। এসব ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে। মোবাইলে থাকা তথ্য গুগল ড্রাইভে সংরক্ষণ করতে পারেন। মোবাইল হারিয়ে গেলেও তথ্যগুলো ফিরে পাবেন। জিডির পর অবশ্যই তদন্তকারী কর্মকর্তাকে সময় দিতে হবে। একটি হারানো মোবাইল উদ্ধার করে ফিরিয়ে দিতে একজন তদন্তকারী কর্মকর্তাকে অনেক পরিশ্রম করতে হয়। পুলিশের ওপর বিশ্বাস রাখবেন।
জাগো নিউজ: উদ্ধার করে মোবাইল ফিরিয়ে দেওয়ার পর ভুক্তভোগীদের অনুভূতি কেমন হয়?
এসআই মিলটন কুমার: অনেক দামি জিনিস হারানোর চেয়ে মোবাইল হারানোর কষ্ট অনেক বেশি। কেননা মোবাইলে প্রয়োজনীয় নম্বর থেকে শুরু করে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য থাকে। জিডি করার পর ফোন উদ্ধার করে ভুক্তভোগীকে ফিরিয়ে দিলে তারা অনেকে বিশ্বাসই করতে চান না। মোবাইল নেওয়ার সময় অনেকে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন।
চুরি যাওয়া মোবাইল ফেরত পেয়ে খুশি প্রকৃত মালিকরা- সংগৃহীত ছবি
জাগো নিউজ: মোবাইল হারানো হ্রাস করতে করণীয় কী?
এসআই মিলটন কুমার: মোবাইল সব সময় সামনের পকেটে রাখতে হবে। কারণ, সামনের পকেট থেকে হারিয়ে বা পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা অনেক কম। গণপরিবহনে ওঠার সময় মোবাইল হাতে থাকলে হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা কমে যায়। আর সিএনজিচালিত অটোরিকশা এবং উবারের গাড়িতে ওঠার সময় সেই গাড়ির নম্বরটি টুকে নিয়ে পরিচিত কাউকে পাঠিয়ে দিলে মোবাইল হারালেও সেটি উদ্ধার করা সম্ভব হবে।
আরও পড়ুন: জিএম কাদেরের দেড় লাখের ফোন ১৮ হাজারে বিক্রি, গ্রেফতার ৫
একটি মোবাইল হারানোর ঘটনা উল্লেখ করে এসআই মিলটন বলেন, ২০২১ সালের ৪ এপ্রিল ফরিদপুর হাসপাতালে ক্যানসার আক্রান্ত রোগী অপারেশন করতে গেলে কেবিনের মধ্যে থেকে তার প্রিয় মোবাইলটি হারিয়ে যায়। অনেক খোঁজাখুঁজির পর না পেয়ে থানায় জিডি করেন তিনি। পরে ফেসবুকে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এরপর তার মোবাইলটি উদ্ধার করে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। এমন অনেক ঘটনা রয়েছে যাদের বেশিরভাগই হারানো মোবাইল ফিরে পেয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন।
টিটি/এসএইচএস/এমএস