হবিগঞ্জের ধুলিয়াখালে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) শিল্পনগরীতে ৬০টি শিল্প ইউনিটের মধ্যে চারটি ছিল কৃষি যন্ত্রপাতি উৎপাদনের। শুরুর দিকে চারটি ইউনিটেই উৎপাদন ছিল বেশ ভালো। কিন্তু গত কয়েক বছরে কৃষি যন্ত্রপাতি উৎপাদনে কাঁচামালের ব্যয় বাড়ায় চারটি কারখানার মধ্যে তিনটিই অস্তিত্ব হারিয়েছে। অন্য শিল্প ইউনিটটি চালু থাকলেও কমেছে উৎপাদন।
Advertisement
সেখানকার শিল্প মালিকরা বলছেন, লোহার মূল্যবৃদ্ধি, গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকট এবং শ্রমিকের মজুরি বাড়ায় উৎপাদন খরচ বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। উৎপাদন খরচ বাড়লেও সে অনুযায়ী কৃষিপণ্যের দাম বাড়েনি। এ অবস্থায় অর্থ সংকটে পড়ে চাহিদামাফিক উৎপাদন করতে পারছে না কারখানাগুলো। এর মধ্যে কিছু কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এ অবস্থায় উৎপাদন ধরে রাখতে এসব কারখানার সরকারি অর্থসহায়তা প্রয়োজন। অন্যথায় উৎপাদন ব্যয়বৃদ্ধির ধারায় বর্তমানে চালু থাকা শিল্প ইউনিটটিও যে কোনো সময় বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ধুলিয়াখাল বিসিক শিল্পনগরীতে কৃষি যন্ত্রপাতি উৎপাদনকারী চারটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে মেসার্স শাহজালাল ইন্ডাস্ট্রিজ, আজিজ মেশিনারিজ, মদিনা পাওয়ার ট্রেইলার ও বিসমিল্লাহ ইন্ডাস্ট্রিজ। এর মধ্যে মেসার্স শাহজালাল ইন্ডাস্ট্রিজ ও আজিজ মেশিনারিজ ব্যবসা গুটিয়ে বিসিক অঞ্চল ছেড়ে গেছে। বিসমিল্লাহ ইন্ডাস্ট্রিজ বিসিক এলাকা ছেড়ে স্থানীয় বাজারে ছোট দোকান নিয়ে কৃষি যন্ত্রপাতি উৎপাদন করছে। বর্তমানে সচল আছে মদিনা পাওয়ার ট্রেইলার। তবে এ কারখানাটি মাড়াইকল উৎপাদন বন্ধ রেখে এখন শুধু হ্যান্ড ট্রেইলার উৎপাদন করছে। এখানেও কমেছে উৎপাদন। কারখানাটি আগে যেখানে মাসে ৩৫-৪০টি হ্যান্ড ট্রেইলার উৎপাদন করতো বর্তমানে এ সংখ্যা নেমেছে ২৫টিতে।
বিশ্ববাজারে দাম বাড়ার পরিপ্রেক্ষিতে স্থানীয় বাজারেও গত এক দশকে লোহার দাম কেজিপ্রতি বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। আগে প্রতি কেজি লোহার দাম ছিল ৪০-৫০ টাকা, তা এখন বেড়ে হয়েছে ৯০-১০০ টাকা। আগে একটি হ্যান্ড ট্রেইলার উৎপাদন করতে কারখানাগুলোর খরচ হতো ৩০-৩২ হাজার টাকা। এখন উৎপাদন খরচ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৫-৪৭ হাজার টাকা। বাজারে একটি হ্যান্ড ট্রেইলার ৪০ হাজার টাকা বিক্রি করলেও কারখানার লাভ হতো ৮-১০ হাজার টাকা। এখন একই হ্যান্ড ট্রেইলার ৫০ হাজার টাকা বিক্রি করেও লাভ হচ্ছে মাত্র ২-৩ হাজার টাকা।
Advertisement
এছাড়া আগে কারখানাগুলোর প্রতি দুই মাসের এক মৌসুমে উৎপাদন ব্যয় হতো ৫০ লাখ টাকা, বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮০-৯০ লাখ টাকা। উৎপাদন ব্যয় যে হারে বেড়েছে সে তুলনায় উৎপাদিত পণ্যের দাম বাড়েনি। ফলে বাজারে কৃষিপণ্যের চাহিদা থাকলেও ব্যয় বাড়ার কারণে অর্থের জোগান না দিতে পেরে কারখানাগুলোর কোনোটা বন্ধ হচ্ছে আবার কোনোটা উৎপাদন কমিয়ে চলছে খুঁড়িয়ে।
উৎপাদনের কাঁচামালের ব্যয়বৃদ্ধিই নয়, বেড়েছে শ্রমিকের মজুরিও। বিগত বছরগুলোর তুলনায় বর্তমানে প্রত্যেক কারখানা শ্রমিকের মজুরি তিন থেকে সাত হাজার টাকা বেড়েছে। ফলে ২০ জন শ্রমিকের একটি কারখানায় বেতন বাবদ মাসিক ব্যয় বেড়েছে এক লাখ টাকার বেশি।
মদিনা পাওয়ার ট্রেইলারে সাত বছর ধরে কাজ করেন পরিমল দাস। আগে ১০-১২ হাজার টাকায় পরিবার নিয়ে চলতে পারলেও এখন ১৭ হাজার টাকা বেতন পেয়েও সংসার চালাতে কষ্ট হয় তার। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, স্ত্রী-সন্তান নিয়ে আমার চারজনের সংসার। আগে ১০ হাজার টাকায় মোটামুটি মাস চলে যেতো। এখন ১৭ হাজার টাকায়ও চলে না। অন্য কোনো কাজও জানি না। কারখানা বন্ধ হলে না খেয়ে মরার উপক্রম হবে।
২০০৭ সাল থেকে ধুলিয়াখালের ওই বিসিক শিল্পনগরীতে কৃষি যন্ত্রপাতি উৎপাদন শুরু করে মদিনা পাওয়ার ট্রেইলার। মূলত কৃষকরা যেন কম দামে আধুনিক প্রযুক্তির কৃষি যন্ত্রপাতি কৃষিকাজে ব্যবহার করতে পারেন সে লক্ষ্যেই উৎপাদন শুরু করেছিল কারখানাটি। কয়েক বছর আগেও কারখানাটির উৎপাদিত পণ্যের বেশ চাহিদা ছিল। সে মোতাবেক উৎপাদনও চলছিল। এতে কাজের পরিধি যেমন বেড়েছিল কাজের চাপও ছিল শ্রমিকদের। কিন্তু দেখতে দেখতে পরিস্থিতি পাল্টে যায়। গত কয়েক বছরে লোহা ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি এবং শ্রমিকের মজুরি বাড়ায় উৎপাদন ব্যয় মেটাতে হিমশিম খেতে হয় মালিকপক্ষকে। কারণ, উৎপাদন খরচ যে হারে বেড়েছে উৎপাদিত কৃষি যন্ত্রপাতির দাম সে হারে বাড়েনি। ফলে কারখানাটিতে আগে হ্যান্ড ট্রেইলার ও মাড়াইকল উৎপাদন হলেও এখন মাড়াইকল উৎপাদন বন্ধ। আবার হ্যান্ড ট্র্রেইলার উৎপাদনও ৩৫টি থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ২৫টিতে। বাজারে কৃষি যন্ত্রপাতির চাহিদা থাকলেও অর্থাভাবে চাহিদা মতো উৎপাদন করতে পারছে না কারখানাটি।
Advertisement
মদিনা পাওয়ার ট্রেইলার কারখানার ম্যানেজার মো. কামাল উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, মূলত কৃষকেরা যেন কম দামে কৃষি যন্ত্রপাতি পান সে লক্ষ্যেই কারখানাটি চালু হয়েছিল। আগে উৎপাদন খরচ কম ছিল, পণ্যের দামও ছিল কৃষকের সাধ্যের মধ্যে। এখন উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে, কিন্তু বাজারে কৃষি যন্ত্রপাতির দাম সে তুলনায় বাড়েনি। ফলে এক ধরনের লোকসানের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এরই মধ্যে একটি পণ্য উৎপাদন বন্ধ রাখা হয়েছে। দাম না পেলে উৎপাদন করে তো কোনো লাভ নেই।
তিনি বলেন, এখন কারখানার অবস্থাও খুব খারাপ। প্রচুর টাকার প্রয়োজন। ব্যাংকগুলো কম সুদে ঋণ দিলে উৎপাদন কিছুটা বাড়ানো যেতো। এক্ষেত্রে সরকারের সুনজরদারি প্রয়োজন। নয়তো কারখানা বন্ধের উপক্রম হতে পারে।
মদিনা পাওয়ার ট্রেইলারের মালিক আব্দুর রহিম জাগো নিউজকে বলেন, কাঁচামালের দাম বাড়ায় বেশি উৎপাদনে যেতে পারছি না। কোনোমতে কারখানা চালাচ্ছি। উৎপাদন বাড়াতে হলে টাকার দরকার। কাঁচামালের দামও কমাতে হবে, নয়তো পণ্য উৎপাদন করে লোকসানে পড়তে হবে।
একসময় দেশের বাইরে থেকে আধুনিক প্রযুক্তির কৃষিপণ্য আমদানি করা হতো। এখন দেশেই উৎপাদন করছে বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠান। এতে বৈদেশিক মুদ্রার ব্যয় সাশ্রয়ও হচ্ছে। এখন কাঁচামালের দাম নিয়ন্ত্রণে এলেই কারখানাগুলো আবারও উৎপাদন বাড়াতে পারবে। কৃষি যন্ত্রপাতির চাহিদাও মিটবে কৃষকের। এক্ষেত্রে সরকার ও ব্যাংকগুলোর আরও আন্তরিক হতে হবে।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) হবিগঞ্জের সভাপতি মো. দেওয়ান মিয়া জাগো নিউজকে বলেন, হ্যান্ড ট্রেইলার আর মাড়াইকল আগে বিদেশ থেকে আমদানি করা হতো। এখন দেশেই উৎপাদন হচ্ছে। উৎপাদন ব্যয় কমলে কারখানাগুলোতে উৎপাদন বাড়বে। বাড়বে কর্মসংস্থানও। এতে রপ্তানির সুযোগ যেমন তৈরি হবে, বাড়বে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সম্ভাবনাও। অথচ এখন ব্যবসায় বিনিয়োগ করে লাভের মুখ দেখতে না পেয়ে কোনোমতে ব্যবসা ধরে রাখছেন কারখানা মালিকরা।
তিনি বলেন, ব্যাংকঋণসহ সবকিছু দেওয়ার পর বাস্তবিক অর্থে কারখানাগুলোর তেমন লাভ থাকে না। ব্যাংক থেকে যদিও ৯ শতাংশ সুদের হারের কথা বলা হয়। কিন্তু সেটা হিসাব করলে দেখা যায় ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ হারে চলে যায়। কৃষিভিত্তিক শিল্প কারখানায় সরকার বড় শিল্প কারখানাগুলোকে ভ্যাট মওকুফ, সরকারি প্রণোদনা, কম দামে কাঁচামাল কেনার ব্যবস্থাসহ নানাবিধ সুযোগ দিচ্ছে। ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পমালিকদেরও এসব সুবিধা দেওয়া দরকার। কম দামে কাঁচামাল কেনার ব্যবস্থা এবং সীমিত সুদে ঋণ দেওয়া হলে কারখানাগুলোতে উৎপাদন যেমন বাড়বে, এ খাতের ব্যবসা আরও গতিশীল হবে। এক্ষেত্রে সরকারের সদয় দৃষ্টি একান্ত প্রয়োজন।
আরএসএম/এমকেআর/এসএইচএস/এএসএম