দেশে চাহিদার তুলনায় বিমা কোম্পানির সংখ্যা বেশি থাকলেও একের পর এক নতুন বিমা কোম্পানির অনুমোদন দিয়েছে সরকার। রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদন পাওয়া এসব বিমা কোম্পানির বেশিরভাগই ভালো ব্যবসা করতে পারছে না। সেই সঙ্গে আইনও মানছে না কোম্পানিগুলো।
Advertisement
আইন লঙ্ঘন করে বিমা গ্রাহকের টাকা বেপরোয়া খরচ করছে প্রতিষ্ঠানগুলো। এতে বেশ কয়েকটি নতুন জীবন বিমা কোম্পানির লাইফ ফান্ড বা জীবন তহবিল ঋণাত্মক হয়ে পড়েছে। সার্বিকভাবে একদিকে কোম্পানিগুলো টিকে থাকার লড়াই করছে, অন্যদিকে এসব প্রতিষ্ঠান থেকে গ্রাহকের টাকা ফেরত পাওয়া অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে যাচ্ছে।
আরও পড়ুন: জীবন বিমায় বকেয়া দাবির পাহাড়
নতুন অনুমোদন পাওয়া জীবন বিমা কোম্পানিগুলো ভালো ব্যবসা করতে না পারায় অস্বস্তিতে রয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)। তবে আইনি দুর্বলতার কারণে কঠোর পদক্ষেপ নিতে পারছে না সংস্থাটি। এজন্য বিমা আইন সংশোধনের পরিকল্পনা করছে আইডিআরএ।
Advertisement
অন্যদিকে জীবন বিমা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নতুন অনুমোদন পাওয়া বেশ কয়কটি জীবন বিমা কোম্পানি বড় ধরনের সমস্যার মধ্যে রয়েছে। এসব কোম্পানি এরই মধ্যে বিভিন্ন অনিয়মে জড়িয়েছে। ফলে সার্বিক বিমা খাতে এক ধরনের ইমেজ সংকট সৃষ্টি হচ্ছে। তাই সার্বিক বিমা খাতের স্বার্থে এসব কোম্পানির বিরদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। প্রয়োজনে এসব কোম্পানির ব্যবসাও বন্ধ করে দিতে হবে।
আরও পড়ুন: জীবন বিমার অবৈধ ব্যয় বাড়ছেই
নতুন বিমা কোম্পানি হিসেবে দেশে ব্যবসা শুরু করা একটি প্রতিষ্ঠান আকিজ তাকাফুল লাইফ। এই জীবন বিমা কোম্পানিটি ২০২১ সালে আইন লঙ্ঘন করে ব্যবস্থাপনা খাতে অতিরিক্ত ১ কোটি ৫ লাখ টাকা খরচ করেছে। ব্যবস্থাপনা খাতে কোম্পানিটি মোট ব্যয় করেছে ১ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। অথচ আইন অনুযায়ী এ খাতে কোম্পানিটির সর্বোচ্চ ব্যয়ের সীমা ছিল ৩৪ লাখ টাকা। এমন অর্থ ব্যয় করা কোম্পানিটি বছরটিতে মোট প্রিমিয়াম আয় করেছে ৫৩ লাখ টাকা। আর্থাৎ যে আয় হয়েছে, ব্যয় হয়েছে তার দ্বিগুণের বেশি। এতে কোম্পানিটির লাইফ ফান্ড দাঁড়িয়েছে ঋণাত্মক ৬ লাখ টাকা।
লাইফ ফান্ড ঋণাত্মক হয়ে পড়া আরেক কোম্পানি এনআরবি ইসলামী লাইফ। ২০২১ সাল শেষে কোম্পানিটির লাইফ ফান্ড দাঁড়িয়েছে ঋণাত্মক ১৮ লাখ টাকায়। বছরটিতে ৫ কোটি ৫৬ লাখ টাকা প্রিমিয়াম আয় করা এই প্রতিষ্ঠানটি ব্যবস্থাপনা খাতে ব্যয় করেছে ৬ কোটি ৫০ লাখ টাকা। অর্থাৎ এ কোম্পানিটিও আয়ের তুলনায় ব্যয় বেশি করেছে। এতে আইন লঙ্ঘন করে কোম্পানিটি ব্যবস্থাপনা খাতে অতিরিক্ত ব্যয় করেছে ১ কোটি ২১ লাখ টাকা।
Advertisement
আরও পড়ুন: সিইও সংকটে নতুন বিমা কোম্পানিগুলো
লাইফ ফান্ড ঋণাত্মক হয়ে পড়ার তালিকায় রয়েছে যমুনা লাইফ। ২০২১ সাল শেষে এই কোম্পানিটির লাইফ ফান্ড দাঁড়িয়েছে ৩ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। লাইফ ফান্ড ঋণাত্মক হয়ে পড়া এ কোম্পানিটি আইন লঙ্ঘন করে ব্যবস্থাপনা খাতে অতিরিক্ত অর্থও ব্যয় করেছে। ২০২১ সালে আইন লঙ্ঘন করে কোম্পানিটি ব্যবস্থাপনা খাতে অতিরিক্ত ব্যয় করেছে ৩ কোটি ৩০ লাখ টাকা।
দেশি-বিদেশি যৌথ মালিকানার একমাত্র জীবন বিমা কোম্পানি লাইফ ইন্স্যুরেন্স করপোরেশন (এলআইসি) অব বাংলাদেশও খরচের লাগাম টেনে ধরতে পারছে না। এই বিমা কোম্পানিটি ২০২১ সালে ব্যবস্থাপনা খাতে আইন লঙ্ঘন করে অতিরিক্ত ব্যয় করেছে ২ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। ১৫ কোটি ৪০ লাখ টাকা প্রিমিয়াম আয় করা এই কোম্পানিটি ব্যবস্থাপনা খাতে মোট ব্যয় করেছে ৮ কোটি ৯ লাখ টাকা। আইন লঙ্ঘন করে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করলেও কোম্পানিটির লাইফ ফান্ড পজিটিভ রয়েছে। ২০২১ সাল শেষে প্রতিষ্ঠানটির লাইফ ফান্ড দাঁড়িয়েছে ১৬ কোটি ৪৫ লাখ টাকা।
আরও পড়ুন: বিমা দাবির টাকা পাচ্ছেন না এমপি, ঘুস চান কর্মকর্তারা!
মাত্রাতিরিক্ত অর্থ ব্যয়ের তালিকায় রয়েছে চার্টার্ড লাইফ। ২০২১ সালে ব্যবস্থাপনা খাতে এ কোম্পানিটির সর্বোচ্চ ব্যয়ের সীমা ছিল ২০ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। তবে কোম্পানিটি ব্যয় করেছে ২৪ কোটি ৭ লাখ টাকা। অর্থাৎ আইন লঙ্ঘন করে ৩ কোটি ২৩ লাখ টাকা অতিরিক্ত ব্যয় করা হয়েছে। আইন লঙ্ঘন করে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করলেও কোম্পানিটির লাইফ ফান্ড পজিটিভ রয়েছে। ২০২১ সাল শেষে লাইফ ফান্ড দাঁড়িয়েছে ৩৬ কোটি ১৬ লাখ টাকা।
আকিজ তাকাফুল লাইফের লাইফ ফান্ড ঋণাত্মক
জেনিথ ইসলামী লাইফও ব্যবস্থাপনা খাতে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করেছে। ২০২১ সালে কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা খাতে সর্বোচ্চ ব্যয়ের সীমা ছিল ১৪ কোটি ৬১ লাখ টাকা। তবে কোম্পানিটি ব্যয় করেছে ১৬ কোটি ৪১ লাখ টাকা। অর্থাৎ আইন লঙ্ঘন করে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করা হয়েছে ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা। অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করা এই কোম্পানিটির লাইফ ফান্ড পজিটিভ রয়েছে। ২০২১ সাল শেষে লাইফ ফান্ড দাঁড়িয়েছে ৪ কোটি ৪৩ লাখ টাকা।
আরও পড়ুন: সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকেই মিলছে না বিমা দাবির টাকা!
ব্যয়ের লাগাম টেনে ধরতে না পারা আরেক কোম্পানি ডায়মন্ড লাইফ। ২০২১ সালে এই জীবন বিমা কোম্পানিটি আইন লঙ্ঘন করে ২ কোটি টাকা অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করেছে। আইন অনুযায়ী বছরটিতে ব্যবস্থাপনা খাতে কোম্পানিটির সর্বোচ্চ ব্যয়ের সীমা ছিল ১২ কোটি ৩৬ লাখ টাকা, কিন্তু কোম্পানিটি ব্যয় করেছে ১৪ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। আইন লঙ্ঘন করে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করা এই কোম্পানিটির লাইফ ফান্ড দাঁড়িয়েছে ৩ কোটি ৭২ লাখ টাকা।
নতুন ব্যবসা শুরু করা আরেক কোম্পানি বেঙ্গল ইসলামী লাইফ। ২০২১ সালে ব্যবস্থাপনা খাতে এই কোম্পানিটির সর্বোচ্চ ব্যয়ের সীমা ছিল ২৩ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। কিন্তু কোম্পানিটি ব্যয় করেছে ২৭ কোটি ৮১ লাখ টাকা। অর্থাৎ আইন লঙ্ঘন করে অতিরিক্ত ৪ কোটি ৪২ লাখ টাকা ব্যয় করা হয়েছে। আইন লঙ্ঘন করে এমন অর্থ ব্যয় করা কোম্পানিটির লাইফ ফান্ড দাঁড়িয়েছে ৩ কোটি ১০ লাখ টাকা।
মার্কেন্টাইল ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের নামও রয়েছে মাত্রাতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করার তালিকায়। আইন অনুযায়ী ২০২১ সালে এই কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা খাতে সর্বোচ্চ ব্যয়ের সীমা ছিল ২১ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। তবে কোম্পানিটি ব্যয় করেছে ২৭ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। অর্থাৎ আইন লঙ্ঘন করে অতিরিক্ত ৫ কোটি ৫৩ লাখ টাকা ব্যয় করা হয়েছে। আইন লঙ্ঘন করে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করা কোম্পানিটির লাইফ ফান্ড দাঁড়িয়েছে ২৬ কোটি ৭৯ লাখ টাকা।
নতুন জীবন বিমা কোম্পানিগুলোর মধ্যে ভালো অবস্থানে রয়েছে গার্ডিয়ান লাইফ। এই কোম্পানিটির ব্যয় একদিকে যেমন আইনি সীমার মধ্যে রয়েছে। অন্যদিকে ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে লাইফ ফান্ড। ২০২১ সালে কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা খাতে ব্যয়ের সর্বোচ্চ সীমা ছিল ৭৬ কোটি টাকা। এর বিপরীতে প্রতিষ্ঠানটি ব্যয় করেছে ৬৫ কোটি ৩ লাখ টাকা। অর্থাৎ আইনি সীমার থেকে ১০ কোটি ৯৭ লাখ টাকা কম ব্যয় হয়েছে। এতে লাইফ ফান্ডে বড় ধরনের ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। বছর শেষে প্রতিষ্ঠানটির লাইফ ফান্ড দাঁড়িয়েছে ২৮৮ কোটি ৩ লাখ টাকা।
আরও পড়ুন: করপোরেশনের এমডি নিয়োগের ক্ষমতা, পর্ষদে প্রতিনিধি চায় আইডিআরএ
যোগাযোগ করা হলে প্রগতী লাইফের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মো. জালালুল আজিম জাগো নিউজকে বলেন, নতুন অনুমোদন পাওয়া জীবন বিমা কোম্পানিগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটি ভালো ব্যবসা করতে পারছে না। একাধিক বিমা কোম্পানির লাইফ ফান্ড ঋণাত্মক হয়ে পড়েছে। একটি জীবন বিমা কোম্পানির লাইফ ফান্ড ঋণাত্মক মানে ওই কোম্পানির ভবিষ্যৎ জিরো। আমার মতো ওই কোম্পানি অপারেট (পরিচালনা) করতে দেওয়া উচিত নয়। যাদের এ অবস্থা তারা মার্কেট নষ্ট করছে। ইমেজ নষ্ট করছে। এটা নিয়ন্ত্রক সংস্থার দেখা উচিত এবং তাদের শস্তি দেওয়া উচিত।
লাইফ ফান্ড ঋণাত্মক হয়ে পড়া আরেক কোম্পানি এনআরবি ইসলামী লাইফ
লাইফ ফান্ড ঋণাত্মক হয়ে পড়া এবং ব্যবস্থাপনা খাতে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে যমুনা লাইফের সিইও কামরুল হাসান খন্দকার জাগো নিউজকে বলেন, এ সমস্যা শুধু যমুনা লাইফের নয়। অনেক বিমা কোম্পানিতেই এটা হচ্ছে। সুতরাং এটা যমুনা লাইফের একার সমস্যা নয়, এটা টোটাল ইন্ডাস্ট্রির সমস্যা।
আরও পড়ুন: সাবেক যুগ্ম সচিবরাও হতে পারবেন বিমার উপদেষ্টা, দ্বিমত সিইওদের
চার্টার্ড লাইফের সিইও’র চলতি দায়িত্ব পালন করা এস এম জিয়াউল হক ব্যবস্থাপনা খাতে আইন লঙ্ঘন করে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয়ের বিষয়ে জাগো নিউজকে বলেন, ব্যবস্থাপনা খাতে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় হওয়ার বহুবিধ কারণ রয়েছে। আমরা ব্যয় আইনি সীমার মধ্যে নিয়ে আসার পরিকল্পনা নিয়েছি। এরই মধ্যে আমরা অতিরিক্ত ব্যয়ের হার কমিয়ে নিয়ে এসেছি। আশা করি এ বছর (২০২২) ব্যয় আইনি সীমার নিচে থাকবে।
আকিজ তাকাফুল লাইফের সিইও মোহাম্মদ আলমগীর চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, ২০২১ সালে আমরা ব্যবসা করেছি মাত্র দেড় মাস। নভেম্বর মাসের ১৫ তারিখ থেকে ব্যবসা শুরু করেছি। এর আগে ব্যবসা শুরু করতে আমাদের বিভিন্ন খরচ হয়েছে। এ কারণে খরচ একটু বেশি হবে এটাই স্বাভাবিক। ২০২১ সালে ব্যয় বেশি হলেও আগামীতে আমাদের ব্যয় আইনি সীমার নিচে থাকবে। আইনে ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের যে সীমা আছে ২০২২ সালে তার থেকে কম ব্যয় হবে।
আরও পড়ুন: বিমা করার আগে যেসব বিষয় জানা জরুরি
অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেন, বিমা খাতের মূল সমস্যা হচ্ছে মালিকানা। অধিকাংশ বিমা কোম্পানির মালিকানা রাজনৈতিক ব্যক্তিদের দখলে রয়েছে। তাছাড়া এ খাতে ইমেজ সংকট আছে। সবকিছু মিলে আমাদের দেশ বিমা খাত যেভাবে উন্নয়ন করার কথা, সেভাবে পারেনি। তবে এখন বিমার প্রতি মানুষের সচেতনতা বাড়ছে। তাই আশা করা যায়, সামনে বিমা খাতের উন্নয়ন হবে।
আইডিআরএ’র মুখপাত্র এস এম শাকিল আখতার জাগো নিউজকে বলেন, শুধু নতুন বিমা কোম্পানিগুলো না পুরোনো বেশ কয়েকটি কোম্পানি ভালো ব্যবসা করতে পারছে না। আইনের কারণে এসব কোম্পানির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তাই আমরা বিমা আইন ২০১০ সংশোধন করার উদ্যোগ নিয়েছি। আইন সংশোধন করা গেলে এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেবো।
এমএএস/এসএইচএস/এএসএম